Advertisement
০২ মে ২০২৪
National News

প্রেমিকার খুনিই এখন স্কুলের প্রিয় মাস্টারমশাই

রত্নাকর বাল্মিকী হয়ে উঠেছিলেন এই ভারতভূমিতে। এ মাটিতে আজও কিন্তু তেমনই গৌরব করার মতো ‘নবজন্ম’ ঘটে। দস্যু রত্নাকরের ‘জন্মান্তর’ হয়েছিল ঋষি এবং কবি বাল্মিকীতে। আর প্রেমিকাকে খুন করে জেলে যাওয়া উত্তরপ্রদেশের গৌরব বর্মা এখন শিক্ষার আলোয় আলোকিত করছেন নিজের দেশের ভাবী প্রজন্মকে।

ছাত্রছাত্রীদের মাঝে গৌরব বর্মা (নীল জামা)। ছবি সৌজন্য ইন্টারনেট।

ছাত্রছাত্রীদের মাঝে গৌরব বর্মা (নীল জামা)। ছবি সৌজন্য ইন্টারনেট।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৭ ১৬:০০
Share: Save:

রত্নাকর বাল্মিকী হয়ে উঠেছিলেন এই ভারতভূমিতে। এ মাটিতে আজও কিন্তু তেমনই গৌরব করার মতো ‘নবজন্ম’ ঘটে। দস্যু রত্নাকরের ‘জন্মান্তর’ হয়েছিল ঋষি এবং কবি বাল্মিকীতে। আর প্রেমিকাকে খুন করে জেলে যাওয়া উত্তরপ্রদেশের গৌরব বর্মা এখন শিক্ষার আলোয় আলোকিত করছেন নিজের দেশের ভাবী প্রজন্মকে। সিমলার শহিদ ভগত্ সিং মেমোরিয়াল স্কুলে রোজ জেল থেকে পৌঁছে যান গৌরব। পড়ানো শেষ করে আবার ফিরে যান জেলে।

ছোট থেকেই কৃতী ছাত্র গৌরব। পর পর ভাল রেজাল্ট করে ভর্তি হয়েছিলেন আইআইটি রুরকিতে। ২০১০ সাল, গৌরব তখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, হঠাত্ই ভয়ঙ্কর ভাবে ঘুরে যায় জীবনের মোড়। প্রেমিকা প্রগতি তিবরেওয়ালকে সঙ্গে নিয়ে সিমলা বেড়াতে যান। আর সেখানেই হোটেলের ঘরে প্রবল ঝগড়াঝাটির পর বিয়ারের বোতল মাথায় মেরে, গলা কেটে খুন করেন প্রগতিকে। হোটেল থেকে পর দিন দেহ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। আর গৌরব হরিয়ানায় পালিয়ে যান।


গৌরব ও প্রগতি।

নৃশংস এই খুনের ঘটনা তোলপাড় করেছিল গোটা দেশ। ধরা পড়েন গৌরব। নিজের অপরাধ কবুল করেন। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর তাঁর ঠিকানা হয় সিমলার কান্ডা মডেল সেন্ট্রাল জেল। সেটা বছর চারেক আগের কথা। হতাশায়, অপরাধবোধে ভেঙেচুরে ডুবে আছেন তখন। জীবনের কোনও অর্থ খুঁজে পাচ্ছেন না। তিলে তিলে জেলে পচে মরতে হবে সারা জীবন, এটাই যখন ভবিতব্য বলে ধরে নিয়ে সিমলার জেলে এলেন, এখানকার কিছুটা অন্য রকম পরিবেশ গৌরবের মনে এর মধ্যেই জীবন খোঁজার তাগিদ এনে দিল কিছুটা। স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে অন্য কয়েদিদের পড়াতে শুরু করে দেন।


ধরা পড়ার পর গৌরব।

২০১৫-য় ওই সিমলায় বদলি হয়ে আসেন ডিজি সোমেশ গয়াল। সব কয়েদিদের রেকর্ড ঘাঁটতে ঘাঁটতে চোখ আটকে যায় গৌরবের রেকর্ডে গিয়ে। এ ভাবে এক জন মেধাবী ছাত্র জেলে পচে মরবে! এই ভেবেই গৌরবকে ডেকে আরও ভাল ভাবে তাঁর মেধার সদ্ব্যবহার করার পরামর্শ দেন গয়াল। কয়েদিদের পড়ানোর পাশাপাশি তাঁদের কম্পিউটার শেখানো, এমনকী কয়েদিদের তৈরি জিনিস অনলাইনে বিক্রির জন্য তাঁর মেধাকে কাজে লাগান কারাকর্তা।

আরও খবর: ভাঁওয়ারি দেবী বেঁচে, কোর্টে দাবি বান্ধবীর

এভাবেই আরও একটা সুযোগ এসে গেল গৌরবের জেল জীবনে। প্রজাতন্ত্র ও স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে জেলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গত বছর তেমনই অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিল সিমলার শহিদ ভগত্ সিং মেমোরিয়াল স্কুলের পড়ুয়ারা। স্কুল কর্তৃপক্ষও ছিলেন সেখানে। জেলে এক জন মেধাবী ছাত্র রয়েছেন এ কথা স্কুল কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছয়। কারাকর্তার কাছ থেকে খোঁজ নেন তাঁরা। গয়াল গৌরবের ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে সব জানান। তাঁকে স্কুলে শিক্ষকতা করতে পাঠানোর চেষ্টা করতে পারেন বলেও জানান। কিন্তু যাঁর পরিচয় এক জন খুনি, তাঁকে কি শিক্ষক হিসাবে গ্রহণ করতে রাজি হবে পড়ুয়া এবং তাদের অভিভাবকরা? এ ব্যাপারে অবশ্য খুব একটা বেগ পেতে হয়নি স্কুল কর্তৃপক্ষকে। পড়ুয়া থেকে অভিভাবক সকলেই গৌরবকে স্বীকার করে নেন। ২০১৭-র ফেব্রুয়ারিতে পাকাপাকি ভাবে স্কুলের শিক্ষকতার পদে যোগ দেন গৌরব। আর এখান থেকেই তাঁর নতুন জীবনের পথ চলা শুরু। স্কুলে পদার্থবিদ্যা ও অঙ্ক পড়ান গৌরব। জীবনের অঙ্কে বড় ভুল করে ফেললেও, নতুন জীবনের পাঠটা কিন্তু নতুন উত্সাহের সঙ্গেই করে চলেছেন। আর সেই সুবাদে হয়ে উঠেছেন সকলের প্রিয় শিক্ষক। সকাল সকাল স্কুলে এসে পড়ানো, আর সন্ধ্যা হলেই জেলে ফিরে যাওয়া— এটাই এখন গৌরবের নিত্য দিনের রুটিন। শিক্ষকের পুরনো পরিচয় এক জন খুনি, এর পরেও সেটা মেনে নিতে অসুবিধা হচ্ছে না? স্কুল কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রী সবাই এক বাক্যে বলেছেন, ‘মোটেই না।’ উল্টে সদর্পে তাঁরা জানান, এমন এক জন শিক্ষক পেয়ে উচ্ছ্বসিত সবাই। গর্বিতও বটে! একটা ঘটনা তাঁর জীবনকে কালিমালিপ্ত করেছিল ঠিকই, কিন্তু স্কুলের সকলে তাঁর ‘নবজন্ম’কেই নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন।


এই জেলই ঠিকানা গৌরবের।

ছাত্রদের পড়ানোর পাশাপাশি, নিজেও এখন চুটিয়ে পড়াশোনা করছেন গৌরব। জীবনের নতুন মোড়ে দাঁড়িয়ে তাঁর কথা, নিজে সাফল্য ধরে রাখতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু অন্য ছেলেমেয়েদের সফল করতে কোনও ক্রুটি রাখতে চান না। বলেন, “ঘটনাচক্রে আমি এক জন শিক্ষক হয়েছি। কিন্তু এই শিক্ষকতাই আমার প্রায়শ্চিত্ত। নিজে পারিনি। কিন্তু বাকি ছেলেমেয়েদের আআইটি-র জন্য তৈরি করব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE