আমলাতন্ত্রের উপরে নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে শীর্ষ পদে পছন্দের অফিসারদের বসানো শুরু করেছেন নরেন্দ্র মোদী। তাতে আমলাতন্ত্রের অন্দরে দেখা দিচ্ছে অসন্তোষ।
ক্ষমতায় আসার পরে আমলাদের সঙ্গে বেশ কয়েক বার বৈঠক করেছিলেন মোদী। তাতে আমলাতন্ত্রের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল বলেই মনে করেন অনেকে। কিন্তু ক্যাবিনেট সচিবালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, অর্থ মন্ত্রক থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মাথায় ধীরে ধীরে মোদী-ঘনিষ্ঠ অফিসারদের আনা নিয়ে এ বার সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ক্যাবিনেট সচিবালয়ের গৌরী কুমার থেকে অর্থ মন্ত্রকের নতুন রাজস্ব সচিব হাসমুখ আঢ়িয়া কিংবা নতুন কর্পোরেট বিষয়ক সচিব তপন রায়—সকলেই গুজরাত ক্যাডারের অফিসার এবং মোদীর আস্থাভাজন। গৌরী কুমার, হাসমুখরা ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এর দায়িত্ব সামলেছেন। এ বার কেন্দ্রীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে তাঁদের নিয়ে আসছেন মোদী।
সেখানেই তাল কাটছে কোথাও। ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে আমলাতন্ত্রের মধ্যে। প্রথমে বিদেশসচিব পদ থেকে সুজাতা সিংহকে সরিয়ে দেওয়া নিয়ে এই ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। তার পর রাতারাতি এসপিজি প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় দুর্গাপ্রসাদকে। অর্থসচিব পদে রাজীব মহর্ষিকে বসানোর জন্য অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ পদে সরতে হয় অরবিন্দ মায়ারামকে। এ বার সেই মহর্ষিকেই স্বরাষ্ট্রসচিব করার জন্য সাত মাসের মধ্যেই এল সি গয়াল পদচ্যুত হয়েছেন।
নিয়ম অনুযায়ী, ক্যাবিনেট সচিব, বিদেশসচিব, প্রতিরক্ষা সচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব পদের মেয়াদ দু’বছর নির্দিষ্ট থাকে। যাতে শীর্ষ আমলারা নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারেন। তাঁদের রাজনৈতিক চাপের কাছে মাথা নোয়াতে না হয়।
কিন্তু তা সত্ত্বেও যে ভাবে দু’বছর শেষ হওয়ার আগেই এ সব পদ থেকে আমলাদের চাপ দিয়ে সরে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে, তাতে অবসরপ্রাপ্ত আমলারাও আশঙ্কিত। প্রাক্তন ক্যাবিনেট সচিব কে এম চন্দ্রশেখর মন্তব্য করেছেন, ‘‘বার্তা স্পষ্ট যে কোনও পদেই কোনও নিরাপত্তা নেই। যে কোনও সময়েই কাউকে বদলি করা হতে পারে। আমার মনে হয় এর ফলে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসাররা চাপে পড়বেন।’’
নর্থ ব্লকের এক আমলা বলছেন, ‘‘এত দিন মন্ত্রীকে খুশি রাখলেই চলত। কিন্তু এখন রিমোট কন্ট্রোল এক জনের হাতে। সেখানে ফুল-বেলপাতা দিতে গেলে আবার মন্ত্রী নারাজ হচ্ছেন!’’
আমলাদের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহও অখুশি। এমন নয় যে স্বরাষ্ট্রসচিব হিসেবে গয়াল তাঁর প্রিয়পাত্র ছিলেন। কিন্তু মন্ত্রিসভার নিয়োগ সংক্রান্ত কমিটিতে প্রধানমন্ত্রী ছাড়া একমাত্র তিনিই রয়েছেন। অথচ অধিকাংশ নিয়োগের খবরই রাজনাথ সংবাদমাধ্যম থেকে পাচ্ছেন।
মহর্ষিকে স্বরাষ্ট্রসচিব পদে নিয়োগের বিষয়েও তিনি কিছু জানতেন না বলেই সরকারি সূত্রের খবর। বস্তুত অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি চেয়েছিলেন, অর্থসচিব পদেই মহর্ষির মেয়াদ বাড়ানো হোক। কারণ তিনি রাজস্থানে জমি অধিগ্রহণ আইন, শ্রম আইনের সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে সুদ নীতি প্রণয়ন কমিটির বিষয়ে বোঝাপড়াও সামলাচ্ছিলেন তিনি।
এ বার নর্থ ব্লকে অবস্থিত দুই মন্ত্রকেই মোদীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হল বলে মনে করছে আমলামহল। এক দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে মহর্ষি। অন্য দিকে রতন পি ওয়াটালকে অর্থসচিব করা হলেও তিনি ব্যয় বিভাগের দায়িত্বেই থাকছেন। কিন্তু হাসমুখকে নিয়ে আসা হয়েছে রাজস্ব দফতরে। তাঁর হাতেই কর সংক্রান্ত বিষয়গুলি। প্রথমে তাঁকে অর্থ মন্ত্রকে নিয়ে এসে ব্যাঙ্ক বিভাগের দায়িত্ব দিয়েছিলেন মোদী। তাঁর হাতেই প্রধানমন্ত্রী জন ধন প্রকল্পের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়। আগামী বছর বর্তমান অর্থসচিবের অবসরের পর হাসমুখ অর্থসচিব হলে কেউই অবাক হবেন না। যদিও বর্তমান অর্থ বিষয়ক সচিব শক্তিকান্ত দাস তাঁর থেকে সিনিয়র। রাজস্ব দফতরে যুগ্মসচিব পদে গুজরাতের আরেক অফিসার জি সি মুর্মুকেও যুগ্মসচিব পদে নিয়ে এসেছেন মোদী। যিনি শেষ বার ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’ আয়োজনের দায়িত্বে ছিলেন। আগামী দিনে তাঁকে ইডি-র মতো কোনও সংস্থার শীর্ষ পদে বসানো হবে বলে সরকারি সূত্রের খবর।
এর আগে গুজরাত থেকে নির্বাচন কমিশনে নিয়ে আসা হয়েছিল আচল কুমার জোতিকে। যিনি মোদী মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন গুজরাতের মুখ্যসচিব ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর দফতরেও পি কে মিশ্র, অরবিন্দ কুমার শর্মার মতো বহু দিনের মোদীর আস্থাভাজনদের ভিড়। এই অরবিন্দই সানন্দে ন্যানোর কারখানা নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। এখনও প্রধানমন্ত্রীর দফতরের তরফে তিনি শিল্পমহলের সঙ্গে সমন্বয়ের কাজটি করছেন। গুজরাতের আর এক অফিসার বিজয়লক্ষ্মী জোশীকেও এখন পানীয় জল সরবরাহ ও নিকাশি মন্ত্রকের দায়িত্বে বসানো হয়েছে।
দু’দিন আগে ১৬টি পদে রদবদলের পরে গত কালও একগুচ্ছ অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্মসচিব পদে রদবদল হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারের একমাত্র এক জন অফিসারই গুরুত্বপূর্ণ পদে এসেছেন। ১৯৮৩ ব্যাচের অতনু পুরকায়স্থ এত দিন দিল্লির রেসিডেন্ট কমিশনার দফতরে ওএসডি পদে ছিলেন। তাঁকে কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনের সচিব পদে নিয়োগ করা হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy