স্থলসীমান্ত চুক্তির সংশোধনী নিয়ে অসমবাসীর ক্ষোভের মুখে সাবধানে এগোতে চাইছে কেন্দ্র। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে আগামী মে মাসে করিমগঞ্জ ও ধুবুরির বিতর্কিত এলাকা পরিদর্শনে আসছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। তার আগে, এপ্রিলে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহও অসমে আসছেন। আগামী বছর রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে রাজ্যের ছ’টি উপজাতিকে তফশিলভুক্ত উপজাতির মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে যেমন সাবধানে এগোচ্ছে বিজেপি, তেমনই স্থলসীমান্ত চুক্তির সংশোধনী নিয়েও কোনও তাড়াহুড়ো করতে চাইছে না নরেন্দ্র মোদীর সরকার।
লোকসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যের ছ’টি জনগোষ্ঠীকে ‘এসটি’ হিসেবে ঘোষণা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন খোদ নরেন্দ্র মোদী। রাজনাথ সিংহ অসমে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করে গিয়েছিলেন, রাজ্যের মাটি কোনও ভাবে বাংলাদেশকে দেওয়া হবে না। গড়তে দেওয়া হবে না বৃহৎ নদীবাঁধও। কিন্তু কেন্দ্রে সরকার গড়ার পর কার্যত সব ক’টি ক্ষেত্রেই বিজেপি একেবারে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে, ইউপিএ সরকারের রাস্তাতেই হাঁটতে বাধ্য হয়েছে। এ নিয়ে অসমে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়েছে। এরপর দিল্লি নির্বাচনের ইস্তাহারে উত্তর-পূর্বের মানুষকে ‘বিদেশি’ বলা নিয়েও তুমুল বিক্ষোভ দানা বাঁধে। স্বাভাবিক ভাবেই রাজনীতির কারণেই এতে মদত দিচ্ছে শাসক কংগ্রেসও। রাজ্য থেকে বাংলাদেশি বিতাড়নে বিজেপির ব্যর্থতাও কংগ্রেস বড় করে দেখাচ্ছে। বিজেপির ব্যর্থতাগুলি নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রদেশ কংগ্রেস ‘প্রতারণা দিবস’ পালন করেছে। এই অবস্থায়, আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে ছয় জনগোষ্ঠীকে তফশিল উপজাতির মর্যাদা দেওয়া ও স্থলসীমান্ত চুক্তি বিজেপির কাছে অগ্নিপরীক্ষার সমান।
ইতিমধ্যে রাজ্য সরকার বিধানসভায় জানিয়েছে, বাংলাদেশের কাছ থেকে রাজ্য ৭১৪ একর জমি পাবে। বদলে দিতে হবে প্রায় ২৬৮ একর জমি। বাংলাদেশের জমিতে বসবাসকারী না থাকায় বাংলাদেশি নাগরিকের বোঝাও অসমকে বইতে হবে না। কিন্তু ছিটমহল নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও মেঘালয়ে তেমন বিরোধিতা না থাকলেও অসমে অগপ, আসু, কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতি-সহ বিভিন্ন দল-সংগঠন স্থলসীমান্ত চুক্তি সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনী বিলের বিরোধিতা করছে।
এই পরিস্থিতিতে তফশিল মর্যাদা দেওয়া, রাজ্যে নাগরিক পঞ্জি সংশোধন নিয়ে বিতর্ক, অসমীয়ার সংজ্ঞা ঘিরে তৈরি হওয়া জটিলতা ও স্থলসীমান্ত চুক্তির সংশোধনী নিয়ে জনরোষের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে অবগত করতে রাজ্য বিজেপির বরাক ইউনিটের একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি দিল্লি গিয়েছেন। কেন্দ্রীয় ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালের নেতৃত্বে তাঁরা কাল রাজনাথের সঙ্গে বৈঠক করেন। প্রতিনিধি দলের সূত্রে জানা গিয়েছে, আলোচনা পরে মে মাসে অসমের করিমগঞ্জ ও ধুবুরি সফরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রাজনাথ। তিনি বিজেপি প্রতিনিধিদের আশ্বাস দেন, নাগরিক পঞ্জি সংশোধনের সময় বাংলাদেশ থেকে আশ্রয় নেওয়া হিন্দু বাঙালিরা যাতে বঞ্চিত না হয়, তা তিনি দেখবেন।
এ দিকে, ছ’টি জনগোষ্ঠীকে তফশিল উপজাতির মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না বলে রাজ্যে খবর ছড়াবার পরে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিধানসভায় এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে স্পিকার প্রণব গগৈ জানান, বিষয়টি নিয়ে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কেন্দ্রীয় উপজাতি উন্নয়ন মন্ত্রী জুয়েল ওরাম জানিয়েছেন, কেন্দ্র এমন সিদ্ধান্ত নেয়নি। বিষয়টি রেজিস্ট্রার জেনারেলের দফতরে বিচারাধীন। কিন্তু দলীয় সূত্রে খবর, যে যুক্তিতে ইউপিএ আমলে এই ছ’টি জনগোষ্ঠীকে ‘এসটি’ তালিকাভুক্ত করা যায়নি, সেই একই কারণে এবারেও সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু রাজ্যে চা-জনগোষ্ঠীর মিলিত জনসংখ্যা প্রায় ৬০ লক্ষ। ছ’টি জনগোষ্ঠী মিলিয়ে সংখ্যাটি প্রায় দেড় কোটি। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে তাই এ নিয়ে সিদ্ধান্ত ঝুলিয়ে রাখার পক্ষপাতী দল।
দু’দশক ধরে তফশিল উপজাতিভুক্ত হওয়ার জন্য অসমের মরাণ, মটক, কোচ-রাজবংশী, চা-গোষ্ঠী, চুটিয়া ও তাই-আহোম জনগোষ্ঠীগুলি লড়াই চালাচ্ছে। রাজ্য সরকার নীতিগত ভাবে তাদের দাবিতে সম্মতিও জানিয়েছে। আলফার শান্তি আলোচনার অন্যতম শর্তও এই ছয় জনগোষ্ঠীকে তফশিল উপজাতিভুক্ত করা। রাজ্য সরকারের তরফে এর আগে দু’দফায় এই প্রস্তাব দিল্লিতে পাঠালেও দাবিটি নাকচ হয়ে যায়। রেজিস্ট্রার জেনারেলের দফতর জানায়, এই বিষয়ে যে নির্দিষ্ট নিয়ম ও শর্ত মেনে চলা হয়, ওই ছ’টি গোষ্ঠী তা পূরণ করতে পারেনি। কেন্দ্র জানিয়েছিল, রাজ্যে চা-জনগোষ্ঠী বলে যারা পরিচিত তারা আদতে ভিন রাজ্য থেকে আসা মুন্ডা, ওঁরাও, সাঁওতাল-সহ ৯৭টি ভিন্ন জনগোষ্ঠীর সমষ্টি। এদের মধ্যে অনেকেই ‘ওবিসি’ তালিকাভুক্ত। কোনও গোষ্ঠীকে ‘এসটি’ তালিকাভুক্ত করতে গেলে পাঁচটি শর্ত বিচার করতে হয়। তার মধ্যে রয়েছে তাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, আদিম উৎস, ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা, অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগহীনতা ও সামগ্রিক অনুন্নয়ন। কিন্তু অসমের এই জনগোষ্ঠীগুলি সেই সব শর্ত পূরণ করতে পারেনি। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের আগে মোদী নিজে অসমের প্রচারে এসে ছ’টি জনগোষ্ঠীকে তফশিল উপজাতির মর্যাদা দেওয়ার প্রতিশ্রতি দিয়েছিলেন। দিল্লিতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে কাজও এগোয়। গত বছর তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রসচিব অনিল গোস্বামী এ নিয়ে ইতিবাচক একটি রিপোর্টও তৈরি করেন। সেখানে আগের শর্তে অদল-বদল করে, নতুন কিছু শর্ত যুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy