মাত্র তেরো বছর বয়সে কৃষ্ণচন্দ্র দে তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারালেন। জীবনের সব পথ কি থেমে যাবে ওখানে? মা রত্নমালা আবিষ্কার করেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র-র অসম্ভব সংগীতপ্রতিভা, সেই ছোট্ট বয়স থেকেই। ভিক্ষে করতে আসা কীর্তনিয়াদের গান একবার শোনামাত্রই বালক কৃষ্ণচন্দ্র হবহু সে-গান কণ্ঠে তুলে নিতেন। গানের এই প্রতিভাকেই কাজে লাগালেন তাঁর মা। একদিন কৃষ্ণচন্দ্র দে হয়ে উঠলেন একই সঙ্গে ভারতবর্ষের অন্যতম ভার্সেটাইল গায়ক, সুরকার এবং সংগীতব্যক্তিত্ব। এই ঘরানার উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন মান্না দে। সংগীতের এই যে পরম্পরা, তাকে শ্রদ্ধা করেন সমস্ত গুণিজন। তবু বিশেষ করে মনে হয় উস্তাদ আমজাদ আলি খানের কথা। মেহেদি হাসান, গুলাম আলির কথা আগে লিখেছি। আমজাদ আলিও মান্নাদার গানের এক অন্ধ ভক্ত। তিনি সব সময় মান্নাদার পারিবারিক ঐতিহ্যের কথা বলতেন। কৃষ্ণচন্দ্র দে ছাড়াও মান্নাদার পরিবারে ছিলেন আর একজন অসম্ভব প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব—প্রণব দে, মান্নাদার নিজের বড়দা। মান্নাদারা চার ভাই ও এক ‘আদরের’ ছোট বোন। মেজদা প্রকাশচন্দ্র দে ছিলেন নামকরা ডাক্তার। বাকি তিন ভাই প্রকৃত অর্থেই ছিলেন সংগীতের বরপুত্র। বড়দার সাংগীতিক প্রতিভা দেখে নিউ থিয়েটার্সের ম্যানেজার ছোটাই মিত্তির তাঁকে মাসমাইনের সহকারী সংগীত পরিচালকের চাকরি দেন। ভেবে দেখুন তখন কারা কারা কাজ করছেন নিউ থিয়েটার্সে—পঙ্কজ মল্লিক, কৃষ্ণচন্দ্র দে, রাইচাঁদ বড়াল প্রমুখ। সেই সময় প্রণব দে কিছু ছবিতে অসাধারণ সুর সংযোজনা করেন। ছবিগুলি হল—কঙ্কাল, প্রিয় বান্ধবী, সুধার প্রেম, বকুল। ‘প্রিয় বান্ধবী’ ছবিতে প্রণববাবুর তত্ত্বাবধানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় প্লেব্যাক গান। যদিও সেটি ছিল রবীন্দ্রসংগীত—‘পথের শেষ কোথায়’। প্রণববাবুর সুরে বেসিক গান গেয়েছেন সুপ্রীতি ঘোষ, সমরেশ রায়, বিমলভূষণের মতো সেই সময়ের বহু নামকরা শিল্পী। শোনা যায়, যে-শর্ট নোটেশন মান্নাদার একেবারে পেটেন্ট, তার প্রাথমিক শিক্ষালাভ হয়েছিল তাঁর বড়দার কাছেই। প্রণববাবুর সংগীত সাধনা শেষ হয়, যবনিকাই বলব, খুব দুঃখজনক ভাবে। বন্ধ হয়ে গেল নিউথিয়েটার্স। মাসমাইনের চাকরিটাও থাকল না। পুরো সংসার নিয়ে অথৈ জলে। নিরুপায় হয়ে ঢুকলেন চার্টার্ড ব্যাঙ্কের চাকরিতে। চাকরির চাপে গানবাজনা আর তেমন করে জমত না। তবে প্রণববাবুর গানের উত্তরাধিকার বহন করছেন সুদেব দে।
সব থেকে ছোট ভাই প্রভাসচন্দ্রের কথা সবাই জানেন। মান্নাদার পিঠোপিঠি আদরের ‘ভেলু’। খুব সুদর্শন। ফর্সা, লম্বা, টানটান চেহারা। এক সময় ছায়াছবিতে অভিনয় করেছেন। অসম্ভব ভাল গাইতেন। সংগীতশিক্ষক হিসেবে খুবই নাম ছিল। তবে তাঁকে সবাই মান্নাদার বহু বিখ্যাত গানের সুরকার হিসেবেই জানেন। কত সব বিখ্যাত গান—‘ও চাঁদ, সামলে রাখো’, ‘আমার একদিকে শুধু তুমি’, ‘তুমি নিজের মুখেই বললে যেদিন’।
উস্তাদ আমজাদ আলি খানের কথার সূত্র ধরেই মান্নাদার সংগীত ঘরানার কথা বলা। উস্তাদজি গর্ব করে বলেন, ‘‘আমি এবং মান্নাদা দু’জনেই খুব ঐতিহ্যশালী সংগীতের উত্তরাধিকার বহন করছি।’’ কথাটা সত্যিই বলার মতো। আমজাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন আফগানিস্তানের মানুষ। তখন ‘রবাব’ বাদ্যযন্ত্রের খুব প্রচলন। সেই যন্ত্র থেকে তাঁর প্রপিতামহরা আবিষ্কার করেন ‘সরোদ’। তারপর আমজাদের পিতামহ নান্নে খান, পরে বাবা উস্তাদ হাফিজ আলি খান সারা বিশ্বে এই সরোদের মূর্ছনা ছড়িয়ে দেন। আমজাদ আলি খানের পুত্ররা সেই উত্তরাধিকার বহন করে চলেছেন। তিনি যখন তাঁর নিজের পারিবারিক সংগীতের ধারার সঙ্গে কৃতজ্ঞ চিত্তে মান্নাদার পরিবারের তুলনা করেন, তখন সত্যিই ভাল লাগে। আনন্দে বুক ভরে যায়।
উস্তাদজি একটা সুন্দর কথা বলেছিলেন। বড় মানুষের উত্তরাধিকারী হওয়ার একটা বিপদ আছে। সব সময় একটা তুলনা চলে আসে। সে-সমস্যা মান্নাদার ক্ষেত্রেও যে প্রথম প্রথম হয়নি, তা নয়। অনেকেই বলতেন—‘‘কাকার মতো কি ওই পোলা গাইতে পারে? অত সোজা নয়।’’ মান্নাদা কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। উস্তাদ আমজাদ আলি বলছেন, ‘‘কালক্রমে মান্না দে’র পরিচিতিটা কে সি দে-র ভাইপো হিসেবে আর রইল না। কে সি দে-ই পরিচিত হলেন মান্না দে-র কাকা হিসেবে।’’
জি টিভি-র একটি প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান। বিচারক উস্তাদজি এবং মান্নাদা। কাজের ফাঁকে টুকটাক গল্প চলছে দু’জনের। মান্নাদা বললেন, ক’দিন বাদেই কলকাতা যেতে হবে। নতুন গানের রেকর্ডিং। শুনে উস্তাদজি অবাক। মান্নাদার বয়স তখন আশি পেরিয়ে গেছে। এখনও নতুন গান গাইছেন? অবাক হওয়াটা অমূলক নয়। লক্ষ করে দেখবেন, বাংলা তথা ভারতের অনেক নামী গায়ক ৬০ বছর বয়সের মধ্যেই চলে গেছেন। যাঁরা তার বেশি বেঁচেছিলেন, শেষ দিকে তাঁরা আর তেমন গাইতে পারতেন না। আর মান্নাদা প্রায় ৮০ বছর বয়সে ‘আমায় একটু জায়গা দাও’ গানটি গেয়ে দুর্দান্ত হিট করিয়ে দিলেন। ৮৫ বছর বয়সে গাওয়া ‘ভারত তীর্থ’-র সব ক’টি গানও জনপ্রিয়। ৯১ বছর বয়সে প্লেব্যাক করেছেন। ৯৪-তেও স্ত্রী-র স্মরণে নতুন অ্যালবামের কাজ অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কী করে সম্ভব? এই তথ্যটা সারা বিশ্ব জানলে গবেষণা শুরু হয়ে যাবে। আমজাদ ব্যাপারটি যথার্থ অনুধাবন করেছিলেন। তিনি বলছেন,‘‘ মান্নাদার লঘু সংগীত শুনলেও বোঝা যায় ভিতটা তৈরি উচ্চাঙ্গ সংগীতে। এ জন্য সমস্ত শিল্পীর মধ্যে তিনি ব্যতিক্রম। এত বয়স অবধি যে মান্নাদা এত সাবলীল ভাবে গাইছেন, তার পিছনে রয়েছে মান্নাদার আজীবনের সুরসাধনের পরিশ্রম। আধুনিক গানের অন্য শিল্পীদের মধ্যে মান্নাদার মতো এতখানি তালিম বা শিক্ষা ছিল না বলে অনেক আগেই তাদের থেমে যেতে হয়েছিল। কিন্তু মান্নাদার সংগীত-জীবনের ব্যাপ্তিই ছিল ৭১ বছর।
মান্নাদা এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটা গল্প বলি। সুরকার মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে একবার বলেছিলেন, ‘‘শোনো মৃণাল, যে সুরটা তোমার নিজের খুব পছন্দ, প্রযোজক-পরিচালককে সেটি প্রথমেই শুনিয়ে দিয়ো না। ওরা ভাববে সুরকার একদমই খাটেনি। মাত্র একটা সুরই করেছে। আগে তুমি যত রকম পারো নানা সুর শুনিয়ে যাও। পছন্দেরটা শেষ দিকে রাখো।’’ হেমন্তবাবুর রেকর্ডিঙের স্টাইলটা ছিল একদম অন্য রকম। সে সময় তিনি পেশাগত আত্মবিশ্বাসের শিখরে। এমনও হয়েছে, হেমন্তবাবু রেকর্ডিং করতে এসেছেন। একবারেই গানটা ‘টেক’ করলেন। কী গাইলেন শুনতেও চাইলেন না। অন্য কাজে চলে গেলেন। যদি কোথাও এতটুকু গণ্ডগোল থাকে, সবাইকে একসাথে জড়ো করা তো মারাত্মক ঝকমারি। চিন্তাই সার। হেমন্তবাবু চলে গেছেন, আর ভুল ধরা পড়েছে, এমনটি কখনও হয়নি। একবার হেমন্তবাবুর সুরে মান্নাদা গাইছেন। ছবির নাম ‘শুকসারি’। মান্নাদা স্বভাবসিদ্ধ ভাবে নিজের প্রস্তুতি নিয়েছেন। গানটির নোটেশন করা, ভাল করে সুরটা বসানো। একটা ‘টেক’ হল। হেমন্তবাবু বললেন, ‘ওকে’। মান্নাদা আঁতকে উঠে বললেন, ‘‘‘ওকে’ কী বলছেন? আমার গলাই তো এখনও গরম হয়নি। কয়েক বার গাই গানটা।’’ হেমন্তবাবু মৃদু হেসে বললেন, ‘‘সে আপনি যত বার খুশি গাইতে পারেন, আমার কিন্তু এই প্রথম ‘টেক’টা পছন্দ হয়েছে।’’ মান্নাদা রাজি হলেন না। বেশ কয়েক বার গানটি গাইলেন। নানা ভাবে ইমপ্রোভাইজ করলেন।
সবাই মিলে সবক’টি ‘টেক’ শুনলেন। শেষ পর্যন্ত মান্নাদাও হেমন্তবাবুর মতো প্রথম ‘টেক’টাই পছন্দ করলেন। কোন গানটি জানেন? ‘সখী চন্দ্রবদনী’— মান্নাদার চিরদিনের প্রিয় একটি গান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy