Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সুর আর কথা পছন্দ হলেই গান গাইতেন

নামে সঙ্গীত পরিচালক, বড় ব্যানার, এ সব কোনও দিন তোয়াক্কা করেননি মান্না দে। লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীনামে সঙ্গীত পরিচালক, বড় ব্যানার, এ সব কোনও দিন তোয়াক্কা করেননি মান্না দে। লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:৩৬
Share: Save:

পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেক গীতিকার মান্নাদে-র গান লেখার সুযোগ পায়নি। এমনটাই প্রচলিত ধারণা। লজিক্যালি ভাবলে ভাবনাটা কিন্তু অন্য রকম হতে বাধ্য। পুলকবাবু-মান্নাদার জুটি অসাধারণ গান উপহার দিচ্ছে—পুলকবাবুর কথায় মান্নাদা সোনা ফলাচ্ছেন প্রতিটি গানে। কোন গীতিকার আর চাইবেন তাঁর জায়গাটা ছেড়ে দিতে। কিন্তু মান্নাদা ছিলেন জহুরি গায়ক। সিনেমার গানের ক্ষেত্রে গায়কের কাছে খুব একটা সুযোগ থাকে না গীতিকার বা সুরকার সিলেকশনের। কিন্তু বেসিক গানের ক্ষেত্রে সে সুযোগটা থাকে। ভেবে দেখুন স্বয়ং পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা মান্নাদা যখন গাইবার জন্য সিলেকশন করেন তখন দু’জনের আলাপও হয়নি।

পুলকবাবুর লেখা দুটি গান পেয়েছিলেন এইচএমভি-র মারফত— দু’জনের যাত্রা শুরু হল ১৯৬০ সালে অসাধারণ এই দুটি গান দিয়ে—‘আমার না যদি থাকে সুর’ আর ‘জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই’। শ্যামল গুপ্তের ক্ষেত্রেও ঘটনাটা প্রায় একই রকম। ১৯৫৭ সালে নিজের সুরে শ্যামল গুপ্তের কথায় মান্নাদা গাইলেন সেই অসাধারণ গান ‘আমি আজ আকাশের মতো একেলা/বাদল মেঘের ভাবনায়/বাদলের এই রাত ঘিরেছে ব্যথায়’। ঘটনা হল এই গান মান্নাদা যখন পছন্দ করেন তখন দু’জনের আলাপও ছিল না। শ্যামলবাবু গ্রামোফোন কোম্পানিতে কয়েকটি গান পাঠিয়েছিলেন— সেখান থেকে গানগুলি হাতে পেয়ে এই গানটা মান্নাদার খুব পছন্দ হয়। এর পরে দু’ বছর বাদে মান্নাদা শ্যামলবাবুর কথায়, নিজের সুরে যে দুটি গান গেয়েছিলেন, সেই কথাগুলোও পেয়েছিলেন গ্রামোফোন কোম্পানির কাছ থেকে। ভেবে দেখুন মান্নাদা তখন খ্যাতির মধ্য গগনে। গানের কথাই তাঁর কাছে অগ্রাধিকার পেয়েছিল—গীতিকার ভদ্রলোক কতটা নামী-দামি, আগে কী কী কাজ করেছেন, এ সব নিয়ে মান্নাদা ভাবেনইনি। যদি ভাবতেন, তবে আমরা কি পেতাম শ্যামল গুপ্তের কথায় সেই চিরদিনের গান— ‘ও আমার মন-যমুনার অঙ্গে অঙ্গে’ বা ‘আমি নিরালায় বসে’।

এর পরের পরিস্থিতিটা কি? সেই যে ’৬০ সাল থেকে পুলকবাবুর সঙ্গে যাত্রা শুরু হল—অপ্রতিহত গতিতে তা এগিয়ে চলল। সঙ্গে গৌরীপ্রসন্ন-শ্যামল গুপ্ত। এক একটা কালজয়ী গান সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু অন্য গীতিকাররাও কি সুযোগ পাননি? যখনই মান্নাদা ভাল লেখা পেয়েছেন, সেই গান গাইতে কোনও দ্বিধাবোধ করেননি। কারও কথায় কান দেননি। মান্নাদাই একমাত্র শিল্পী যিনি বহু অনামী গীতিকারের লেখা গান গেয়ে সে গান অমর করে দিয়েছেন। সেই সব অসংখ্য গানের মধ্যে কিছু গানে আমরা চোখ বুলিয়েনি—এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি (বঙ্কিম ঘোষ), খেলা ফুটবল খেলা (সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়), সবাই তো সুখী হতে চায় (জহর মজুমদার), এই রাত না যদি শেষ হয় (পার্থসারথি ভট্টাচার্য), এই আছি বেশ (দীপঙ্কর ঘোষ), লাল জবাকেও লজ্জা দিয়েছে (বটকৃষ্ণ দে), গভীর হয়েছে রাত (বরুণ ঘটক), তুমি তো আমাকে বুঝলে না (জ্যোতিপ্রকাশ), স্বপ্নের কফি হাউস (শমীন্দ্র রায়চৌধুরী)...এমন আরও বহু গান। লেখা ভাল হলে মান্নাদা সে লেখা সাদরে গ্রহণ করেছেন।

এ প্রসঙ্গে মুক্তি রায়চৌধুরীর কথা একটু আলাদা ভাবে বলি। তাঁর কথায় মান্নাদা বেশ কিছু গান গেয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি গানের কথা বলা যায়, যে গান অন্তত হাজার বছর ধরে মানুষের ভাল লাগায় সমান ভাবে থাকবে— ‘খুব জানতে ইচ্ছে করে, তুমি কি আর আগের মতো আছো?’ মান্নাদার মনটা যদি আকাশের মতো বিস্তৃত না হত, এ গান আমরা কোনও দিনই পেতাম না। মান্নাদা বর্ধমানের কুলটিতে গিয়েছিলেন গান গাইতে। বার্নপুর থেকে স্কুল শিক্ষিকা মুক্তিদি মান্নাদার গান শুনতে এসেছিলেন। মান্নাদা তখন সঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে সব থেকে বড় কিংবদন্তী। যা হয় হবে, এই ভেবে মুক্তিদি অনুষ্ঠানের আগে বহু কষ্টে দেখা করলেন মান্নাদার সঙ্গে। সঙ্গে ছিল নিজের লেখা কিছু গান— খুব ইচ্ছে সে গান যদি মান্নাদা গান। মান্নাদা বললেন, সে তো সম্ভব নয়, আমি থাকি বম্বেতে, যোগাযোগটাই হওয়া অসম্ভব। আপনি এ গানগুলো অন্য শিল্পীকে দিন।’ মুক্তিদি ম্লান মুখে বললেন, ‘আপনার কথা ভেবেই গানগুলি লিখেছিলাম। অন্য কাউকে এই লেখা আমি দিতে পারব না।’ মান্নাদা সব মহিলাকেই মায়ের মতো শ্রদ্ধা করেন, আর শিক্ষিকা হলে তো কথাই নেই। মান্নাদা বললেন গানগুলো মুম্বাইয়ের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে। এর পরে ঘটল এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। কয়েক দিন বাদেই মান্নাদার উত্তর এল—গানের কথা আমার পছন্দ হয়েছে, এ গান আমি গাইব। ১৯৮৫। নিজের সুরে (সুরকার হিসেবে অন্য কারও নাম আছে) মান্নাদা গাইলেন—‘খুব জানতে ইচ্ছে করে।’ গায়কটি যে মান্নাদা—যিনি গানের মণি-মুক্তো খুঁজে নিতে জানতেন।

এ বার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। মান্নাদার সঙ্গীতানুষ্ঠানের কথা। গানের অনুষ্ঠান ছিল মান্নাদার প্রাণ। শরীরকে কতটা বশে রাখলে এবং গান গাইবার কতটা ইচ্ছে থাকলে একানব্বই বছর বয়সেও প্রবল উৎসাহে দেশ-বিদেশে অনুষ্ঠান করা যায়, মান্নাদাই তার একমাত্র উদাহরণ। আর কেউ নেই। মান্নাদার প্রতিটি অনুষ্ঠানই ছিল বর্ণময়। অল্প অথচ কিছু মূল্যবান প্রাসঙ্গিক কথা, সঙ্গে একের পর এক সব ভোলানো গান। মানুষ তো মান্নাদার ডুয়েট গানগুলোও শুনতে চায়। লতা-আশা-আরতির সঙ্গে মান্নাদা গেয়েছেন কত কালজয়ী গান। মান্নাদা একজন ভাল ফিমেল সিংগার খুঁজছেন, যিনি মান্নাদার সঙ্গে বিখ্যাত সব ডুয়েট গানের ফিমেল অংশটি গাইবে। মান্নাদার বহু দিনের তবলা-বাদক দীপঙ্কর আচার্য খোঁজ দিলেন তনিকার— তনিকা ভট্টাচার্য। যাদবপুর থেকে ফিলজফিতে ডক্টরেট, নামী কলেজের অধ্যাপিকা, গানটাও বেশ ভাল করে। ভাবলেও অবাক লাগে, মান্নাদার মতো অত বড় শিল্পী, অথচ তাঁর তুলনায় অনেক জুনিয়র একজন শিল্পীকে কত সম্মানের সঙ্গে ইন্ট্রোডিউস করলেন। তনিকাকে বললেন, ‘আমাদের অনুষ্ঠানটি আপনিই (পরে অবশ্য সম্বোধনটা ‘তুমি’ হয়ে যায়) শুরু করুন।’ গানটিও বলে দিলেন—‘আমি খাতার পাতায় চেয়েছিলাম একটি তোমার সইগো’। দুর্গাপুরে সৃজনীতে অনুষ্ঠান। দর্শকদের বললেন, ‘ইনি একজন অধ্যাপিকা, গানটিও খুব সুন্দর করে, দয়া করে আপনারা শুনুন।’ ভাবা যায়! কে বলছেন কথাগুলো?

ভারতবর্ষের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী মান্না দে। একজন নবীন শিল্পীর জন্য। অনুষ্ঠানের ক’দিন পরে ঘটল আর একটা মনে রাখার মতো ঘটনা। মান্নাদা কারও কাছ থেকে খবর পেলেন আয়োজকরা তনিকাকে কোনও পারিশ্রমিক দেয়নি। এ কি করে হয়! দীপঙ্কর আচার্যের হাত দিয়ে মান্নাদা তনিকাকে যাথাযোগ্য পারিশ্রমিক পাঠিয়ে দিলেন। এর পরে নেতাজি ইন্ডোরে কোল ইন্ডিয়ার অনুষ্ঠান। মান্নাদা ঠিক মনে রেখেছেন। দীপঙ্করকে বললেন—‘তনিকাকে খবর দাও, আমার সঙ্গে গাইতে হবে।’ ভারতবর্ষের সম্ভবত মান্নাদার শেষ অনুষ্ঠান। ১ মে, ২০১০। মান্নাদার জন্মদিনে। এর পরে জীবনের শেষ অনুষ্ঠান করেন সিঙ্গাপুরে। ১ মে-র সেই অনুষ্ঠান অনেকের স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে।

ম্যাডামের শরীর তখন এত খারাপ মান্নাদা বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন আর কলকাতায় আসা হবে না। একদিন বেঙ্গালুরু থেকে ফোন এল অনুষ্ঠানের আগে। তনিকাকে বললেন—‘আমার সঙ্গে ডুয়েট তুমি তো গাইবেই। তুমি একা একটা গান গেও।’ তনিকা মনের উত্তেজনা চেপে জিজ্ঞেস করল— ‘কোন গান?’ মান্নাদা বললেন—‘পুলকের কথায় আমার সুরে প্রতিমা গেয়েছিল গানটা—‘চোখের সামনে ধরো পঞ্চমী চাঁদ, সূর্যকে মেলে ধরো না, আমায় অন্ধ কোরো না।’ একটু কঠিন, কিন্তু খুবই সুন্দর গান। এ গান তুমিই গাইতে পারবে।’ শিষ্য অনেক ভাবে গুরুদক্ষিণা দেয়। শিষ্যকে এমন আশীর্বাদ মান্নাদা ছাড়া আর কে করতে পারে!

এই অধমও মান্নাদার আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়নি। মৃণালদার (সুরকার মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়) সঙ্গে প্রথম যখন মান্নাদার বাড়িতে যাই, একবারের জন্যও জিজ্ঞাসা করেননি, আগে কার জন্য গান লিখেছি, কী ব্যাকগ্রাউন্ড। তাঁর আগ্রহ ছিল অন্য বিষয়ে। প্রাথমিক কথাবার্তার পরে বলেছিলেন— ‘কী গান লিখেছেন, একটু পড়ি।’

গানের কথা, গানের সুর—এটুকুই ছিল মান্নাদার বিবেচ্য। অন্য কিছু নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE