Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

অবস্থান বদলে স্থলসীমান্ত চুক্তির পাশে দাঁড়াল তৃণমূল

তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্যে জড়িয়ে রয়েছে বিখ্যাত বসু পরিবার। কিন্তু তাঁর মধ্যে যে কোনও বিপ্লবের বীজ রয়েছে এ কথা কেউ কস্মিন কালেও বলবে না! সেই তিনি, তৃণমূল সাংসদ সুগত বসু, আজ বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তির প্রশ্নে আগেকার দলীয় লাইনের কার্যত উল্টো পথে গিয়ে বিদেশ মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির রিপোর্টটিতে সিলমোহর লাগালেন।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:২৮
Share: Save:

তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্যে জড়িয়ে রয়েছে বিখ্যাত বসু পরিবার। কিন্তু তাঁর মধ্যে যে কোনও বিপ্লবের বীজ রয়েছে এ কথা কেউ কস্মিন কালেও বলবে না! সেই তিনি, তৃণমূল সাংসদ সুগত বসু, আজ বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তির প্রশ্নে আগেকার দলীয় লাইনের কার্যত উল্টো পথে গিয়ে বিদেশ মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির রিপোর্টটিতে সিলমোহর লাগালেন।

তৃণমূল সদস্যের এই ছাড়ের ফলে আজ স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সর্বসম্মতিতে পাশ হল স্থলসীমান্ত চুক্তি বিলটি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সংসদের শীতকালীন অধিবেশনেই তিনি সীমান্ত-বদল সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনী বিলটি পাশ করাতে চান। শশী তারুরের নেতৃত্বাধীন এই স্থায়ী কমিটি বিলের খসড়াটি মসৃণ ভাবে পাশ করিয়ে দেওয়ায় সে আশা যে অনেকটাই উজ্জ্বল হল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

প্রশ্ন, হঠাৎ এমন একটি কাণ্ড ঘটালেন কী করে সুগতবাবু? এটা কি যাদবপুরের সাংসদের বিপ্লব, না অবস্থান বদলালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? কিন্তু তাঁর এই বদল সুগত বসু জানলেন, আর দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা মুকুল রায় জানলেন না? না হলে আজও কেন মুকুল বলবেন, “এর সঙ্গে রাজ্যের হাজার হাজার মানুষের স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে। ফলে ভাল করে খতিয়ে দেখে, পুনর্বাসনের ব্যবস্থাটি ভাল করে বুঝে দেখে, তার পর রাজ্য সরকার এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। এ জন্য সময় লাগবে।” গত সপ্তাহেই দিল্লিতে বসে মমতাও বলেছিলেন, “সংসদীয় স্থায়ী কমিটি স্থির করবে না, ছিটমহল হস্তান্তর কী ভাবে এবং কবে হবে। পুনর্বাসন প্যাকেজ কী হবে তা স্থির না-করেই, তাড়াহুড়ো করে আমি কোনও সিদ্ধান্ত নিতে চাই না।” কিন্তু সূত্রের খবর, তৃণমূলের সংশয়কে মর্যাদা দিয়েই এ বার বিলের খসড়ায় রাখা হয়েছে, রাজ্য সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখেই ছিটমহল হস্তান্তর ও পুনর্বাসনের সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে।

তবে পুনর্বাসনের বিষয়টি যে সমস্যা হবে না, তৃণমূল নেত্রী তা বিলক্ষণ জানেন। কোচবিহারের তৃণমূল নেতা রবীন্দ্রনাথ ঘোষ নিয়মিত ছিটমহলের মানুষ জনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। ছিটমহলবাসীই যে সরে আসতে ইচ্ছুক পরিবারগুলির বসবাসের জন্য পর্যাপ্ত জমির বন্দোবস্ত করতে এগিয়ে এসেছে, তা তিনি দলীয় নেতৃত্বকে জানিয়েছেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অফিসাররা বৈঠকে বসে অনেক আগেই রাজ্য সরকারকে জানিয়ে গিয়েছেন, পুনর্বাসনের সমস্ত ব্যয়ভার তাঁরাই নেবেন। আসলে তার পরেই অবস্থান বদলাতে শুরু করেছিলেন মমতা।

লোকসভা নির্বাচনের আগে মমতা কোচবিহারে গিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, তিনি ছিটমহল বিনিময়ের পক্ষে। কী ভাবে তা হবে, তা নিয়ে শুধু কেন্দ্রের সঙ্গে তিনি ভিন্নমত। বস্তুত তার পর থেকেই আশার আলো দেখছিলেন ছিটমহলবাসী। সম্প্রতি বেশ কয়েক বার তাঁর কথায় ছিটমহলবাসীর নাগরিকত্বহীনতা, তাঁদের দুঃখ-কষ্টের কথা উঠে আসছিল। মাস দেড়েক আগে কলকাতায় বাংলাদেশের বিদায়ী ডেপুটি হাইকমিশনার আবিদা ইসলামের সঙ্গে আলোচনায় ও অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে আসা সংসদীয় প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকেও তিনি নিজে এ বিষয়টির অবতারণা করেন।

সঙ্গে আরও একটি বিষয়ও রয়েছে। আগের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে ঢাকা সফর শেষ মুহূর্তে বাতিল করায় তিস্তা চুক্তির পাশাপাশি এই স্থলসীমান্ত চুক্তিটিও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। এর ফলে পড়শি দেশে তাঁর ভাবমূর্তি ভীষণই খারাপ হয়ে পড়ে। ২ অক্টোবর খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পরে আবার আরও বড় অভিযোগ উঠেছে মমতার দল ও সরকারের বিরুদ্ধে। তা হল বাংলাদেশের সরকার-বিরোধী মৌলবাদী দল জামাতে ইসলামির সঙ্গে দহরম-মহরম। অভিযোগ উঠেছে, তৃণমূলের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই পশ্চিমবঙ্গে জাল ছড়িয়েছে জঙ্গিরা, যাদের লক্ষ্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করা। এই পরিস্থিতিতে শনিবার বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের কাছে আকুল আর্তি জানিয়েছিলেন মমতা আমাকে ভুল বুঝবেন না! তিনি বলেছিলেন, “আমি আবার বাংলাদেশে যেতে চাই। ও দেশে আমারও। আমি ঢাকায় গিয়ে রংচঙে রিক্সা চড়ে বেড়াতে চাই!” সুতরাং অবস্থান বদলাচ্ছিলই।

গত মাসে এই স্থায়ী কমিটির বৈঠকেই কিন্তু সুগত বসু ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, পুনর্বাসনের বিষয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে এগোলে ছিটমহল বিনিময়ে আপত্তি জানাবে না তাঁর দল। সেই ইঙ্গিতও অবশ্যই ছিল অবস্থান পরিবর্তনের। আসলে মমতাও চাইছেন ছিটমহলের হাজার হাজার মানুষের এই মনুষ্যেতর জীবনের এ বার সমাপ্তি হোক। ঢাকার সাংসদদের তাই তিনি বলেছেন, “৬৫ বছর ধরে কী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন ছিটমহলের হাজার হাজার মানুষ। রোগ হলে ডাক্তার-হাসপাতাল নেই, লেখাপড়ার স্কুল নেই। সাধারণ নাগরিক অধিকারটুকুও নেই। আমি চাই শীঘ্রই এর একটা বিহিত হোক।”

আজ স্থায়ী কমিটির বৈঠকে স্থলসীমা বিলটিকে তৃণমূল সাংসদ সুগত বসুর শর্তাধীন সমর্থন তাই মমতার একেবারে হঠাৎ কোনও অবস্থান বদল নয়, বরং আস্তে আস্তে যে মনোভাব বদল হচ্ছিল, হতে পারে তার প্রথম প্রকাশ।

এ দিকে ছিটমহল বিনিময় হলে সেখানকার বাসিন্দা কত পরিবার ঠিকানা বদল করতে আগ্রহী, তা জানতে সমীক্ষায় নামছে ‘ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহাল বিনিময় সমন্বয় কমিটি’। কমিটি সূত্রেই জানা গিয়েছে, চলতি নভেম্বর মাসের ২৭ তারিখ থেকে দু’দিনের ওই সমীক্ষা চলবে।

প্রাথমিক প্রস্তুতি ইতিমধ্যে সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশ ভূখণ্ড ঘেরা ভারতের ১১১টি ছিটমহলের সমীক্ষার জন্য ইতিমধ্যে শতাধিক সদস্য নিয়ে ২৬টি সমীক্ষক কমিটি তৈরি করা হয়েছে। অন্য দিকে ভারত ভূখণ্ড ঘেরা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের সমীক্ষার কাজ করবে ৫টি দল। ছিটমহলগুলির পাড়ায় পাড়ায় ঢুকে প্রাথমিক ভাবে পরিবারের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে মতামত নথিভূক্ত করা হবে। পাশাপাশি প্রতিটি ছিটমহলে কেন্দ্রীয় ভাবে শিবির করে ঠিকানা বদলে আগ্রহীদের নাম নথিভুক্ত করার ব্যবস্থাও থাকছে। কমিটির সহকারি সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, “রাজ্যসভায় শীতকালীন অধিবেশনে স্থলসীমান্ত চুক্তি বিল অনুমোদনের মাধ্যমে ছিটমহল বিনিময়ের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সম্ভবনা উজ্জ্বল হয়েছে। সে ক্ষেত্রে দু’দেশের ছিটমহলের বাসিন্দা কত পরিবার বা কত সংখ্যক মানুষ নিজেদের ঠিকানা বদলাতে চান, তা নিয়ে স্পষ্ট চিত্র পেতে চাইছি। এতে ছিটমহল বিনিময়ের সময়ে পুনর্বাসন সংক্রান্ত জটিলতা এড়ানো যাবে।”

কমিটির কয়েক জন কর্তা জানিয়েছেন, ২০১৩ সালে কমিটির মাধ্যমে প্রথম বার দু’দেশের ছিটমহলে ওই ব্যাপারে সমীক্ষা করা হয়। তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশ ভূখণ্ড ঘেরা ভারতের ছিটমহলগুলি থেকে ১৪৯টি পরিবারের ৭৪৩ জন বাসিন্দা ঠিকানা বদল করে ভারতের মূল ভূখণ্ডে বসবাস করতে আগ্রহী। তবে বাংলাদেশের ছিটমহলগুলির বাসিন্দাদের কেউ নিজেদের ঠিকানা বদলে সে দেশের ভূখন্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে চাননি। দুই বছরে পরিস্থিতি অনেকটা বদলেছে। তাই নতুন পরিস্থিতিতে নতুন করে আবার সমীক্ষা করে বাসিন্দাদের মনোভাব জানতে চাওয়া হচ্ছে।

তবে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে তৃণমূল এই বিলকে ছাড়পত্র দেওয়ায় নতুন আশায় বুক বাঁধছেন ছিটমহলবাসী। মঙ্গলবার রাতে এ খবর পৌঁছনো মাত্র শাঁখ বাজিয়ে তাকে স্বাগত জানানো হয়েছে। মিষ্টিও বিলি হয়েছে কোচবিহার সংলগ্ন ছিটমহলগুলিতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE