নয়াদিল্লিতে বৈঠক শুরুর আগে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে মার্কিন বিদেশসচিব জন কেরি। ছবি: পিটিআই।
তখন ইউপিএ জমানা। রাষ্ট্রপতি ভবনে এক অনুষ্ঠানে পৌঁছে সনিয়া গাঁধী দেখলেন, চশমা আনতে ভুলে গিয়েছেন। অনুষ্ঠানসূচি পড়বার জন্য তখন পাশে বসা লালকৃষ্ণ আডবাণীর চশমাটি চেয়ে নিলেন কংগ্রেস সভানেত্রী।
আডবাণীর বই বেরোল। সেই বই উপহার দিতে সনিয়ার বাড়ি চলে এলেন প্রবীণ বিজেপি নেতা। আবার সংসদে আডবাণীর অফিসে গিয়ে তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে এলেন রাহুল গাঁধী। অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে বাড়াবাড়ি রকম ঘনিষ্ঠতা ছিল না গাঁধী পরিবারের। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিরোধী দলনেত্রীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে নিয়েছিলেন বাজপেয়ী। তাঁর আমন্ত্রণে সনিয়াও গিয়েছিলেন সাত নম্বর রেস কোর্সে।
তা বলে কি সংসদ অচল হয়নি? ইউপিএ জমানার শেষ দিকে একের পর এক ইস্যুতে লোকসভা স্তব্ধ করে রেখেছিল বিজেপি। একাধিক মন্ত্রীর ইস্তফা আদায় করে ছেড়েছিল তারা।
সে দিনের বিরোধী দলই আজ শাসকের আসনে। আড়াই সপ্তাহ হয়ে গেল, সংসদ অচল। বিজেপির মন্ত্রীদের ইস্তফার দাবি দিয়ে যে অচলাবস্থার শুরু, কংগ্রেসের ২৫ জন সাংসদের বহিষ্কারে তা চরম তিক্ততায়
পৌঁছেছে। কিন্তু সে জটমুক্তির দিশা আপাতত দূর অস্ত্।
কেন? রাজধানীর একাধিক নেতা ও বিশেষজ্ঞ বলছেন, আগে রাজনীতি থাকত রাজনীতির জায়গায়। তার আঁচ পড়ত না ব্যক্তিগত সম্পর্কে। কিন্তু এখন শাসক ও বিরোধী পক্ষের দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে কার্যত কোনও যোগাযোগই নেই। ফলে রাজনৈতিক বিরোধ পেরিয়ে আন্তরিকতার কোনও পরিবেশ তৈরি হয়নি। সংসদ স্তব্ধ হওয়া এরই অন্যতম উপসর্গ।
সংসদের চলতি অধিবেশনের প্রথম দিনে সনিয়ার আসনের দিকে সৌজন্যের সম্ভাষণ নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু সনিয়ার শীতল প্রতিনমস্কারই বুঝিয়ে দিয়েছিল সম্পর্কের কাঠিন্য। যে প্রসঙ্গে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি পরে বলেছিলেন, ‘‘সৌজন্য কৃত্রিম হলে তা ধরা পড়ে যায়।’’ কংগ্রেস ও বিজেপি— উভয় পক্ষের নেতারাই কবুল করছেন, দুই কান্ডারির কথাই হয় না। মোদী কথা বলতে চান না সনিয়ার সঙ্গে। আর মোদীর ‘ঔদ্ধত্য’ দেখে সনিয়াও আগ্রহী নন সরাসরি আলোচনায়।
গত কাল নাগা চুক্তি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বাকি সব দলের নেতাদের পাশাপাশি সনিয়ার সঙ্গেও এক প্রস্ত কথা বলেছিলেন। কিন্তু সংসদের অচলাবস্থা কাটাতে? নৈব নৈব চ। এই জড়তাই অতীতে ছিল না। বিজেপির এক নেতার অবশ্য যুক্তি, সংসদ চালানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী আগ বাড়িয়ে সনিয়ার সঙ্গে কথা বলতে চান না ঠিকই। তাঁর হয়ে বেঙ্কাইয়া নায়ডু সনিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু ও-দিক থেকে তেমন সাড়া আসেনি। কংগ্রেসের অন্য নেতাদের মাধ্যমে বার্তা পাঠাতে গেলেও বরাবর জবাব এসেছে, ‘ম্যাডাম’ কোনও সমঝোতায় যেতে রাজি নন। এ ব্যাপারে আরও বেশি অনড় রাহুল গাঁধী।
কী বলছেন কংগ্রেসের নেতারা? তাঁদের বক্তব্য, যে বিজেপি এত সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গড়েছে, তাদেরই তো আরও উদার হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ক্ষমতায় আসার প্রথম দিন থেকে মোদীর প্রতিটি আচরণ বুঝিয়ে দিচ্ছে, তিনি কাউকে ধর্তব্যের মধ্যে আনেন না। সে তিনি বিজেপির নেতাই হোন বা অন্য কোনও দলের। আডবাণীর মতো প্রবীণকে তিনি পদে পদে হেয় করছেন। এনডিএ-র বৈঠকে পর্যন্ত ডাকছেন না। আডবাণীর উপায় নেই, তাই সেটা মেনে নিচ্ছেন। কিন্তু এমন ‘ধরাকে সরা জ্ঞান করা’ মনোভাব সনিয়া কেন বরদাস্ত করবেন?
বস্তুত, দশ জনপথ ঘনিষ্ঠ সূত্রের বক্তব্য, গোড়া থেকেই মোদী সরকার বিরোধীদের দুরমুশ করার কর্মসূচি নিয়েছে। বাজপেয়ী জমানাতেও এমন হয়নি। ২০১৪-র লোকসভা ভোটে পর্যাপ্ত আসন না পেলেও সৌজন্যের খাতিরে কংগ্রেসকে বিরোধী দলনেতার পদ দিতে পারতেন মোদী। অথচ সেই উদারতা তিনি দেখাননি। এখন বিরোধীদের সংসদে বলতেও দেওয়া হয় না। জমি বিল নিয়ে গোড়া থেকেই অর্ডিন্যান্সের পর অর্ডিন্যান্স চাপিয়ে এসেছে কেন্দ্র। তার পর রয়েছে ২৫ সাংসদের সাসপেনশন। কংগ্রেস নেতাদের মতে, বিরোধী দল বিরোধিতা করবেই। সেটাই নিয়ম। কিন্তু মোদী নিজে তো সনিয়া-রাহুলের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারতেন! কাজের খাতিরেও তো একটা সম্পর্ক তৈরি করা যায়। কিন্তু মোদী সে পথেই হাঁটেননি। ফলে বিকল্প সমঝোতার জায়গাটা বন্ধই হয়ে গিয়েছে।
স্বাভাবিক ভাবেই এই অভিযোগ মানেনি বিজেপি। দলের এক নেতা জানালেন, সংসদ শুরুর আগে কংগ্রেস নেতাদের একাংশকে নথি-সহ বোঝানো হয়েছিল, বিজেপির কোনও মন্ত্রীই ‘অপরাধ’ করেননি। তাই কেউ ইস্তফা দেবেন না। বরং কংগ্রেস তদন্তের দাবি তুলুক। তদন্ত হবে। প্রয়োজনে সংসদের যৌথ তদন্ত কমিটিও গঠন হবে। কিন্তু বিজেপির এই প্রস্তাব যখন দশ জনপথে পৌঁছয়, তখন পত্রপাঠ সেটি খারিজ হয়ে যায়। সেটাও মূলত শীর্ষ দুই নেতার সম্পর্কের কাঠিন্যের কারণেই।
তার পর থেকে চলছে এসপার-ওসপার লড়াই। এখন দেখার স্নায়ুযুদ্ধে কিস্তিমাতটি কে করেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy