মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় বিজয়ডঙ্কা বাজানোর পর এ বার নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের লক্ষ্য ‘মিশন কাশ্মীর।’
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জম্মু-কাশ্মীর ও ঝাড়খণ্ডের বিধানসভা নির্বাচন সেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল নির্বাচন কমিশন। ২৫ নভেম্বর থেকে পাঁচ দফায় নির্বাচন হতে চলেছে ওই দুই রাজ্যে। ফল প্রকাশ ২৩ ডিসেম্বর।
জম্মু ও কাশ্মীরে এখন ভোট করানোর সিদ্ধান্তকে ন্যাশনাল কনফারেন্স ছাড়া সব দলই স্বাগত জানিয়েছে। শাসক দল ন্যাশনাল কনফারেন্সের অভিযোগ, কমিশন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারের কথা শোনার প্রয়োজনই বোধ করেনি। মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা বলেন, “বন্যার জন্য ভোট পড়বে খুবই কম।” কমিশনের অবশ্য দাবি, ভোটে বন্যার কোনও প্রভাবই পড়বে না।
ওমর আবদুল্লারা বন্যার কারণে এখন ভোট না চাইলেও বিজেপি নেতৃত্ব কিন্তু মনে করছেন, এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাঁদের কাছে শাপে বর হয়েছে। এ কথা ঠিক যে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় ক্ষমতা দখলের পরে জম্মু-কাশ্মীরে অন্যতম বড় পরীক্ষার মুখে পড়তে চলেছে নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ জুটি। সবচেয়ে কঠিন কাজ সংখ্যালঘু সমাজের সমর্থন পাওয়া। কংগ্রেস পর্যন্ত ওই ভোট ব্যাঙ্কে থাবা বসাতে পারেনি। এর পিছনে একটি বড় কারণ কেন্দ্র তথা দিল্লির প্রতি উপত্যকাবাসীর অনাস্থা। কিন্তু সাম্প্রতিক বন্যার পরে সেই মনোভাবে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করছেন বিজেপি নেতৃত্ব।
কেন? বিজেপি নেতৃত্বের মতে বন্যার কারণে তিন ভাবে ফায়দা হয়েছে দলের। প্রথমত, গত দু’দশকের বেশি সময় ধরে উপত্যকায় সেনা উপস্থিতি থাকলেও এ যাবৎ মানুষের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ তারা। কিন্তু বন্যার পরে যে ভাবে জওয়ানেরা দিন-রাত পরিশ্রম করে উদ্ধারের কাজ চালিয়েছে, তাতে সেনা তথা কেন্দ্র সম্পর্কে উপত্যকাবাসীর মানসিকতা আগের থেকে পরিবর্তন হয়েছে। কিছুটা হলেও সহজ হয়েছে দু’পক্ষের সম্পর্ক।
দ্বিতীয়ত, বন্যার কারণে এক দিকে ভারতীয় সেনারা যখন প্রাণপাত করছেন, তখন হুরিয়তের মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলির নেতা সেনার বিরুদ্ধে বলে স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ওই বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতারাই কাশ্মীরে ভারত বিরোধী জিগির তোলাই শুধু নয়, ওই রাজ্যে ভোট হলেই বয়কটের ডাক দিয়ে থাকেন। বন্যার পরে সে সব নেতাদের জনভিত্তি আরও কমে গিয়েছে বলেই গোয়েন্দা সূত্রে খবর।
তৃতীয়ত, বন্যার পর ত্রাণের কাজে নেমে মোদী অন্তত কাশ্মীরবাসীকে এই বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছেন যে, ওই রাজ্যে পুনর্বাসনের যা কাজ হচ্ছে তার পিছনে রয়েছে এক মাত্র কেন্দ্র।
বিজেপি সূত্রে আরও খবর, আর্থিক সাহায্য থেকে রাজ্যের পুনর্গঠন সব ক্ষেত্রেই রাজ্যের ওমর সরকার যে ব্যর্থ, তা এখন রাজবাসীর কাছে স্পষ্ট। বিজেপির দাবি, মানুষের ক্ষোভ বুঝতে পেরেই ওমরের দল প্রথম থেকেই নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার জন্য সওয়াল করে আসছিল। ওমরের এই সওয়ালকে সমালোচনা করে পিডিপি-র মুখপাত্র নইম আখতার বলেন,“ওমরের সরকারকে ফেলার জন্য এখনই উপত্যকার মানুষ বিপুল পরিমাণে ভোট দেবেন। কারণ ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতারা বন্যা দুর্গতদের কথা একেবারেই ভাবেননি। তাঁরা ব্যস্ত ক্ষমতা ভোগ করতে।”
সব মিলিয়ে বিজেপি নেতৃত্বের মতে জম্মু ও কাশ্মীরে ভাল ফল করতে গেলে এটাই ভোট করার উপযুক্ত সময়। কিন্তু কাশ্মীরে ইতিমধ্যেই তুষারপাত শুরু হয়েছে। সীমান্তে গোলাগুলিও অব্যাহত। এই অবস্থায় এখন সেখানে ভোট করার মতো পরিস্থিতি রয়েছে কি না, সেই বিষয়টিও ভাবাচ্ছিল কেন্দ্রকে। অবশেষে চলতি মাসের শুরুতে চূড়ান্ত বৈঠকে বসেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের শীর্ষ কর্তারা। বৈঠক হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মধ্যেও। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অনিল গোস্বামী নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। তার পরেই জম্মু ও কাশ্মীরে ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। আজ মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ভি এস সম্পত বলেন, “জম্মু-কাশ্মীরের একটি দল ছাড়া বাকি সব দল সময়ে নির্বাচনের পক্ষে ছিল। তাই কমিশন সময়েই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
এমনিতে কাশ্মীর বিজেপির কাছে একটি সংবেদনশীল বিষয়। ওই রাজ্যেই মৃত্যু হয়েছিল জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের। ৩৭০ ধারা অবলুপ্তির দাবি নিয়েও দীর্ঘ সময় ধরে সরব রয়েছে বিজেপির একাংশ। সর্বোপরি কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত-পাকিস্তানের সংঘর্ষ জারি রয়েছে পূর্ণমাত্রায়। তাই দল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কাশ্মীরে প্রভাব বাড়াতে তৎপর বিজেপি। কিন্তু এ যাবৎ হিন্দু অধ্যুষিত জম্মু ছাড়া প্রত্যাশিত সাফল্য দলের কাছে অধরাই থেকেছে। তাই বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের কথায়, “কাশ্মীর একটি বড় পরীক্ষা হতে চলেছে।” ইতিমধ্যে রণকৌশলও ঠিক করে ফেলেছেন তিনি। তারই অঙ্গ হিসাবে প্রথমেই রাজ্যের ৮৭টি বিধানসভাকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করেছে বিজেপি। হিন্দু অধ্যুষিত কেন্দ্র, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত কেন্দ্র ও জঙ্গি তথা বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের প্রভাব রয়েছে এমন কেন্দ্রগুলি।
এর মধ্যে হিন্দু ভোট যে কেন্দ্রগুলিতে নির্ণায়ক শক্তি, সেখানে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দল। কেন্দ্রের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই ওই রাজ্যের নির্বাচনকে মাথায় রেখে হিন্দু ভোট সঙ্ঘবদ্ধ করতে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের পুনর্বাসন সংক্রান্ত নীতি ঘোষণা করে কেন্দ্র। যার সুফল বিধানসভা ভোটেও মিলবে বলে মনে করছেন বিজেপি নেতৃত্ব।
দীপাবলির পরেই যে জম্মু-কাশ্মীরে নির্বাচন ঘোষণা হতে চলেছে এমনটা আঁচ করছিল বিজেপি শিবিরও। যে কারণে ওই রাজ্যের মানুষের পাশে থাকার বার্তা দিতে দীপাবলি উৎসব ওই রাজ্যে পালনের সিদ্ধান্ত নেন মোদী। সিয়াচেনের জওয়ানাদের সঙ্গে দেখা করার পাশাপাশি শ্রীনগরে গিয়ে ৭৪৫ কোটি টাকার ত্রাণ প্যাকেজও ঘোষণা করেন তিনি। ভবিষ্যতে আরও অর্থ লাগলে তা দেওয়া হবে বলেও আশ্বাস দেন। আজ নির্বাচনের দিন ঘোষণা হওয়ার পরেই নির্বাচনী আচরণবিধি চালু হয়ে গিয়েছে দু’রাজ্যে। কিন্তু নির্বাচনী কমিশনার এইচ এস ব্রহ্ম বলেন, “সরকার চাইলে কাশ্মীরের জন্য আরও ত্রাণ প্যাকেজের ঘোষণা করতে পারে। আদর্শ আচরণবিধি বাধা হবে না।” বিজেপি সূত্রের খবর, কাশ্মীরিদের মন পেতে আগামী দিনে একাধিক ত্রাণ প্যাকেজের ঘোষণা করতে পারে কেন্দ্র।
তবে এত কিছুর পরেও জম্মু-কাশ্মীরে একার জোরে সরকার গড়া বেশ কঠিন বলেই মনে করছেন বিজেপি নেতৃত্ব। বিজেপি সূত্রের খবর, জম্মু এলাকার সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ জম্মু থেকে অর্ধেকেরও বেশি আসন জিতিয়ে আনবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু বিজেপির কাছে মূল চিন্তা উপত্যকা বা কাশ্মীরের ভোট। ওই এলাকায় দলের প্রভাব নেই বললেই চলে। রাজ্যের দুই মূল আঞ্চলিক দল ওমরের ন্যাশনাল কনফারেন্স বা মেহবুবা মুফতির পিডিপি দু’জনেই কেন্দ্রের শাসক দলের সঙ্গে জোট বাঁধতে চায় বলে একাধিকবার ইঙ্গিতও দিয়েছে। তবু ভোটের আগে অন্তত একলা চলোর রাজনীতি নিয়েই এগোতে চাইছেন মোদী-শাহ জুটি। ভোট পরবর্তী অঙ্কে কোনও দলের সঙ্গে জোট করার প্রয়োজন হলে সে ক্ষেত্রে জোট হবে।
কিন্তু আপাতত বিজেপির নীতি একলা চলো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy