ব্রহ্মপুত্রের পারে সকাল থেকে জোর লড়াই দুই রাজধানীর মধ্যে। এক দিকে, অসমের বর্তমান রাজধানী দিসপুর-গুয়াহাটি। অন্য দিকে, মটক-মরাণ আমলের রাজধানী তিনসুকিয়া। কোন শহর রাজ্যের একমাত্র ‘স্মার্ট সিটি’ হয়ে উঠবে তাই নিয়েই যুদ্ধ।
কেন্দ্র দেশের ১০০টি শহরকে স্মার্ট সিটি হিসেবে গড়ে তোলার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। জনবিন্যাস, নাগরিকদের অনুপাত-সহ বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখে রাজ্যের ভাগ্যে পড়েছে মাত্র একটি শহর। গুয়াহাটি, তিনসুকিয়া, শিলচর, যোরহাট, তেজপুর, গোলাঘাট, গোয়ালপাড়া, উদালগুড়ি, টংলার নাম প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হয়েছিল। এরমধ্যে দৌড়ে এগিয়েছিল গুয়াহাটি ও তিনসুকিয়া। প্রথমে তরুণ গগৈ জানিয়েছিলেন, কেবলমাত্র গুয়াহাটির নামই চূড়ান্ত করেছে কেন্দ্র। বাকি সাতটি
শহরকে অটল মিশন ফর রিজুভিনেশন অ্যান্ড আরবান ট্রান্সফর্মেশন বা অম্রুত প্রকল্পের অধীনে আনবে কেন্দ্র। কিন্তু সম্প্রতি দিল্লি থেকে খবর ছড়ায়, গুয়াহাটি নয়, স্মার্ট সিটি হিসেবে তিনসুকিয়ার নামই চূড়ান্ত হয়েছে। জিএমডিএ চেয়ারম্যান ধীরেন বরুয়া, মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়, তিনসুকিয়ার জেলাশাসক বা দুলিয়াজানে থাকা অয়েল ইন্ডিয়ার কর্তারাও সকলে তাই জানেন। তার ভিত্তিতে, গাড়ি ছেড়ে মোটর সাইকেলে চেপে তিনসুকিয়া শহর চষে ফেলেন জেলাশাসক পুরু গুপ্ত। শহরের উন্নয়নে কী কী করতে হবে ছবি-সহ তার বিবরণ নথিবদ্ধ
করেন তিনি।
এদিন গুয়াহাটিতে স্মার্ট সিটি নিয়ে উত্তর-পূর্বে প্রথম সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেখানে বক্তা হিসেবে হাজির ছিলেন মুখ্যসচিব ভি কে পিপারসেনিয়া, স্মার্ট সিটি কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর প্রতাপ পড়োড়ে, ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অফ সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রিজের ডিজি গুলশন শর্মা, উইপ্রোর স্মার্ট সিটি বিভাগের প্রধান রাজ বি আর, কানাডা ট্রেড কমিশনের ট্রেড কমিশনার অর্জুন দত্ত, অয়েলের চিফ ম্যানেজার উত্পল নাথ, ধীরেন বরুয়া, পুরু গুপ্ত-সহ অনেকে।
আইসিসির ডিজি রাজীব সিংহ জানান, ‘‘প্রথম বছর ২০টি শহরকে স্মার্ট সিটি করা হবে। তারা ৫ বছর ধরে নগরোন্নয়ন বাবদ ১০০ কোটি টাকা করে পাবে। পরের দু’বছর আরও ৪০টি করে শহরের নাম ঘোষণা করবে কেন্দ্র। প্রতি রাজ্য থেকে নির্বাচিত শহরগুলিকে এই চূড়ান্ত ১০০টি শহরের তালিকায় ঠাঁই করে নিতে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। কানাডার কিছু সংস্থা এই কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে।’’
বক্তারা উন্নততর তথ্য-প্রযুক্তি ভিত্তিক কাঠামো, নগরব্যবস্থা, বিনোদন, নিকাশি, পরিবহণের দিকগুলি তুলে ধরেন। তবে মুখ্যসচিব পিপারসেনিয়া বলেন, ‘‘স্মার্ট সিটির দর্শনে সংস্কৃতিকে সে ভাবে স্থান না দেওয়া এক বড় দুর্বলতা। প্রতিটি শহরের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। তাকে মাথায় রেখেই নতুন মডেল তৈরি করা দরকার। কেবল উপার্জন ও উন্নয়নকে মাথায় রাখার ফলেই শহরগুলিতে নগর পরিকল্পনা শিকেয় উঠেছে।’’ গুলশন শর্মাও বলেন, ‘‘স্মার্ট কাঠামোর চিন্তায় কেবল তথ্য-প্রযুক্তি নয়, মানব সম্পদ বিকাশেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।’’ তাঁর কথায়, প্রথম ধাপে, রাজ্য ও উত্তর-পূর্ব থেকে বিদেশে থিতু হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে জন্মভূমির উন্নয়নের স্বার্থে তাদের সাহায্য ও পরামর্শ নেওয়া হোক। রাজ্যের শিক্ষকদের অনেকেই এখনও ল্যাপটপ বা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন না। তাঁদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। না হলে বাইরে থেকে স্মার্ট তকমা লাগালেও ভিতরে গলদ থেকেই যাবে।
তিনসুকিয়ার জেলাশাসক শহরের আবর্জনা, ফুটপাথ দখল করে দোকান, পার্কিং, দুর্গন্ধময় পরিবেশ, খারাপ রাস্তা, বস্তি-সহ দুর্বলতার বিভিন্ন দিক ছবি-সহ দেখান। জানান, ‘‘গত দশ বছরে তিনসুকিয়া পুরসভা নগরোন্নয়নে মাত্র ৩৫ কোটি টাকা খরচ করেছে।’’ তিনসুকিয়াকে স্মার্ট করতে গেলে কী প্রয়োজনও সেগুলিও তুলে ধরেন তিনি। একই ভাবে তিনসুকিয়ার উন্নয়নে অয়েল ইন্ডিয়া কী করেছে ও কী করতে চায় তা জানান উত্পল নাথ।
এখানেই ধীরেনবাবু প্রশ্ন তোলেন, কোন যুক্তিতে গুয়াহাটিকে বাদ দিয়ে তিনসুকিয়াকে স্মার্ট সিটি হিসেবে বেছে নেওয়া হল? তিনি বলেন, ‘‘হতে পারে আমি বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু সাধারণ বুদ্ধিতে সকলেই জানেন, কেবল অসম নয়, গোটা উত্তর-পূর্বের প্রাণকেন্দ্র গুয়াহাটি। তার উন্নয়ন না করলে কোনও উন্নতি হবে না। তাহলে কীসের ভিত্তিতে তিনসুকিয়াকে প্রথম স্মার্ট সিটির সম্মান দেওয়া হল? যদি তিনসুকিয়াই যোগ্য স্থান হয়, তবে এই সমাবেশ কেন সেখানে না করে গুয়াহাটিতে করতে হচ্ছে?’’ তাঁর বক্তব্য, যাঁরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকুন, তাঁদের কোথাও ভুল হচ্ছে। সভায় হাজির অতিথিরাও তাঁর সমর্থনে হাততালি দেন।
কার্যত অপ্রস্তুত উদ্যোক্তারা জানান, তিনসুকিয়ার নাম মোটেই সরকারি ভাবে ঘোষণা করা হয়নি। রাজ্যের তরফে নাম প্রস্তাব করতে বলা হয়েছে। অগস্ট মাসে চূড়ান্ত ঘোষণা হবে। তখন তিনসুকিয়ার জেলাশাসক বলেন, ‘‘আমি তো জানতাম তিনসুকিয়াই স্মার্ট সিটি হবে!’’ ধীরেন বরুয়াও জানান, তিনি বা রাজ্য সরকারও তাই জানে।
প্রতাপ পাড়োড়ে জানান, পরিষেবার মান (২৫ নম্বর), প্রশাসনিক গঠন ও ক্ষমতা (১৫ নম্বর), স্বনির্ভরতা (৩০ নম্বর) ও আগের রেকর্ড ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা (৩০ নম্বর)-এর ভিত্তিতে নম্বর দিয়ে শহরগুলিকে বাছা হচ্ছে। স্মার্ট সিটি প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত কর্তারা জানান, যেহেতু এনডিএ সরকার অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি নিয়েছে, তাই মায়ানমার ও অরুণাচলের মধ্যে থাকা বাণিজ্য কেন্দ্র তিনসুকিয়ার দাবি বেশি। তা ছাড়া তিনসুকিয়ায় একদিকে তৈলক্ষেত্র রয়েছে, অন্য দিকে এখানেই রাজ্যের ১২ শতাংশ চা উত্পাদিত হয়। সেটিও তিনসুকিয়ার দাবিকে জোরদার করেছে। গুয়াহাটির আয়তন ও জনসংখ্যা অনেক বেশি। সেখানে কোনও কিছু নতুন করে ঢেলে সাজার মতো জায়গা নেই। মাত্র ১০০ কোটি টাকাও গুয়াহাটির জন্য পর্যাপ্ত নয়। সেই দিক থেকে মাত্র ১০ বর্গ কিলোমিটারের তিনসুকিয়ায় নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া ও তার রূপায়ণের সম্ভাবনা অনেক বেশি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy