পীষূষকান্তি দাস
বৃহত্তর গাঙ্গেয় বাংলার বর্ধিত ভূখণ্ড, ঐতিহাসিকভাবে ‘ঈশান বাংলা’ বলে খ্যাত আজকের বরাক উপত্যকা। চিরকালই পরিবেশ বান্ধব অঞ্চল এই বরাক। পরম্পরাগত ভাবেই এই অঞ্চলের লোকচর্চার ছত্রে ছত্রে পরিবেশপ্রীতি প্রতিফলিত।
এলাকার লোকাচারে যেমন মাছ-পান-পাখির উপস্থিতি রয়েছে, তেমনই পূজো-আর্চায়ও গাছ-পাতা-প্রাণীর অবস্থান। তুলসী, বেল যেমন বিদ্যমান, তেমনই শেওড়া, শিমূল, বট, চালতা ইত্যাদি বৃক্ষও পুজো পায় গ্রামে গ্রামে। আগমন, পার্বণ, যাত্রায় মাছের উপস্থিতি যেমন রয়েছে, তেমনই শ্রাদ্ধ-শান্তি শেষেও শোল-চ্যাং পোড়া ভক্ষণ আবশ্যিক। ‘ঈশান বাংলায়’ বাঘ-হাতির পূজার্চনা, সাপ না মারার রীতি-প্রথা-নিষেধ প্রাণীকুলের সঙ্গে মানুষের সখ্যতারই প্রমাণ দেয়। এখানে দেবতা, বলা ভাল লোক দেবতা হচ্ছেন কাচা কাউরি তথা কাঁচাকান্তি, পাতা কাউরি। স্থানে স্থানে এমন দেবতার মন্দিরে আজও পাতা উত্সর্গ করা হয়। আর জল-জমি তো আম জনতার ভাই, বোন, সই। বারুণীর সকালে আজও গ্রাম-শহরের কিশোরী-তরুণী-রমণীরা পুকুরে বা নদীতে স্নান করে জলের সঙ্গে ‘সইয়ালা’ করেন। চন্দ্র-সূর্য-মেঘ-বৃষ্টির পুজোর সঙ্গে সাপ-ব্যাঙের পুজোর চল এই উপত্যকায় আজও নজরে পড়ে। পরিবেশ ও প্রকৃতির সঙ্গে বরাকবাসীর এই প্রেম আবহমান কাল ধরে চলে আসছে, চলতেই থাকবে।
তিন দিকে পাহাড়, পশ্চিম উন্মুক্ত বরাকের। পাহাড়-সমতল-নদী-হাওর-খাল-বিল-বসতি ভরা সুন্দর সবুজ এই ঈশান বঙ্গের অঙ্গে সে অর্থে বৃহত্ কোনও পরিবেশ আন্দোলন সংগঠিত হয়নি। উনিশ শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশদের চা-বাগান আর বর্তমান ডিমা হাসাও অর্থাত্ উত্তর কাছাড় অঞ্চলে রেলের নির্মাণ নিয়ে বিক্ষিপ্ত বিরোধ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব ঘটনার সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপার ততটা ছিল না। ছিল ব্যক্তিস্বার্থ। স্বাধীনোত্তর বরাকেও সে রকমের বড়-ছোট কিছু ঘটেনি। এখানে ভাষার আগ্রাসন, জমি অধিকার নিয়ে আন্দোলন হলেও পরিবেশ পৃথকভাবে প্রাধান্য পায়নি।
অন্য অঞ্চলের মত পরিবেশ ভাবনাটা ধীরে ধীরে এই অঞ্চলেও মাথাচাড়া দেয় বিংশ শতাব্দীর শেষ দু’দশকে। তাও ক্লাব, সংস্থা, সংগঠনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে, ঘুরপাক খেয়েছে বৃক্ষরোপণের গোল-গণ্ডিতেই। বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে বরাকের স্থানে স্থানে জংলি হাতির উপদ্রব আরম্ভ হয়। ততদিনে উপত্যকা থেকে এক খড়্গবিশিষ্ট গণ্ডার, গড়িয়ল, বাঘ ইত্যাদি বিলীন হয়ে গিয়েছে। হাতির সংখ্যাও দেখতে দেখতে কমে আসছে। উদ্বিগ্ন কিছু তরুণ তখন উপত্যকাভিত্তিক ‘অ্যানিম্যাল লাভার্স ফোরাম’ গঠন করে বন্যজন্তু রক্ষণাবেক্ষণ এবং গৃহপালিত পশুপালন নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ শুরু করেন। স্থানে স্থানে হরিণ, কচ্ছপ, ডলফিন নিধন প্রতিহত করতে সক্রিয় ভূমিকাও পালন করেন। এতে শরিক অনেকেই পরবর্তী কালে পেশাগত কারণে নানা স্থানে চলে যাওয়ায় সংগঠনের কাজকর্ম স্তিমিত হয়ে যায়।
সে সময়েই কিন্তু উপত্যকার বার্ষিক বন্যা-যন্ত্রনার নিরসনে বরাক বাঁধ নির্মানের বিষয়টি দানা বাঁধতে শুরু করে। এই বাঁধেই বন্যা সমস্যার সমাধান হবে, জলসেচের ব্যবস্থা হবে, রাজনৈতিক ভাবে এমন এক ধারণা জনমনে প্রতিষ্ঠিত করার জোর চেষ্টা চলে। তখন মুষ্টিমেয় কয়েক জন ‘অন্য’ কথা বলতে আরম্ভ করেন। প্রাথমিক ভাবে তা সীমাবদ্ধ ছিল সাময়িক পত্র-পত্রিকায়। বৃহত্ নদীবাঁধ-বিরোধী ভাবনা, আন্দোলনের জনক কিন্তু এই অঞ্চলে হাতে গোনা কয়েকজন। তাঁদের অন্যতম চন্দন সেনগুপ্ত, পরিতো ষ পাল চৌধুরী, আবুল ফজল, গোলাম ওসমানি প্রমুখ।
ইতিমধ্যে সময় গড়িয়েছে। যা ছিল প্রস্তাব, তাকেই রূপ দিতে তৈরি হয়েছে সরকার-প্রশাসন। বরাক নদীর উজানে, টিপাইমুখে প্রস্তাবিত বৃহত্ নদীবাঁধ নির্মাণের তত্পরতা শুরু হয়। শিলান্যাসও হয়ে যায়। এরই সঙ্গে সঙ্গে মাথাচাড়া দেয় নদীবাঁধ-বিরোধী আন্দোলনও। মূলত মণিপুর এবং বাংলাদেশে তা তীব্র রূপ নেয়। এ দেশের অন্যত্রও তখন বাঁধবিরোধী আন্দোলন তীব্রতর। সুবনসিরি বাঁধের বিরুদ্ধেও আন্দোলন বৃহত্ মাত্রা নিতে আরম্ভ করে। এই সব ঘটনা এবং তার নিত্যদিনের সংবাদ উপত্যকার নদীবাঁধ-বিরোধী মুষ্টিমেয় ক’জনকে উত্সাহিত করে। তাঁদের এককালের বৌদ্ধিক কাজকর্ম আমজনতাকে আন্দোলনে জারিত করার পথ প্রশস্ত করেছিল। এবার আন্দোলন পথে নামে। ২০০৮-০৯ সাল থেকে প্রাথমিক ভাবে সভাসমিতি, সেমিনার, আলোচনা এবং ধর্না-বিক্ষোভ-মিছিল টিপাইমুখের প্রস্তাবিত বরাকবাঁধ-বিরোধী গণআন্দোলনের রূপ নেয়। এই বাঁধের বিরুদ্ধে একযোগে শিলচর, ইম্ফল, দিল্লি, কলকাতা, ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, খুলনা, এমনকী লন্ডন, প্যারিস, শিকাগো-সহ বিশ্বের কুড়িটিরও বেশি শহরে বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়। মূলত ‘সেভ’ নামের সংগঠনের উদ্যোগে এই আন্দোলন আরম্ভ হলেও আজ তাতে পরিবেশ সংগঠন ‘কোপ’, ‘সেফ’, কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতি, মজুরি শ্রমিক ইউনিয়ন, কোরাস, কায়ানট, নাগরিক সুরক্ষা সমিতি-সহ শতাধিক সংস্থা-সংগঠন সামিল। তাদের সঙ্গে সমানভাবে সরব দেশ-বিদেশের বহু দল ও সংগঠন।
বিগত এক দশকেরও কম সময়ে মূলত বরাকবাঁধ-বিরোধী এই গণআন্দোলনকে সামনে রেখে বরাক এখন পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন, উষ্ণায়ন, জল-জমি-জঙ্গলের অধিকার, কার্বন এমিশন ইত্যাদি বিষয়েও সমান সচেতন। পরিবেশের প্রতি চিরকালের সংবেদনশীল বরাক এখন নতুন করে পরিবেশমুখী হয়ে উঠেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy