Advertisement
০৫ মে ২০২৪
দেশ জুড়ে বিক্ষোভ বাম, কংগ্রেসের

ঋণের ফাঁদে না পড়তেই ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত

ভাড়া বাড়ানোর কঠিন সিদ্ধান্ত না-নিলে রেলকে বাঁচানো সম্ভব নয়। নরেন্দ্র মোদী সরকারের প্রথম কড়া দাওয়াইয়ের পরে দেশ জুড়ে বিরোধীদের সমালোচনা এবং বিক্ষোভ আজ এ ভাবেই উড়িয়ে দিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। তাঁর মতে, রেলে যাত্রিভাড়া এবং মাসুল বৃদ্ধি করাটা কঠিন, কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৪ ০২:৫১
Share: Save:

ভাড়া বাড়ানোর কঠিন সিদ্ধান্ত না-নিলে রেলকে বাঁচানো সম্ভব নয়। নরেন্দ্র মোদী সরকারের প্রথম কড়া দাওয়াইয়ের পরে দেশ জুড়ে বিরোধীদের সমালোচনা এবং বিক্ষোভ আজ এ ভাবেই উড়িয়ে দিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। তাঁর মতে, রেলে যাত্রিভাড়া এবং মাসুল বৃদ্ধি করাটা কঠিন, কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত।

জেটলির যুক্তি, দীর্ঘ এক দশকের বেশি ভাড়া না-বাড়ানোর ফলে রেলের কাঁধে ঋণের বোঝা ভারী হয়েছে। এই অবস্থায় সরকারের সামনে দু’টি পথ খোলা ছিল। একটি জনমোহিনী পথে হেঁটে রেলকে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়তে দেওয়া। অন্যটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে রেলকে বাঁচানো। গত কাল সেই কঠিন সিদ্ধান্তই নিয়েছেন রেলমন্ত্রী সদানন্দ গৌড়া। এক ধাক্কায় যাত্রিভাড়া বেড়েছে ১৪.২ শতাংশ এবং পণ্য মাসুল বেড়েছে ৬.৫ শতাংশ।

বিরোধীরা অবশ্য সরকারের যুক্তিতে সন্তুষ্ট নয়। কাল থেকেই মোদী সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় সরব হয়েছে কংগ্রেস। দলের সাধারণ সম্পাদক দিগ্বিজয় সিংহ টুইট করেন, ‘অব কী বার, ডবল স্পিক সরকার। অচ্ছে দিন আ গয়ে!’ আর আজ দিল্লির জনকপুরী এলাকায় প্রদেশ সভাপতি অরবিন্দ সিংহ লাভলির নেতৃত্বে পথ অবরোধ করেন কংগ্রেস সমর্থকেরা। পরিস্থিতি সামলাতে জল কামান চালাতে হয় পুলিশকে। অবিলম্বে ভাড়া বাড়ার সিদ্ধান্ত ফিরিয়ে নেওয়া না হলে রেল রোকোর হুমকি দিয়েছেন লাভলি। মহারাষ্ট্রের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি মানিকরাও ঠাকরে বলেছেন, সরকার সিদ্ধান্ত না পাল্টালে রাজ্যের কংগ্রেস কর্মীরা কাল, সোমবার বিনা টিকিটে লোকাল ট্রেনে চাপবেন।

কংগ্রেসের এই প্রতিবাদ ভোঁতা করার লক্ষ্যে জেটলি আজ ভাড়া বৃদ্ধির দায় পরোক্ষ ভাবে আগের ইউপিএ সরকারের উপরেই চাপান। ফেসবুকে ‘রেল ভাড়া বৃদ্ধির পিছনে সত্যি কথা’ শীর্ষক পোস্টে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী লিখেছেন, ‘রেল বোর্ড ৫ ফেব্রুয়ারিই যাত্রিভাড়া ও পণ্যমাসুল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কেন্দ্রে তখন ইউপিএ। বোর্ড ঠিক করেছিল, যাত্রিভাড়া ১০% এবং পণ্যমাসুল ৫% বাড়ানো হবে। মনে রাখতে হবে, যখন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখনও অন্তর্বর্তী রেল বাজেট পেশ করা হয়নি। রেল বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, পণ্যমাসুল বাড়বে ১ এপ্রিল এবং ভাড়া বাড়বে ১ মে থেকে। ১ মে তারিখটা ধার্য হয়েছিল এই কারণে যে, মনে করা হয়েছিল তত দিন লোকসভা ভোট শেষ হয়ে যাবে।’

জেটলি জানিয়েছেন, এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে চলতি বছরে অতিরিক্ত ৭৯০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হবে বলে হিসেব করেছিল রেল। কিন্তু ১১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেলমন্ত্রী মল্লিকার্জুন খাড়্গে সেই প্রস্তাব নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে দেখা করলে তিনি ভাড়া ও মাসুল ১ মে থেকে বাড়ানোর কথা বলেন।

কিন্তু ১ মে লোকসভা ভোট শেষ হয়নি। তাই ১৬ মে ভোটগণনার দিন সন্ধ্যাতেই রেল বোর্ডের তরফে ভাড়া ও মাসুল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। তা নিয়ে অবশ্য তৈরি হয় বিতর্কও। সে দিন রাতেই খাড়্গে রেল বোর্ডকে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়ে বলেন, নতুন সরকারই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। সুতরাং সদানন্দ গৌড়া ভাড়াবৃদ্ধিতে ছাড়পত্র দিলেও আদতে সিদ্ধান্তটা কংগ্রেস আমলেই নেওয়া যুক্তি জেটলির।

তবে রাজনৈতিক আক্রমণ থেকে গা বাঁচাতে এমন কৌশল নিলেও ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে তাঁর যে আপত্তিই নেই, সে কথা আজ স্পষ্ট করে দেন জেটলি। তাঁর কথায়, গত কয়েক বছর ধরে রেল একটানা লোকসান করেছে। যাত্রীরা বাড়তি অর্থ না-গুনলে রেলকে বাঁচানো কঠিন।” বস্তুত, সেই বাজপেয়ীর আমল থেকেই রেল মন্ত্রকের ভার শরিক দলের হাতে থাকা এবং তাদের জনমোহিনী রাজনীতির কারণে এক দশকের বেশি সময় ধরে ভাড়া বাড়েনি। বাজপেয়ীর আমলেই শেষ বার ভাড়া বাড়িয়েছিলেন নীতীশ কুমার। তার পর লালুপ্রসাদ যাদব বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেউই ভাড়া বাড়াননি, রেল কর্তাদের অনুরোধ সত্ত্বেও। মমতা রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে আসার পরে রেলমন্ত্রীর গদিতে বসা দীনেশ ত্রিবেদী ভাড়া বাড়িয়ে নেত্রীর কোপে পড়েন। তাঁকে সরিয়ে নয়া মন্ত্রী হন মুকুল রায়। তিনি গোড়াতেই ফিরিয়ে নেন ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত।

তৃণমূল ইউপিএ ছাড়ার পরে কংগ্রেস রেল মন্ত্রকের দায়িত্ব নিয়ে অবশেষে ভাড়া বাড়ায়। কিন্তু এখনও রেলের প্রতিদিনের লোকসান ৩০ কোটি টাকা। যাত্রী পরিবহণ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকায়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যাত্রিভাড়া বাড়ানো হলে ওই অর্থের বড় অংশ পরিকাঠামো উন্নয়নে কাজে লাগানো যেত।

এখানেই শেষ নয়, জনমোহিনী রাজনীতির চাপে একের পর এক প্রকল্প ঘোষণা করে গিয়েছেন রেলমন্ত্রীরা। অনেক সময় কোনও রকম সমীক্ষা না-করে, রেল বোর্ডের ছাড়পত্র না-নিয়েই প্রকল্প ঘোষণার অভিযোগ উঠেছে বারবার। একটি সমীক্ষা বলছে, ঘোষিত প্রকল্প শেষ করতে এখন রেল মন্ত্রকের প্রয়োজন প্রায় সাড়ে চার লক্ষ কোটি টাকা। আয় ও ব্যয়ের ওই বিপুল ঘাটতি কী ভাবে মেলানো সম্ভব হবে, তার সদুত্তর কোনও রেলকর্তার কাছেই নেই।

বর্তমানে পণ্য ও যাত্রিভাড়া বাবদ রেলের মোট যে আয় হয় তার ৭০-৭২ শতাংশ চলে যায় বেতন ও পেনশন দিতে। মন্ত্রকের বক্তব্য, এই খাতে ব্যয় প্রতি বছরই বাড়ছে। শুধু ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করতেই প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে রেলের। ফলে সুরক্ষা, রক্ষণাবেক্ষণ ও বিশেষ করে পরিষেবার দিকটি দীর্ঘ সময় ধরে অবহেলার শিকার। পরিষেবা নিয়ে যাত্রীদের অভিযোগ যেমন বাড়ছে। তেমনই পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাড়ছে ছোট-বড় দুর্ঘটনাও। সেই পরিপ্রেক্ষিতে জেটলি আজ বলেছেন, “দেশবাসীকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তাঁরা জরাজীর্ণ রেল চান, না বিশ্বমানের পরিষেবা।”

কিন্তু ভাড়া বৃদ্ধির পিছনে যুক্তি যা-ই থাক, রাজনীতির টানে বিরোধীরা যে এর সমালোচনা করবেন, সেটা প্রত্যাশিতই। সেই অঙ্কেই কংগ্রেসের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজ্যে আজ পথে নেমেছে সমাজবাদী পার্টি, আরজেডি, ডিএমকে ও বাম দলগুলি। লখনউতে বিজেপি দফতরের সামনে ধর্নায় বসেন সপা সমর্থকেরা। দু’পক্ষের হাতাহাতিও হয়। পরিস্থিতি সামলাতে লাঠি চালাতে হয় পুলিশকে।

গত কাল বিবৃতি দিয়ে রেল ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদ করা ছাড়া এ নিয়ে পথে নামেনি তৃণমূল। কিন্তু আজ দিল্লিতে রেল ভবনের সামনে বিক্ষোভ দেখায় সিপিএম। কলকাতাতেও বামফ্রন্টের তরফে বিক্ষোভ-জমায়েত ছিল হাওড়া ও শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরে। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র-সহ বাম শরিক নেতারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সূর্যবাবুর অভিযোগ, ২০১২ সালে এই ভাবেই বাজেটের আগে রেল ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় মোদী কড়া সমালোচনা করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে চিঠি দিয়েছিলেন। অথচ নিজে প্রধানমন্ত্রী হয়ে সেই কাজটাই করলেন! তাঁর কথায়, “ওরা দাম-ফ্রন্ট! আমরা বামফ্রন্ট।” রাজভবনের সামনে বিক্ষোভ দেখায় এসইউসি-ও।

ভাড়া বৃদ্ধির পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রাক্তন রেল প্রতিমন্ত্রী তথা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, ইউপিএ জমানার শেষ দিকে রেল মাসুল নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ তৈরির সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভায় পাশ হয়ে গিয়েছিল। বিজেপি সরকার চাইলে তা কার্যকর করতে পারত। ভাড়ার বিষয়টি ওই কতৃর্পক্ষের উপরেই ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল বলে তাঁর মত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rail fare increase arun jaitley new delhi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE