ন’বছর ধরে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীকে ভিসা দেয়নি আমেরিকা। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় ওবামা প্রশাসন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার ঠিক চার মাস পরে, শুক্রবার অবশেষে আমেরিকা পৌঁছলেন নরেন্দ্র মোদী। নিউ ইয়র্কে পিটিআইয়ের ছবি।
তিনি বলছেন বটে, ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দেবেন, নরেন্দ্র মোদী বাস্তবে কতটা করে দেখাতে পারবেন, তা নিয়ে এখনও সংশয়ে রয়েছে মার্কিন শিল্পমহলের একাংশ। তাদের মতে, এটা ঘটনা যে ভারতে বিদেশি লগ্নিকে আমন্ত্রণ জানানো বা ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগান তোলার পাশাপাশি সরকারের চরিত্র বদলের একটা চেষ্টা শুরু করছেন নরেন্দ্র মোদী। তবে আর্থিক ক্ষেত্রে তাঁর সরকারের বেশ কিছু নীতি এখনও মার্কিন বিনিয়োগকারীদের পক্ষে পুরোপুরি অনুকূল নয়। আমেরিকায় পা রাখার আগে মোদীর ভাবমূর্তি নিয়ে এই সঙ্কেতই দিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ও শিল্পমহলের একাংশ।
আমেরিকার একটি প্রথম সারির সংবাদপত্রের মতে, নিজের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করছেন মোদী। বদলে দিতে চাইছেন কেন্দ্রীয় সরকারের চরিত্রও। বিভিন্ন মন্ত্রকের গুরুত্ব কমিয়ে নিজের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ক্ষমতার এই কেন্দ্রীকরণ মোদীর পক্ষে সমস্যা তৈরি করতে পারে বলে ধারণা মার্কিন সংবাদমাধ্যমের। তাদের মতে, আর্থিক নীতি-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বদল আনতে উপযুক্ত বিশেষজ্ঞদের সাহায্য প্রয়োজন। কিন্তু মোদী কোনও পরামর্শদাতার উপরেই বেশি নির্ভর করেন না। মার্কিন সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ইন্দিরা গাঁধীর আমলেও বেশ কিছু শক্তিশালী পরামর্শদাতা ছিলেন। তাঁদের মত বিশেষ গুরুত্ব পেত। কিন্তু মোদী ‘নিজেই নিজের পরিচালক’। মার্কিন সংবাদমাধ্যমের তাই প্রশ্ন, মোদী কি প্রতিভাকে উপযুক্ত গুরুত্ব দিতে পারবেন?
সংবাদপত্রটির মতে, নিজে দীর্ঘদিন পরিচালনা করতে পারেন এমন শাসনযন্ত্র তৈরি করতে চান মোদী। ভারতের মতো দেশে তিনি তা করতে পারবেন কি না দেখার বিষয়।
মোদী মন্ত্রিসভায় এখনও একই ব্যক্তির হাতে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক থাকার বিষয়টি নজর এড়ায়নি মার্কিন সংবাদমাধ্যমের। তাদের প্রশ্ন, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রকে গুরুত্ব দিচ্ছে মোদী সরকার। অথচ এখনও আলাদা প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিয়োগ করে উঠতে পারেননি তিনি। অর্থের পাশাপাশি ওই মন্ত্রক সামলাতে হচ্ছে অরুণ জেটলিকে।
আমেরিকা চললেন নরেন্দ্র মোদী। দিল্লিতে পিটিআইয়ের ছবি।
মোদী জমানায় মন্ত্রীদের উপরে নজরদারির বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে বেশ কিছু লেখালেখি হয়েছে। তার প্রতিফলন স্পষ্ট মার্কিন সংবামাধ্যমেও। শিল্পপতির সঙ্গে বৈঠকে গিয়ে মোদীর ফোন পাওয়া বা বিদেশে যাওয়ার আগে পোশাক নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আচমকা পরামর্শ সবই উল্লেখ করেছে নানা মার্কিন সংবাদপত্র। মার্কিন সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, বিভিন্ন মন্ত্রকের আমলাদের মুখ খুলতে নিষেধ করেছে মোদী সরকার। আবার প্রধানমন্ত্রীর দফতরে এখনও পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য কোনও অফিসার নেই। তাই সাংবাদিকদের পক্ষেও প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আজই মার্কিন সংবাদমাধ্যমে মোদীর কিছু বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, মার্কিন বিনিয়োগ ও নতুন চিন্তাভাবনার জন্য ভারত তার দরজা খুলে রেখেছে। কিন্তু এ দিনই প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে লেখা চিঠিতে মার্কিন ব্যবসায়ীদের একটি প্রভাবশালী অংশ জানিয়েছে, মোদী সরকারের কিছু কিছু নীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কিছু দিন আগেই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) একটি চুক্তি আটকে দিয়েছে মোদী সরকার। অনেকের মতে, সফরের সময়ে মোদীকে ওই চুক্তি নিয়ে চাপ দিতে পারে আমেরিকা। তাতে সফরের সুরও কিছুটা কেটে যেতে পারে, আশঙ্কা কূটনীতিকদের।
তবে মোদী বা তাঁর সরকারের নানা দিক নিয়ে সংশয় থাকলেও সবটাই যে নেতিবাচক, এমন বলছে না মার্কিন সংবাদমাধ্যম। কিছু সংস্কার-উদ্যোগের দিকে সতর্ক ভাবে নজর রাখছে তারা। যেমন মোদীর হাতে নিয়ন্ত্রণ থাকা ও তাঁর নজরদারির কিছু সুফলের কথাও উল্লেখ করছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম। তাদের মতে, ভারতের শিল্পপতিদের কাছে মোদী জমানা এক নতুন অভিজ্ঞতা। আগে মন্ত্রী ও মন্ত্রকের কর্তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছাড়পত্র পেতেন তাঁরা। কিন্তু এখন মন্ত্রকের অফিসে গিয়ে সরকারি ভাবে বৈঠক করে সব কাজ করতে হচ্ছে। ফলে প্রশাসনে স্বচ্ছতা বেড়েছে।
নিজস্ব মূল্যায়ন বা মতামত না চাপিয়ে মার্কিন সংবাদপত্রটি এ-ও জানাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর কড়া ব্যবস্থায় কাজ হয়েছে বলে দাবি করছেন মোদী -সমর্থকরা। যে সব মন্ত্রক কাজ ফেলে রাখত তারা কাজ করছে। এক বার মোদীর সঙ্গে কথা বলার পরে এক মন্ত্রী পুরো সপ্তাহ কাজ করেছিলেন। মোদী শিবির মার্কিন সংবাদপত্রকে জানিয়েছে, চলতি আর্থিক বছরের প্রথম তিন মাসে আর্থিক বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৫.৭ শতাংশে, অর্থাৎ ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে অর্থনীতি। তবে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘমেয়াদি আস্থা অর্জন করতে না পারলে যে লগ্নিকে সে ভাবে ভারতমুখী করা যাবে না, সেটাও মনে করিয়ে দিচ্ছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম। বিনিয়োগকারীরা প্রথম একটা বছর অন্তত নতুন সরকারকে ক্রিকেটের ভাষায় ‘বেনিফিট অব ডাউট’-ই দিতে চাইছেন। তবে তার পর থেকেই শুরু হবে লগ্নিচিত্রে পরিবর্তনের আসল পরীক্ষা।
মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গিতে অবশ্য খুবই অর্থবহ পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে ব্যক্তি মোদীর ক্ষেত্রে। এক সময়ে গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে অভিযোগের জেরে তাঁকে দেশে ঢোকারই অনুমতি দেয়নি মার্কিন প্রশাসন। আর এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ওবামার প্রশাসনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ অতিথি। চিনের আগ্রাসী মনোভাবের মুখে এশিয়ায় শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখতে মোদী সরকারকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সঙ্গী বলেই মনে করছে আমেরিকা। সে দেশের মাপকাঠিতে ভাবমূর্তির এতটা পরিবর্তন খুব কম সংখ্যক রাষ্ট্রনেতার ক্ষেত্রেই ঘটেছে। এই কথাটাও স্বীকার করতে ভোলেনি মার্কিন সংবাদমাধ্যম।
আমেরিকার পথে ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে পূর্বসূরি মনমোহন সিংহকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন মোদী। এ বার তিনি চান নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটনের শুভেচ্ছা পেতে। সফল হলেন কি না, তা বলবে আগামী কয়েক দিন।
সমন জারি আমেরিকায়
আমেরিকায় পা রাখার ঠিক আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে সমন জারি করল এক মার্কিন আদালত। বৃহস্পতিবার দক্ষিণ নিউ ইয়র্কের এক আদালত তাঁর বিরুদ্ধে সমন জারি করেছে। গুজরাত দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত দুই ব্যক্তির হয়ে নিউ ইয়র্কেরই একটি মানবাধিকার সংস্থা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল। তার প্রেক্ষিতেই এই সমন। অভিযোগে বলা হয়েছে, গুজরাত দাঙ্গার সময় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছেন মোদী। তবে মোদীর বিরুদ্ধে এই সব মামলা করে বিশেষ সুবিধে হবে না, জানিয়েছেন মার্কিন আইন বিশেষজ্ঞেরা। কারণ, একটি দেশের প্রধান হিসেবে আমেরিকায় কূটনৈতিক রক্ষাকবচ থাকবে নরেন্দ্র মোদীর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy