Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

নারী-পুরুষের মাপকাঠিতে দুর্নীতির বিচার সম্ভবই নয়

‘দুর্নীতিতে মেয়েরা কমই জড়ান’, নারী দিবসে মন্তব্য করে ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই মন্তব্যের সারবত্তার বিপক্ষে কলম ধরলেন শতাব্দী দাস। দুর্নীতির প্রসঙ্গেও হাসিনার বক্তব্য একরৈখিক, যদিও আপাত ভাবে স্ট্যাটিস্টিক্স তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষেই যুক্তি দেবে। দুর্নীতিপরায়ণতা বা অপরাধ প্রবণতার খতিয়ানে পুরুষ নারীর চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে।

শতাব্দী দাশ
শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৬ ১৮:১৯
Share: Save:

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ইসলামকে মান্যতা দেওয়ার ব্যাপারটি পুনর্বিবেচিত হবে, এই খবর নিয়ে বিশ্বজুড়ে প্রগতিশীলদের অভিনন্দন ও উচ্ছ্বাসের রেশ কাটতে না কাটতেই আন্তর্জাতিক বিশ্ব নারীদিবসে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কনফারেন্স সেন্টারে নারীমুক্তি ও লিঙ্গসাম্য-বিষয়ক সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করে দেশের রক্ষণশীলদের আবারও এক বার চমকে দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রক আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে হাসিনা স্পষ্ট জানালেন, জনসংখ্যার এক বৃহদাংশকে বঞ্চিত রেখে সামগ্রিক উন্নয়ন অসম্ভব। বললেন, নারী কর্তৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকার ইসলাম স্বীকৃত। মহিলাদের জন্য আরও সুযোগের প্রতিশ্রুতি দিলেন। দেশের প্রশাসন থেকে বিচারব্যবস্থায়, শিক্ষা থেকে প্রতিরক্ষায় মেয়েদের ভূমিকা মেনে নিলেন। বললেন, ‘মেয়েদের হাতে কাজ দিলে তাঁরা তা অত্যন্ত সুনিপুণ ভাবে করেন’ কারণ, ‘মেয়েরা সব পারেন। কথায় আছে, যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে।’ আরও বললেন, ‘মেয়েরা যে দুর্নীতিতে কম জড়ান তা মেনে নেওয়াই ভাল। মেয়েদের চেয়ে দুর্নীতিতে ছেলেরা অনেক বেশি জড়িয়ে।’

ভাবনা ও পরিকল্পনা অভিনন্দনযোগ্য নিঃসন্দেহে। কিন্তু লক্ষণীয়, হাসিনা তাঁর নারীমুক্তির সামগ্রিক ভাষ্যটি খাড়া করেছেন পুরুষতান্ত্রিকতারই ভাষায়। সম্পত্তির অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে গিয়ে ইসলামের দোহাই দিতে হয়েছে তাঁকে। মান্যতা পেয়েছে ‘ফেমিনাইন’ বা নারীসুলভতা। মহিলারা মহিলা হওয়ার কারণেই যত্নশীল, নিপুণ। তাই তাঁরা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কর্ম সম্পাদন করেন, যেমনটা করেন গৃহে, তেমন ভাবেই কর্মক্ষেত্রে। ‘ফেমিনাইন’কে স্বীকৃতি দিয়ে তাকে এ বার রাষ্ট্রের কাজে ব্যবহারের কথা বললেন তিনি। এত দিন এই ‘নারীসুলভ গুণগুলি’ রাষ্ট্রেরই ক্ষুদ্রতম একক ‘পরিবার’-এর কল্যাণে লাগছিল, এ বার বৃহত্তর কর্মযজ্ঞে তার ডাক এল, যদিও ক্ষুদ্র ঘেরাটোপ থেকেও মুক্তি মিলল না।

দুর্নীতির প্রসঙ্গেও হাসিনার বক্তব্য একরৈখিক, যদিও আপাত ভাবে স্ট্যাটিস্টিক্স তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষেই যুক্তি দেবে। দুর্নীতিপরায়ণতা বা অপরাধ প্রবণতার খতিয়ানে পুরুষ নারীর চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে। কিন্তু এই প্রবণতা পুরুষের ক্ষেত্রে ও এই প্রবণতার অভাব নারীর ক্ষেত্রে কতটা স্বতস্ফূর্ত, কতটা স্বভাবজ- তা তর্কসাপেক্ষ। লিঙ্গচর্চা আমাদের বলে ‘পুরুষসুলভ’ আর ‘নারীসুলভ’ আচরণের তালিম আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আশৈশব আকৈশোৱ এমন ভাবে চলে যে মেয়েরা ‘ভাল মেয়ে’ হতে ভারি তৎপর থাকে। আর ভালত্বের অন্যতম মাপকাঠি গৃহমুখিতা, ক্যারিয়ার-উদাসীনতা। ফলে দুর্নীতি আর অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সুযোগও যে মেয়েদের কম ঘটে, আর প্রয়োজনও পড়ে কম, তা বলাই বাহুল্য। বিভিন্ন গবেষণায় জেন্ডার ও ক্রাইমের সম্পর্ক খতিয়ে তাই দেখা গেছে, মহিলা অপরাধীরা সংখ্যায় সত্যি কম, একমাত্র প্রস্টিটিউশনেই (যা পৃথিবীর অনেক দেশেই অপরাধ) তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি খানিক বেশি। কিন্তু এ সমীকরণ স্বভাবজ বা জিনগত নয়, তাই তার ব্যতিক্রমও থাকবে, আছে, এবং ভারি মারাত্মক সে সব ব্যতিক্রম। উল্লেখ্য, যে-দেশের কথা বর্তমানে আলোচ্য, সেখানে দুই নারী বিভিন্ন খেপে পর্যায়ক্রমে প্রধানমন্ত্রীর পদটি দখলে রেখেছেন। খালিদা ও হাসিনা উভয়েই রাজনীতির ঘুঁটি সাজিয়েছেন একে অন্যের দুর্নীতিকে ইস্যু করে। আবার ২০০৭-’০৮-এর মিলিটারি শাসনকালে উভয়েই কিন্তু ‘কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট’ দ্বারা অভিযুক্ত হয়েছেন, গ্রেফতার হয়েছেন দুর্নীতিরই অভিযোগে। আয়রন লেডি মার্গারেট থ্যাচার সৌদি আরবের সঙ্গে গোপন অর্থ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন, অভিযোগ আছে। ইন্দিরা গাঁধীর বিরুদ্ধেও ছিল একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ— সত্য-মিথ্যা যাই হোক না কেন। বিরোধীপক্ষ, বিশেষত ইন্দিরা গাঁধীর একটি উক্তিকে নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার করেছিল বারংবার— ‘দুর্নীতি আন্তর্জাতিক, তার অবসান অসম্ভব।’ আবার ২০১০ সালে ভারতীয় কূটনীতিক মাধুরী গুপ্তের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগগুলিও যেন আমরা ভুলে না যাই। ৫৩ বছরের মাধুরী ভারতীয় ফরেন সার্ভিসেস-এর প্রতিনিধি হিসেবে ইসলামাবাদ হাইকমিশনে কর্মরত ছিলেন। অভিযোগ ছিল প্রতিরক্ষার গোপন তথ্যাবলী বেচে দেওয়ার। আর হাড়-হিম-করা অপরাধের কথাই যদি বলা হয়, তবে অধুনা-সাড়া-ফেলে দেওয়া মিডিয়া-সম্রাজ্ঞী ইন্দ্রাণী মুখার্জির ঘটনাটিও স্বাভাবিক ভাবে আসবে। তাঁর উচ্চাকাঙ্খার বলি নাকি তাঁর নিজকন্যা, এমনটাই অভিযোগ।

আরও পড়ুন-পারিবারিক একাত্মতাই কম দুর্নীতিগ্রস্থ করে মেয়েদের

সব ক’টি ক্ষেত্রেই মহিলাদের অপরাধ-প্রবণতার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা, প্রতিপত্তি বা সম্পদের লালসা কাজ করেছে, ঠিক যেমন করে পুরুষ-অপরাধীর ক্ষেত্রে। কিন্তু সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, বলা বাহুল্য, দু’জনের ক্ষেত্রে ভিন্ন। পুরুষটি শুধু অপরাধী, নারীটি ‘মেয়ে হয়েও’ অপরাধী। মেয়েটি দু’টি মাপকাঠিতে ব্যর্থ। সামাজিক নীতির মাপকাঠিতে আর নারীত্বের মাপকাঠিতেও। শেক্সপিয়রের লেডি ম্যাকবেথ কিন্তু নিজের হাতে খুনটুকুও করেননি। শুধু ‘উচ্চাশা পরিপূণার্থে নিজ সন্তানকেও খুন করতে পারি’, এই বাচিক ভায়োলেন্সেই ম্যাকবেথেরও অধিক খল হয়ে উঠেছেন তিনি মহাকবির নাট্যে।

রাষ্ট্রের যত শীঘ্র অপরাধ ও লিঙ্গের সংযোগের এই থিয়োরি থেকে উত্তরণ ঘটে, ততই মঙ্গল— নারীরও, আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসনেরও। অবশ্য প্রতি দেশের নারীমুক্তির ভোরবেলাতেই এই সব দোলাচল থাকে, থাকে রেটোরিকের অসঙ্গতি। সে সবের উর্ধ্বে বাংলাদেশের প্রয়াস ও পরিকল্পনাকে স্বাগত, কারণ তা হয়ে উঠতে পারে বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেনের দেশে লিঙ্গসাম্যের প্রথম ও উল্লেখযোগ্য ধাপ।

(লেখক একটি সরকারি হাইস্কুলের ইংরেজির শিক্ষিকা)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

criminal women indrani mukherjee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE