জন্মদিনের ঠিক এক দিন আগে অটলবিহারী বাজপেয়ী ও মদনমোহন মালবীয়কে ভারতরত্ন খেতাব দেওয়ার কথা ঘোষণা করে এক ঢিলে অনেক পাখি মারলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশে আজ সকালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীকে ভারতরত্ন এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদের কান্ডারি ও বারাণসীর হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মদনমোহন মালবীয়কে মরণোত্তর ভারতরত্ন খেতাব দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। কাল দু’জনেরই জন্মদিন। কালই নিজের নির্বাচনী কেন্দ্র বারাণসীতে যাচ্ছেন মোদী। ফিরে এসে বাজপেয়ীর সঙ্গে দেখা করবেন। বড়দিনের আগে এমন দু’জনকে ভারতরত্ন দেওয়ার জন্য বেছে নিলেন মোদী, যার বিরোধিতা ঘোর বিরোধীরাও করবে না। তাই বিজেপি মনে করছে, এক ঢিলে অনেক পাখি মারলেন নরেন্দ্র মোদী।
এক, হিন্দুত্ব প্রসঙ্গ নিয়ে যখন বিরোধী শিবির একজোট হয়েছে, সেই সময় বাজপেয়ীর মতো ব্যক্তিত্বকে সামনে আনলেন প্রধানমন্ত্রী। সব দল, এমনকী সব ধর্মের মধ্যেই বাজপেয়ীর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। এমন কী, যে ওমর আবদুল্লা ও মেহবুবা মুফতির সঙ্গে কাশ্মীরে সরকার গড়ার সমঝোতা হচ্ছে, তাঁরাও বাজপেয়ীর সমর্থক। ওমর বাজপেয়ীকে ভারতরত্ন দেওয়ার দাবি তুলেছিলেন। মুফতিও বিজেপির সঙ্গে সমঝোতার রাস্তা খোলা রাখতে বাজপেয়ী সরকারের সঙ্গে ঘর করার কথা মনে করিয়েছেন।
দুই, মুখে হিন্দুত্বের কথা না বললেও মোদী আগেই বাজপেয়ীর জন্মদিনকে ‘সুশাসন দিবস’ হিসেবে পালন করার কথা ঘোষণা করেছেন। উদ্দেশ্য, বড়দিন পালনের বদলে দেশবাসীর অভিমুখ বাজপেয়ীর দিকে ঘোরানো। এ নিয়ে খ্রিস্টানদের একাংশ মোদীর নিন্দাও করেছে। জন্মদিনের আগেই ভারতরত্নের কথা ঘোষণা করিয়ে মোদী বিষয়টিকে উচ্চগ্রামে নিয়ে গেলেন। যদিও আজ প্রধানমন্ত্রী নিবাসে খ্রিস্টানদের এক প্রতিনিধি দলকে আমন্ত্রণও জানিয়েছেন মোদী।
তিন, বাজপেয়ীর নামে কিছু করে দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব চাপা দেওয়া সহজ। যেমন আজ হয়েছে। দু’দিন আগেই মোদীকে তোপ দেগেছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। আজ ভারতরত্ন ঘোষণা হওয়ার পরে তিনি বলেন, বহু দিন ধরে তিনি বাজপেয়ীকে ভারতরত্ন দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন। অরুণ জেটলিও এক নিবন্ধ লিখে ফেলেছেন বাজপেয়ীকে নিয়ে। আর মোদীও সেই সুরে টুইট করেছেন, অটলজি সকলের কাছে ‘অনেক কিছু’ পথপ্রদর্শক, অনুপ্রেরণা ও সেরাদের সেরা।
চার, মালবীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদের কান্ডারি হলেও তিনি কংগ্রেসের সভাপতিও ছিলেন দু’বার। লোকসভার প্রচারে নিজের কেন্দ্র বারাণসীতে গিয়ে মালবীয়কে ভারতরত্ন দেওয়ার দাবি তুলেছিলেন মোদী। এ বার নিজের সরকারে সেটি ঘোষণা করে কৃতিত্বটি নিজের ঝুলিতেই পুরলেন তিনি।
মোদীর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে কংগ্রেস নেতা অজয় মাকেন বলেন, “এই দুই নেতাই নরমপন্থী ছিলেন। আশা করব, তাঁদের দেখানো পথ ধরে হেঁটে ‘রাজধর্ম’ পালন করবেন মোদী। প্রসঙ্গত, ২০০২-এর গুজরাত দাঙ্গার পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী গুজরাতের তদানিন্তন মুখ্যমন্ত্রী মোদীকে বলেছিলেন, “জাতি-ধর্মের ভিত্তিতে তৈরি বিভেদ ভুলে রাজধর্ম পালন করুন।”
মোদীর এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জেডিইউ নেতা নীতীশ কুমার। দু’জনেই বাজপেয়ী ক্যাবিনেটের মন্ত্রী ছিলেন। তবে শিবসেনার দাবি, দলের প্রতিষ্ঠাতা বাল ঠাকরের অবদান বাজপেয়ীর থেকে কোনও অংশে কম নয়। তাই অবিলম্বে বালাসাহেবকেও মরণোত্তর ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত করা হোক। আর ভারতরত্ন প্রসঙ্গে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর মন্তব্য, “ভারতরত্ন, পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ এ সব নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না।” ২০০৮ সালে সম্ভাব্য ভারতরত্ন প্রাপক হিসেবে জ্যোতি বসুর নাম আলোচিত হয়েছিল। তখন মতাদর্শগত কারণ দেখিয়ে সিপিএম তার ঘোর বিরোধিতা করে।
মদনমোহন মালবীয়কে মরনোত্তর সম্মান দেওয়ার সমালোচনা করেছেন ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ। তাঁর দাবি, “এই সিদ্ধান্ত আদপেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়।” কেন? রামচন্দ্রর কথায়, “এত দিন আগে মারা যাওয়া কোনও ব্যক্তিকে ভারতরত্ন সম্মান দিয়ে কী লাভ? রাজনীতি বা শিক্ষার জগতে তাঁর যা অবদান, বহু মৃত ব্যক্তির অবদান তার থেকে অনেক বেশি। মালবীয়কে ভারতরত্ন দিলে তিলক, ভগৎ সিংহ বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও এই সম্মানে ভূষিত করা উচিত। কিন্তু ওঁরা তো প্রধানমন্ত্রীর কেন্দ্রের মানুষ নন!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy