ছবি: প্রতীকী
অবন্তী-সৌতিকের বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর। প্রথম চার বছর সন্তানের ব্যাপারে কোনও ভাবনাচিন্তা না থাকলেও গত বছর খানেক ধরে ডাক্তারের কাছে যাতায়াত করছেন এই দম্পতি। নিয়মিত নানা ওষুধপত্র খেয়েও অন্তঃসত্ত্বা হতে পারছেন না অবন্তী। সপ্তাহে তিন দিন নাইট ডিউটি করতে হয় তাঁকে। ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছেন, আপাতত কিছু দিন নাইট ডিউট যেন বন্ধ রাখার চেষ্টা করেন তিনি।
একই সমস্যা সম্পূর্ণ অন্য আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে বেড়ে ওঠা কমলার ক্ষেত্রেও। যেখানে কমলার দিদি এবং জায়েরা বিয়ের পরের বছরেই সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, সেখানে বিয়ের পাঁচ বছর পরেও মা হতে পারছেন না কমলা। এক ঠিকাদারের অধীনে কাজ করেন তিনি ও তাঁর স্বামী। বাড়ি তৈরির বিভিন্ন প্রকল্পে ইঁট-সিমেন্ট বহন করেন তাঁরা।
অবন্তী আর কমলা দু’জনের ক্ষেত্রেই সমস্যার উৎসটা একই ধরনের। একজনের সমস্যা নাইট শিফট, অন্য জনের ভারী ওজন তোলা। গত বছরের শেষের দিকে একটি বেসরকারি সংস্থা কলকাতা, দিল্লি ও মুম্বইয়ের মহিলা কর্মীদের একাংশের উপরে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। দিনমজুর থেকে শুরু করে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের কর্মীদের ওই সমীক্ষার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দেখা যায়, যাঁদের ভারী ওজন তুলতে হয় এবং নাইট শিফটে কাজ করতে হয় ঘন ঘন, তাঁদের মধ্যে বন্ধ্যত্বের ঝুঁকি বেশি। একই রকম ভাবে কলকাতার একটি মেডিক্যাল কলেজের নার্সদের উপরে হওয়া প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষাতেও দেখা গিয়েছে, যাঁদের রাতের শিফটে বেশি কাজ করতে হয়, তাঁদের ক্ষেত্রে অবসাদ, খিটখিটে মেজাজ, পারিবারিক সম্পর্কে অবনতির ঘটনা তুলনায় বেশি ঘটে।
প্রশ্নটা সম্প্রতি আরও বেশি উস্কে দিয়েছে আমেরিকার একটি মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র। ‘অকুপেশনাল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল মেডিসিন’-এ প্রকাশিত ওই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, যাঁরা রোটেশনে নাইট ডিউটি করেন কিংবা ভারী ওজন বহনের কাজ করেন, তাঁদের ডিম্বাণু যথেষ্ট দুর্বল। তাই তাঁদের একটা বড় অংশই বন্ধ্যত্বের সমস্যায় ভোগেন।
চিকিৎসকদের একাংশ আবার জানাচ্ছেন, কোনও মহিলা যদি এমন চাকরি করেন, যেখানে তাঁকে সব সময়ই নাউট ডিউটি করতে হয়, তাঁদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা খুব বেশি হয় না। কারণ তাঁর শরীর একটা নির্দিষ্ট রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে যায়। সমস্যাটা দেখা যায় সেই সব মহিলার ক্ষেত্রে, যাঁদের মাসে কয়েক দিন বা সপ্তাহে কয়েক দিন নাইট ডিউটি থাকে ও কিছু দিন ডে ডিউটি থাকে। এই ঘন ঘন ঘুমের সময় পরিবর্তনেই ‘বডি ক্লক’ সম্পূর্ণ ঘেঁটে যায় এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কাজের উপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘লাইফ সায়েন্সে’ বিভাগের প্রধান দেবাশিস সেনের ব্যাখ্যা, ‘‘শিফটের ঘন ঘন পরিবর্তনে শরীরের হরমোন চক্রের স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়। হরমোন চক্র ব্যাহত হলে ডিম্বাণু পরিপক্ক হতেই পারে না অনেক সময়।’’
কর্মক্ষেত্রে ওজন তোলা যাঁদের কাজ, তাঁদের ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট নিয়ম না মানলে শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থির উপরে অত্যাধিক চাপ পড়ে। তাতেও হরমোনচক্র ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায় বলে জানিয়েছেন দেবাশিসবাবু। তাঁর মতে, নারী-পুরুষ সবার ক্ষেত্রেই এমনটা হতে পারে।
আরও পড়ুন:
মদ ছাড়ায় না ডান্ডা, ভোটে গুলাবি গ্যাং
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘মস্তিষ্কে পেনিয়াল গ্ল্যান্ড থাকে। সেটি নিয়ন্ত্রিত হয় দিন ও রাত পরিবর্তনের মাধ্যমে। এটি দিনের বেলা কাজ করে এবং রাতে কাজ করে না। ফলে রাতে এমনিতেই শরীরের সব রকম কাজকর্ম, হার্টরেট, শ্বাস-প্রশ্বাসের হার কমে যায়। তখন যদি জোর করে জেগে কাজ করা হয়, তখনই শরীরের স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট হয়। মহিলাদের উৎপাদন ক্ষমতার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।’’
মল্লিনাথবাবুর আরও ব্যাখ্যা, ওভারি বা ডিম্বাশয়ের কাজ নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থির মাধ্যমে। যখন মস্তিষ্কের পেনিয়াল গ্রন্থির কাজ ব্যাহত হচ্ছে তখন তার প্রভাব পিটুইটারি গ্রন্থির কাজেও পড়ে। চিকিৎসকরা আরও মনে করছেন, মস্তিষ্ক থেকে কর্টিসল বা স্টেরয়েড হরমোনও বার হয়। যখন মানুষ খুব মানসিক-শারীরিক চাপে থাকেন তখন এই হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যায়। একে স্ট্রেস হরমোন বলে। কখনও নাইট, কখনও ডে ডিউটি চলতে থাকলে মহিলাদের স্ট্রেস বা চাপ অত্যন্ত বেড়ে যায়। শরীরে প্রচুর স্টেরয়েড বা ক্ষতিকর বস্তু জমা হয় এবং দেহের সম অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কাজ তাতে ধাক্কা খায়।
বছর দু’য়েক আগে আমেরিকার সাউথঅ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা ১ লক্ষ মহিলার উপরে একটি সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছিলেন, যে সব মহিলা নাইট ডিউটি করেন, তাঁরা গর্ভবতী হওয়ার ক্ষেত্রে অন্য মহিলাদের থেকে ৮০ শতাংশ বেশি সমস্যার সামনে পড়েন। এদের অনিয়মিত পিরিয়ডের হার অন্যদের থেকে ৩৩ শতাংশ বেশি এবং গর্ভপাতের আশঙ্কাও অন্যদের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি। বন্ধ্যত্বের চিকিৎসক রোহিত গুটগুটিয়া জানান, নাইট ডিউটি করা মহিলাদের অনেকের ক্ষেত্রেই সন্তান ধারণে দেরি হয়। কারণ তাঁদের ‘বডি ক্লক’-এ গোলমাল হয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘‘সে ক্ষেত্রে আমরা তাঁদের নাইট শিফট বন্ধ রাখতে বলি। টানা কয়েক মাস নাইট ডিউটি বন্ধ রেখে হাতেনাতে ফল পাওয়ার নজির অজস্র রয়েছে।’’
নারী আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষ মনে করেন, সরকারি স্তরে এ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা দরকার। মহিলাদের স্বাস্থ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই দিকটি সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব সরকারের। নির্দিষ্ট কিছু মাপকাঠি তৈরি করে, সেই সময়টায় মহিলাদের নাইট ডিউটি না দেওয়া বা ভারী জিনিস বহন করার কাজ থেকে অব্যহতি দেওয়ার ব্যবস্থা করাটা জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy