Advertisement
০৬ মে ২০২৪

সাবধান হলে ঝুঁকির প্রসবও এখন সহজ

ন’মাসের স্বাভাবিক সময়সীমা পেরিয়ে ঝুঁকিহীন প্রসবের চেনা ছবি ইদানীং অনেকটাই বদলে যাচ্ছে। আর তার জায়গা নিচ্ছে এমন কিছু সমস্যা, যার জেরে বহু ক্ষেত্রেই সময়ের অনেক আগে প্রসব হচ্ছে। স্বাভাবিকের তুলনায় জন্ম নিচ্ছে অত্যন্ত কম ওজনের শিশু। পাশাপাশি বাড়ছে অজ্ঞাত কারণে গর্ভপাতের ঘটনাও।

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০২:১৫
Share: Save:

ন’মাসের স্বাভাবিক সময়সীমা পেরিয়ে ঝুঁকিহীন প্রসবের চেনা ছবি ইদানীং অনেকটাই বদলে যাচ্ছে। আর তার জায়গা নিচ্ছে এমন কিছু সমস্যা, যার জেরে বহু ক্ষেত্রেই সময়ের অনেক আগে প্রসব হচ্ছে। স্বাভাবিকের তুলনায় জন্ম নিচ্ছে অত্যন্ত কম ওজনের শিশু। পাশাপাশি বাড়ছে অজ্ঞাত কারণে গর্ভপাতের ঘটনাও।

অনেকেই এখন শারীরিক এমন জটিলতা নিয়ে সন্তান ধারণ করছেন, কিছু দিন আগেও যে ‘সাহস’-এর কথা ভাবতেও পারতেন না তাঁরা। স্ত্রী-রোগ চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, গর্ভাবস্থার শুরু থেকেই রক্তচাপ অনেকটাই বেশির দিকে পৌঁছে যাচ্ছে অনেকের, সঙ্গে রক্তে শর্করার পরিমাণও বাড়ছে। দেখা দিচ্ছে হার্ট কিংবা লিভারের গুরুতর সমস্যাও। সব মিলিয়ে ‘হাই রিস্ক প্রেগন্যান্সি’-র নজির এখন কার্যত ঘরে-ঘরে। আশার কথা এটাই, বহু ক্ষেত্রেই ঝুঁকি কাটিয়ে এঁরা সুস্থ সন্তানের জন্মও দিচ্ছেন।

স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত শোনাচ্ছিলেন এক রোগিণীর বৃত্তান্ত। গর্ভধারণের একেবারে গোড়ার দিন থেকেই সমস্যা ছিল তাঁর। উচ্চ রক্তচাপ, তার পর স্ট্রোকও হয়ে গেল। সিজারিয়ান যে দিন হল, তার আগের দিন থেকেই সেই মহিলা ভেন্টিলেটরে। চন্দ্রিমার কথায়, ‘‘হার্ট ফেলিওর-এর দিকে যাচ্ছিল। ভেন্টিলেশনে রেখেই সিজারিয়ান করেছিলাম। ওই মহিলার প্রথম সন্তান। আমাদের চ্যালেঞ্জ ছিল যে ভাবে হোক মা ও শিশুকে সুস্থ করে তুলবই। সেটা পেরেছি।’’ কেন এমন জটিলতা? চন্দ্রিমা বললেন, ‘‘আর্টিফিশিয়াল হার্ট ভালভ বসানো ছিল তাঁর। তার পরেও তিনি স্বাভাবিক পদ্ধতিতে সন্তান চেয়েছিলেন। আমরা সেই ইচ্ছা পূরণ করতে পেরেছি।’’

স্ত্রী রোগ চিকিৎসক অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শোনা গেল আর এক ঘটনা। নানা জটিলতা দেখা দেওয়ায় সময়ের আগেই সিজারিয়ান করে কম ওজনের যমজ সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন এক মহিলা। কিন্তু দেখা গেল প্রসবের পরে মহিলার প্ল্যাসেন্টাটা কিছুতেই আলাদা করা যাচ্ছে না। কিছু দিন আগে একটি ফাইব্রয়েড অস্ত্রোপচার হয়েছিল তাঁর। সেই কাটা জায়গায় প্ল্যাসেন্টাটা আটকে রয়েছে। শেষ পর্যন্ত কাঁচি দিয়ে প্ল্যাসেন্টা আলাদা হল ঠিকই, কিন্তু শুরু হয়ে গেল প্রবল রক্তক্ষরণ। কয়েক ইউনিট রক্ত দিয়েও পরিস্থিতি সামলানো গেল না। মহিলাকে বাঁচাতে জরায়ু বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন ডাক্তাররা। কিন্তু বাড়ির লোকজন রাজি হলেন না। শেষ পর্যন্ত দু’টো বড় প্যাকেটের গজ গিয়ে যোনির অংশে চেপে রক্ত আটকানো হল। সঙ্গে চলতে থাকল ওষুধ-ইঞ্জেকশনও। টানা কয়েক দিনের চেষ্টায় বিপন্মুক্ত করা গেল তাঁকে। অভিনিবেশবাবু বলেন, ‘‘এখানে তো বটেই, এমনকী পাশ্চাত্যের দেশগুলিতেও প্রসবের পরে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ প্রসূতির মৃত্যুর অন্যতম কারণ। আমরা যে ওই পরিস্থিতিতে ওই মহিলা ও তাঁর যমজ সন্তানদের বাঁচাতে পেরেছিলাম, সেটাই অনেক।’’

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেরিতে বিয়ে এবং গর্ভধারণ ‘হাই রিস্ক প্রেগন্যান্সি’র অন্যতম কারণ। এরই পাশাপাশি শরীরের অস্বাভাবিক ওজন এবং ভুল খাদ্যাভ্যাসও বহু ক্ষেত্রেই দায়ী। আবার কখনও কখনও এমনও হয়, বার বার গর্ভপাত হয়ে যাচ্ছে, অথচ তার কোনও কারণ খুঁজে বার করা যাচ্ছে না। স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন এমন এক মহিলার কথা, যাঁর প্রথম সন্তান আট মাসে গর্ভের মধ্যেই মারা যায়। স্বাভাবিক পদ্ধতিতে প্রসব করিয়ে বার করতে হয়। দ্বিতীয়টি এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি। পেট কেটে অস্ত্রোপচার করতে হয়। তৃতীয় সন্তানের মৃত্যু হয় জন্মের পর দিনই। চতুর্থ সন্তান আট মাসে গর্ভেই নষ্ট হয়ে যায়। পর পর এই মৃত্যুর কোনও স্পষ্ট কারণ পাওয়া যায়নি। সন্তানের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল ওই পরিবার। মল্লিনাথবাবুর অধীনে সম্প্রতি সু্স্থ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তিনি। কী ভাবে সম্ভব হল?

তিনি বলেন, ‘‘শুরু থেকেই কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছিল ওই মহিলাকে। এক বার কারও অজ্ঞাত কারণে গর্ভপাত হলে, পরের বার খুব বেশি সাবধানতা দরকার। ডাক্তাররা যদি বোঝেন, কারও প্রসবের ক্ষেত্রে ঝুঁকি রয়েছে, তা হলে সে ক্ষেত্রে কোনও পরীক্ষানিরীক্ষা, কোনও ওষুধের ক্ষেত্রেই আপস চলবে না।’’

ডাক্তাররা বলছেন, চিকিৎসা বিজ্ঞান কোনও ম্যাজিক নয়। সাফল্যের পাশাপাশি অনেক ব্যর্থতার নজিরও রয়েছে। কিন্তু সতর্কতাটাই হল বড় হাতিয়ার। আর তা প্রয়োজন রোগী এবং চিকিৎসক-দু’তরফেই।

প্রসবকালীন ঝুঁকি এড়ানোর প্রাথমিক শর্ত কী হওয়া উচিত?

বিশেষ়জ্ঞদের মতে, ৩০-৩২ বছরের মধ্যে সন্তানধারণ যেমন জরুরি, তেমনই নিয়মিত শরীরচর্চাটাও দরকার। কম বয়স থেকে শরীরচর্চার অভাবে অনেকেরই এত ধরনের জটিলতা দেখা দেয় যেখানে সন্তান ধারণের সময় থেকেই তাঁরা নানা সমস্যায় ভোগেন। ইদানীং সরকারি হাসপাতালেও ঝুঁকিপূর্ণ প্রসবের ঘটনা আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গিয়েছে।

কিন্তু পেশাগত বা অন্য নানা কারণেই তো ইদানীং মহিলারা দেরিতে বিয়ে করছেন। সন্তান ধারণ নিয়েও তাঁদের কোনও তা়ড়াহুড়ো থাকছে না। সে ক্ষেত্রে কী করা উচিত?

স্ত্রী-রোগ চিকিৎসকেরা একবাক্যে জানিয়েছেন, সময়ের ডাকে সাড়া

দিয়ে দেরিতে সন্তানধারণ যদি করতেই হয়, তা হলে সন্তানধারণের অনেক আগে থেকেই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া এবং খুঁটিনাটি সব ধরনের শারীরিক পরীক্ষানিরীক্ষাগুলি করিয়ে নেওয়া জরুরি। কারও যদি নিকট অতীতে কোনও বড় অস্ত্রোপচার হয়ে থাকে, তা হলে আরও বেশি সাবধান হওয়া দরকার। পাশাপাশি, দেহের ওজন কম থাকা এবং খাদ্যাভ্যাস যথাযথ হওয়াটাও সফল প্রসবের অন্যতম শর্ত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE