Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

দাদাকে দূত করে দিদির রাজ্যে মোদীর দাদাগিরি

তাঁর ‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযানের জন্য দিদির রাজ্য থেকে দাদাকে দূত বাছলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী! নিছকই সরকারি অভিযানে আরও এক তারকা সংযোজন? নাকি এর সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে? বড়দিনে মোদীর চাল এই প্রশ্নই তুলে দিল বাংলার রাজনীতিতে! লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকেই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির শক্তি এবং গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের সেরাদের দলে আনার নির্দেশ দিয়েছিলেন মোদী। সেই তালিকায় অন্যতম ছিলেন ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক।

পুরনো ইনিংস। এক জন তখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী, অন্য জন কেকেআর অধিনায়ক। ২০১০, আমদাবাদ। রাজস্থান ম্যাচের পর।—ফাইল চিত্র।

পুরনো ইনিংস। এক জন তখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী, অন্য জন কেকেআর অধিনায়ক। ২০১০, আমদাবাদ। রাজস্থান ম্যাচের পর।—ফাইল চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:২১
Share: Save:

তাঁর ‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযানের জন্য দিদির রাজ্য থেকে দাদাকে দূত বাছলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী! নিছকই সরকারি অভিযানে আরও এক তারকা সংযোজন? নাকি এর সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে? বড়দিনে মোদীর চাল এই প্রশ্নই তুলে দিল বাংলার রাজনীতিতে!

লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকেই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির শক্তি এবং গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের সেরাদের দলে আনার নির্দেশ দিয়েছিলেন মোদী। সেই তালিকায় অন্যতম ছিলেন ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক। মোদীর ইচ্ছেতেই সৌরভকে বিজেপির টিকিটে লড়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল লোকসভা ভোটের আগে। কিন্তু সেই সময় সরাসরি রাজনীতির ময়দানে নামার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সৌরভ। এ বার পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোট যখন এগিয়ে আসছে এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিজেপির লড়াইয়ের পারদ যখন উত্তরোত্তর চড়ছে, সেই সময় মমতার রাজ্যে সৌরভকে কার্যত নিজের ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর’ই বানিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী! বিজেপি নেতৃত্বের একাংশ স্বভাবতই মনে করছেন, সরাসরি রাজনীতি না করেও মোদীর এই চালে রাজ্যে তাঁদের দলের সুবিধাই হল।

বিজেপি নেতাদের একাংশ বলছেন, সরাসরি বিজেপির টিকিটে লড়ার ক্ষেত্রে আপত্তি ছিল সৌরভের। এখনও সেই আপত্তি বহাল আছে। কিন্তু বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী এমন একটি কর্মসূচিতে সৌরভকে মনোনীত করেছেন, যেখানে তাঁর পক্ষে আপত্তি করা মুশকিল ছিল। সেই দিক থেকে সৌরভকে একটি ‘অরাজনৈতিক’ মঞ্চে তুলে দিলেন মোদী। আবার সুকৌশলে বিজেপির সঙ্গেও বাংলার ক্রীড়া জগতের অন্যতম সেরা এই আইকনকে জুড়ে দিলেন! তবে বকলমে। অতীতে এ ভাবেই টলিউডের অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে সাফাই অভিযানে সামিল হতে দেখা গিয়েছিল। পরে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের উপস্থিতিতে বিজেপিতে আনুষ্ঠানিক ভাবে যোগ দেওয়ার ঘোষণাও করা হয়। দিল্লির উপকণ্ঠে গুড়গাঁওয়ে থাকলেও তিনি অবশ্য সে বার বিজেপিতে যোগ দেননি। বিজেপি নেতাদের কৌতূহল, প্রধানমন্ত্রীর ডাকে ঝাড়ু হাতে নেওয়ার পরে ভবিষ্যতে সৌরভ বিজেপিতে যোগ দেন কি না।

মদনমোহন মালবীয়কে মরণোত্তর ভারতরত্ন দিচ্ছে কেন্দ্র। বৃহস্পতিবার তাঁর জন্মদিবসে বারাণসীতে
তাঁর মূর্তিতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। এখানেই স্বচ্ছ ভারত অভিযানের
জন্য তিনি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়াও কিরণ বেদী, কৌতুকশিল্পী কপিল শর্মা,
নৃত্যশিল্পী সোনাল মানসিংহ-সহ কয়েক জনকে মনোনীত করেন। ছবি: পিটিআই।

মেলবোর্ন থেকে স্বয়ং সৌরভ অবশ্য এ দিন বলেছেন, স্বচ্ছ ভারত অভিযানে তাঁর মনোনয়ন একেবারেই ‘অরাজনৈতিক’। তাঁর নিজের রাজ্যে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তিনিই বকলমে বিজেপির মুখ হতে পারেন, এমন ধারণাও নস্যাৎ করতে চেয়েছেন। মোদীর স্বচ্ছ ভারত অভিযানে অমিতাভ বচ্চন, সলমন খান বা সচিন তেন্ডুলকরের মতো তারকারাও যে আছেন, সে কথা উল্লেখ করেছেন। সৌরভ বলেছেন, “এই সম্মান পেয়ে আমি রোমাঞ্চিত! কিন্তু এর মধ্যে রাজনীতির রং আছে বলে আমার অন্তত বিশ্বাস হয় না।”

সৌরভ উদাহরণ দেন, কংগ্রেসের মনোনীত সাংসদ সচিনও স্বচ্ছ ভারত অভিযানে সামিল হয়েছেন। তা হলে তাঁর বেলায় আলাদা করে দেখা হবে কেন? কিন্তু ঘটনা হল, সচিনকে নিয়ে রাজনীতির ময়দানে এমন দড়ি টানাটানি ছিল না, যা সৌরভকে ঘিরে দেখেছে এ রাজ্য! সচিন কংগ্রেসের রাজীব শুক্ল থেকে শিবসেনার প্রয়াত নেতা বালাসাহেব ঠাকরে এবং স্বয়ং মোদী পর্যন্ত সকলের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলেছেন। খেলোয়াড় জীবনে সৌরভ ছিলেন বাম সরকারের পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ছিল মসৃণ। পরবর্তী কালে তৃণমূল নেত্রী তাঁকে নিজের দিকে টানার চেষ্টা করেছেন। সৌরভের অ্যাকাডেমি, স্কুলের জন্য জমির ব্যবস্থা করে দিয়ে বার্তা দিয়েছেন। সৌরভ মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে গিয়ে তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানালেও সরাসরি ঘাসফুলের জমিতে ঢোকেননি। রাজ্যের আরও অনেক তারকা-মুখের মতো শাসক দলের মঞ্চে গিয়ে ওঠেননি। তার মধ্যেই তাঁকে প্রস্তাব পাঠিয়েছে বিজেপি। তখনও এড়িয়ে গিয়েছেন সৌরভ। মোদীর প্রস্তাব অবশ্য এড়ানো মুশকিলই ছিল!

তৃণমূলের এক মন্ত্রীর কথায়, “ব্যক্তি সৌরভ সকলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলেন। অতীতে বুদ্ধবাবু-অশোকবাবুরা ওঁকে খাতির করতেন। আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও সৌরভ এসেছেন। স্বচ্ছ ভারত অভিযানে যাচ্ছেন বলেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে, তা ভাবতে রাজি নই!” শাসক দলেরই একাংশের মত, রাজনীতিতে আসার ইচ্ছা যদি সৌরভের থাকত, তা-ও এই মুহূর্তের বিধ্বস্ত তৃণমূল তাঁর পছন্দের জায়গা হতো না! সিপিএমের এক রাজ্য নেতার মন্তব্য, “পি সি সরকার বিজেপিতে যাবেন, কেউ ভাবিনি। রাজনীতিতে অনেক কিছুই হয়!” রাজ্য বিজেপির এক শীর্ষ নেতা বলছেন, “২০১৬ সালে সৌরভ আমাদের দিকে থাকবেন, এমন কথা বলার জায়গা তৈরি হয়নি। তবে যোগাযোগ আছে, এটুকু বলা যায়।”

রাজ্যের বিধানসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে অমিত শাহরাই বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহকে নির্দেশ দিয়েছেন, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়তে হবে। গায়ক কুমার শানুর বিজেপিতে যোগদানও তার অঙ্গ। অমিতের নির্দেশে রাহুলবাবু শঙ্খ ঘোষের কাছেও ছুটে গিয়েছিলেন একটি মিছিলে থাকার অনুরোধ জানাতে। শঙ্খবাবু অবশ্য সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। কিন্তু মোদী-অমিতের লক্ষ্য, যত বেশি সম্ভব নামী মুখকে দলের সঙ্গে যুক্ত করা। মমতা যখন টলিউড-টেলিউডের সিংহভাগকে ঝুলিতে রেখে ‘সফল’ হয়েছেন। শাহরুখকে রাজ্যের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করেছেন। এক বিজেপি নেতার কথায়, “এই অবস্থায় সৌরভের নাম মনোনয়ন করা নিছক কাকতলীয় নয়!”

তবে বিজেপি নেতারা বলছেন, ভবিষ্যতে সরাসরি দলে যোগ না দিয়ে সৌরভ যদি শুধুই স্বচ্ছ ভারত অভিযানে থাকেন, তা হলেও রাজনীতির ময়দানে সুফল পেতে পারেন তাঁরাই। মমতা ও তাঁর দল এখন যে ভাবে বিজেপি ও মোদীর বিরুদ্ধে খড়গহস্ত, সেই কোপ সৌরভের উপরে মারা তাঁদের পক্ষে কঠিন অধুনা অ্যাটলেটিকো-কর্তার জনপ্রিয়তার জন্যই! বিশেষত, ক্রিকেট ও ফুটবল, দুইয়ের সূত্র ধরেই বাংলায় সৌরভের প্রভাব অনস্বীকার্য।

বড়দিনের বাজারে আসল ‘দাদাগিরি’ তা হলে কে করলেন? নরেন্দ্রভাই মোদী না?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE