Advertisement
১৯ মে ২০২৪

নাগা স্বাধীনতায় স্বীকৃতি দিচ্ছে ভারত, দাবি মুইভার

১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্ট। স্বপ্নভঙ্গ হওয়া এক নাগা লড়াকু নেতা ভারতের স্বাধীনতার এক দিন আগে তড়িঘড়ি স্বাধীন নাগাল্যান্ডের পতাকা উড়িয়েছিলেন। সেই সময় থুইংলেং মুইভা ছিলেন বছর তেরোর কিশোরমাত্র। আজ ৬৯-তম স্বাধীনতা দিবসে তিনিই অশীতিপর হাতে নাগাল্যান্ডের পতাকা উত্তোলন করলেন।

নাগাল্যান্ডের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুইভা। শুক্রবার হেব্রন।—নিজস্ব চিত্র।

নাগাল্যান্ডের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুইভা। শুক্রবার হেব্রন।—নিজস্ব চিত্র।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
হেব্রন (নাগাল্যান্ড) শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৫ ০৩:২৪
Share: Save:

১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্ট। স্বপ্নভঙ্গ হওয়া এক নাগা লড়াকু নেতা ভারতের স্বাধীনতার এক দিন আগে তড়িঘড়ি স্বাধীন নাগাল্যান্ডের পতাকা উড়িয়েছিলেন। সেই সময় থুইংলেং মুইভা ছিলেন বছর তেরোর কিশোরমাত্র। আজ ৬৯-তম স্বাধীনতা দিবসে তিনিই অশীতিপর হাতে নাগাল্যান্ডের পতাকা উত্তোলন করলেন।

আঙ্গামি জাপু ফিজোর ‘স্বপ্নের স্বাধীন নাগাল্যান্ড’ অর্জন করতে পারলেন না মুইভা। আপোসের সূত্র মেনে নাগাল্যান্ডের সার্বভৌমত্বের দাবি বিসর্জন দিয়ে কিছুটা স্বশাসনের আশ্বাস নিয়ে দিল্লির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে ফিরলেন। ভারত সরকারের জেড প্লাস নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বুলেটপ্রুফ দেওয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে এ দিন স্বাধীনতার মঞ্চে বক্তৃতা দিলেন এক সময়ের জঙ্গি নেতা।

১৮ বছরের শান্তি আলোচনার পর দিল্লি থেকে তিনি কী নিয়ে এলেন তা জানতে অপেক্ষায় ছিলেন নাগাল্যান্ডের বাসিন্দারা। জনতার সামনে দৃশ্যতই ক্লান্ত দেখাচ্ছিল মুইভাকে। চুক্তি নিয়ে যতই গোপনীয়তা থাকুক, জনতা বুঝে গিয়েছিল অসম, মণিপুর, অরুণাচলকে নিয়ে বৃহত্তর নাগালিম গঠন স্বপ্নই থেকে গিয়েছে।

স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতায় হুঙ্কার, অঙ্গীকারের বদলে এনএসসিএন (আই এম)-এর ‘আতো কিলোনসার’ (প্রধানমন্ত্রী) নমনীয়তা, ত্যাগের আহ্বান জানালেন। চুক্তির দায়ভারও পুরোপুরি ভাবে নিজের কাঁধে রাখলেন না। চাপিয়ে দিলেন ঈশ্বরের ইচ্ছার উপরে!

ধর্মপ্রাণ নাগাদের ধর্মের দোহাই দিয়ে মুইভা বললেন, ‘‘যিশু ও ঈশ্বরের ইচ্ছায় সাড়া না দিলে বড় ভুল হবে।’’ বুঝিয়ে দিলেন, তাঁর ও হাসপাতালে ভর্তি আই-এম সভাপতি মুমূর্ষু ইসাক চিসি সু-এর জীবনকালে এর চেয়ে বেশি কিছু কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে আদায় করা সম্ভব হবে না।

ইতিহাস বলে, এক সময় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গী আঙ্গামি জাপু ফিজো ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে অসম, মণিপুর, অরুণাচল ঘুরে বিভিন্ন উপজাতিকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন— ভারতের অধীনে নয়, উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি পৃথক ভাবে স্বাধীনতার দাবিদার। তাঁর সেই প্রয়াস সফল হয়নি। ১৯৪৭ সালর ১৪ অগস্ট স্বাধীন নাগাল্যান্ডের কথা ঘোষণা করে পতাকা ওড়ান ফিজো। সেই থেকে নাগাল্যান্ডে এই দিনেই স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয়।

১৯৬০ সালের ২৭ জুলাই নাগা পিপল্স কনভেনশনের সঙ্গে ১৬ দফা চুক্তিতে গঠিত হয় নাগাল্যান্ড রাজ্য। কিন্তু ফিজো তাতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। মায়ানমারের নাগাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে খাপলাং, মুইভা, আইজ্যাক সু কে সঙ্গে নিয়ে লড়াই চালাতে থাকেন। ১৯৬৮ সালে মুইভা এনএনসি প্রতিনিধিদল নিয়ে চিনে যান। ১৯৭৫ সালে হয় শিলং চুক্তি। মুইভা, সু, খাপলাং সেই আপোস না মেনে লড়াই চালিয়ে যাওয়া সিদ্ধান্ত নেন। তার ৫ বছর পরে তৈরি হয় এনএসসিএন। যা ভারতে ‘মাদার অব ইনসার্জেন্সি’ (সন্ত্রাসের সুচনা) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ওই তিন নেতার মধ্যে মুইভা ছিলেন মণিপুরের টাংখুল। সু নাগাল্যান্ডের সেমা। খাপলাং মায়ানমারের নাগা। দলটিতে ভারতীয়, মায়ানমার আর মণিপুরের নাগাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব তখন থেকেই শুরু। এখনও তা বর্তমান। ১৯৮৮ সালে মুইভার প্রায় ২০০ সঙ্গীকে মেরে খাপলাং পৃথক দল গড়েন। তারপর থেকে এনএসসিএনে চলছে ভাঙাগড়ার খেলা। ১৯৯৭ সালে বিস্তর প্রাণহানির পর, সু ও মুইভা ভারত সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষবিরতি করেন। শুরু হয় শান্তি আলোচনা। খাপলাং অবশ্য এখনও মায়ানমারে থেকে লড়াই চালাচ্ছেন। ইয়াঙ্গনের হাসপাতালে ভর্তি অসুস্থ খাপলাংকে শান্তির পথে ফেরাতে রাজ্যের দুই সংগঠনের ১৬ জন প্রতিনিধি যাচ্ছেন মায়ানমার।

ভারতের সঙ্গে চুক্তি সই করে এলেও এনএসসিএন-এর খুলে-কিতোভি গোষ্ঠী মণিপুরের নাগা মুইভার রফা মানতে নারাজ। তাই, ৬৯ তম নাগা স্বাধীনতা দিবসে ভারতের সঙ্গে তথাকথিত ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি সই হওয়ার পরও নাগাল্যান্ডে আদৌ শান্তি কতটা ফিরবে তা নিয়ে আই-এম বাহিনীও সন্দেহে। সব চেয়ে বেশি চাপে রয়েছেন মুইভা। সেমারা চাইছেন, এ বার সম্মানজনক সন্ধিতে যা মেলে তা নিয়েই চুক্তি সেরে ফেলতে। কিন্তু, টাংখুল মুইভা যদি মণিপুরের টাংখুলদেরই বৃহত্তর নাগাল্যান্ডের অংশ না করতে পারেন, তবে নাগাল্যান্ডেও তাঁর মুখ পুড়বে। মণিপুরেও পিঠ বাঁচানো যাবে না।

এ দিন আনুষ্ঠানিক ভাবে তথাকথিত নাগা চুক্তিকে ‘ফ্রেমওয়ার্ক’ বলে উল্লেখ করা করা হয়েছে। অসুস্থ সু-র লিখিত ভাষণ পাঠ করা হয়। তাতে তিনি লিখেছেন— ‘এই কাঠামোর উপরে ভিত্তি করেই নাগা ও ভারত উভয়ের পক্ষে সম্মানজনক চুক্তি তৈরি করা হচ্ছে। বিভিন্ন কারণে দু’পক্ষের সহমত হতে ১৮ বছর কেটে গিয়েছে। নাগারা অনেক সংযম, ধৈর্য্য দেখিয়েছেন। আমরা সকলের মতামত নিয়েই চূড়ান্ত চুক্তি করব। সামনে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কিন্তু, নাগাদের উপর আসা যে কোনও আঘাত রুখতে হবে।’ অন্য শিবিরে থাকা গোষ্ঠীগুলির কাছেও নাগা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য হাত মেলানোর ডাক দেন সু। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও কেন্দ্রকে ধন্যবাদ দিয়ে সু জানিয়েছেন— ‘আশ্বাস দিচ্ছি, কারও কাছে মাথা নুইয়ে চুক্তি করা হয়নি। আমাদের ভবিষ্যৎ আমাদের হাতেই সুরক্ষিত থাকবে। কিন্তু যে সুযোগ এসেছে, গোঁড়ামি দেখিয়ে তা হাতছাড়া করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। যুব প্রজন্ম তাঁদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট যোগ্য। তাঁদের কোনও বক্তব্য থাকলে সরব হোক। আমরা, নাগাদের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে লড়াই চালাবোই।’

চুক্তি নিয়ে দোটানায় থাকা জঙ্গি প্রধানমন্ত্রী মুইভা এ দিন বলেন, ‘‘আমাদের পূর্বসূরিরা সিদ্ধান্ত নেন, নাগারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরা ঠিক করবে। কিন্তু, সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত না নিলে পরে ভুগতে হবে। শিলং চুক্তি ভুল ছিল। তা না মেনে আমরা অধিকারের জন্য লড়ে যাই। ভারত অবশেষে আমাদের অধিকারে স্বীকৃতি দিচ্ছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘যাঁরা রটাচ্ছে আমরা সার্বভৌমত্বের দাবি ছেড়ে দিয়েছি। নাগা ঐক্যের আদর্শ বিসর্জন দিয়েছি। তাঁরা ভুল বোঝাচ্ছেন। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই আমাদের উদ্দেশ্য। এ বার আমরা নিজেদের শাসনে ঐকবদ্ধ থাকব।’’

নাগা হো হো, ইএনপিও, অরুণাচল-মণিপুর-মায়ানমারের নাগা ছাত্র সংগঠনগুলিও অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে চুক্তিকে স্বাগত জানান। সকলেই নাগা ঐক্যের পক্ষে সওয়াল করে সব জঙ্গি সংগঠনকে হাত মেলানোর আহ্বান জানায়।

আই-এম বাহিনীর প্রাক্তন সেনাধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার আতেম আগে বলেছিলেন— ‘আত্মরক্ষায় আই-এম এখনই অস্ত্র জমা দেবে না।’ এ দিন তিনি বলেন, ‘‘অস্ত্র জমা দেওয়ার বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE