Advertisement
E-Paper

দুর্ঘটনায় মৃত্যু স্বামীর, জানেন না টিঙ্কুদেবী

বুধবার গুয়াহাটি রওনা হবেন, সে কথাই জানতেন বাড়ির সবাই। সহকর্মীদেরও তা-ই বলে এসেছিলেন জেলাশাসকের অফিসের কর্মী অসিতকুমার দেব। কিন্তু মঙ্গলবার বাড়ি ফিরেই ভেবে নেন— অফিসের জরুরি ফাইল পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৬ ০৯:৫২

বুধবার গুয়াহাটি রওনা হবেন, সে কথাই জানতেন বাড়ির সবাই। সহকর্মীদেরও তা-ই বলে এসেছিলেন জেলাশাসকের অফিসের কর্মী অসিতকুমার দেব। কিন্তু মঙ্গলবার বাড়ি ফিরেই ভেবে নেন— অফিসের জরুরি ফাইল পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন। তাই দেরি করা ঠিক হবে না। স্ত্রীকে ডেকে বলেন— ‘‘এককাপ লাল চা দাও। এখনই বেরিয়ে পড়ব। জরুরি ফাইলপত্র নিয়ে এসেছি। এগুলি যত আগে পৌঁছে দেওয়া যায়, ততই ভাল।’’

স্ত্রী টিঙ্কু দেব আপত্তি করেননি। ১৯৯৫ সালের ৩১ মার্চ চেনম্যান পদে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন স্বামী। সে থেকে বিভাগীয় কাজ যতটা করেছেন, এর চেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করেন স্পেশাল ম্যাসেঞ্জার-এর। গুয়াহাটিতে কোনও সরকারি কাজে কারও যাওয়া প্রয়োজন, সবাই ডেকে নেন অসিতবাবুকে। স্পেশাল ম্যাসেঞ্জার হিসেবে তিনি ছোটেন ফাইলপত্র বগলদাবা করে।

টিঙ্কুদেবী বললেন, ‘‘এমনও দিন গিয়েছে, সকালে গুয়াহাটি থেকে এসেছেন। স্নান-খাওয়া সেরে অফিসে গিয়েছেন। বাড়ি ফিরেই ফের রওনা বাসস্টপে। ১২-১৪ ঘণ্টার যাত্রা শিলচর-গুয়াহাটি। হাসিমুখে মেনে নিতেন। টিকিট আছে কি না, কী করে যাবেন, কোথায় বসবেন তা নিয়ে ভাবার অবকাশ নেই।’’

এ বারও তা-ই হল। অফিস থেকে ফিরেই গুয়াহাটি যাত্রার সিদ্ধান্ত। তাই টিকিট কাটার সুযোগ কোথায়। ছেলে প্রীতম (ডাক নাম বাবলা)-কে ডাকলেন। সে-ই তাঁকে এগিয়ে দেন তারাপুর ইঅ্যান্ডডি কলোনিতে। সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পরই আসে অভিশপ্ত বাসটি। এএস-০১-ইসি-৭৪৯৪। কন্ডাক্টর বললেন, তিন নম্বরের যাত্রী টিকিট কেটে বাতিল করেছেন। সিট পেয়ে যাওয়ায় দেরি করেননি অসিতবাবু।

বাবাকে ছেড়ে বাড়ি ফেরেন কলেজ পড়ুয়া ছেলে প্রীতম। গত কাল সকালে বাস দুর্ঘটনার কথা জানতে পারেন তিনি। মামাকে সঙ্গে নিয়ে ছুটোছুটি করেন বাবার খবরের জন্য। বারবার মোবাইলে ধরার চেষ্টা করছেন বাবাকে, কিন্তু সাড়া মিলছে না। মামা পরে ঘটনাস্থলে গিয়েছেন। গত কাল সন্ধ্যায় অসিতবাবুর পরিচয়পত্র এবং মানিব্যাগ খাদে খুঁজে পান উদ্ধারকারীরা।

আজ সকালে মৃতদেহের ভিডিওগ্রাফি এনে দেখান। শার্ট দেখেই অসিতবাবুকে চিনে ফেলেন তিনি। কিন্তু বাড়িতে এই খবর জানানোর সাহস পাননি।

শুধু অসিতবাবুর পিসিমা বাণী দে-কে ফোনে মৃত্যুসংবাদ জানিয়েছেন। আজ শ্রীকোণা বাংলাঘাটে অসিতবাবুর বাড়ি গিয়ে দেখা হয় বাণীদেবীর সঙ্গে। বললেন, ‘‘সব জেনেও না জানার মত ভান করে থাকা যে কী কষ্টকর! বুক ফেটে যাচ্ছে, ভাইপো আর নেই। কিন্তু কাঁদার সুযোগ নেই।’’

সত্তরোর্ধ্ব মা শেফালি দেবী কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন। একই অবস্থা টিঙ্কুদেবীর। বারবার বলছেন, ‘‘ঠাকুর পঙ্গু করে বাবলার বাবাকে ফিরিয়ে দাও। আমি আজীবন সেবা করব।’’ অসিতবাবু আর আসবেন না, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তাঁর সহকর্মীদেরও। গত কাল থেকেই জেলাশাসকের কার্যালয়ে শোকের পরিবেশ। সারা অসম জেলা প্রশাসন কর্মচারী সংস্থার রাজ্য সাধারণ সম্পাদক বিক্রমজিৎ চক্রবর্তী, মিলনউদ্দিন লস্কর, উজ্জ্বলেন্দু মিত্র মজুমদার সহ সবাই বলছেন, এ কী হল! বুধবার যেতে গিয়ে মঙ্গলবার কেন রওয়ানা হয়েছিলেন অসিতবাবু।

বিক্রমবাবু শোনান, কর্মচারী নেতা হিসেবে তাঁকেও প্রায়ই গুয়াহাটি যেতে হয়। তিন বার একসঙ্গে গিয়েছেন। কম কথা বলতেন। তবু সারাক্ষণ খেয়াল রেখেছেন, আমার অসুবিধে হয় কি না। মিলনবাবুরা বলেন, ‘‘অফিসের প্রয়োজনে গুয়াহাটি গেলেও সহকর্মীরা প্রায়ই নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসের কথা বলে দিতেন। হাসিমুখে এনে দিতেন। এক কাজ গেলে আরও অনেক কাজের কথা এখান থেকে বলা হতো, একবারের জন্যও বিরক্তি প্রকাশ করতেন না।’’

তাঁর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন জেলাশাসক এস বিশ্বনাথনও। তিনি জানান, তাঁর পরিবারকে সব ধরনের সহায়তার জন্য তিনি চেষ্টা করবেন।

সবার চিন্তা অবশ্য অন্য জায়গায়, আজ না হয় পেরিয়ে গেল, আগামী কাল মৃতদেহ নিয়ে এলে কী করে বলা অসিতবাবুর মা-স্ত্রী-পুত্রকে!

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy