কানহাইয়া কুমারকে কেন্দ্র করেই বিভেদটা তৈরি হয়েছিল। আজ নারীদিবসকে সামনে রেখে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজেপির ছাত্র সংগঠন এবিভিপি-র ভিতরকার দ্বন্দ্ব আরও খানিকটা তীব্র হল বলেই মনে করা হচ্ছে।
বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবার হিন্দুশাস্ত্রের আদর্শকে তুলে ধরতে যে মনুস্মৃতির কথা আওড়ায়, আজ সেই প্রতীকী ভাবে সেই মনুস্মৃতিই পুড়িয়ে দিল জেএনইউ-এর এবিভিপি সংগঠনের একাংশ। তিহাড় জেল থেকে ক্যাম্পাসে ফিরে ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমার যে মনুবাদের থেকে আজাদি চেয়ে স্লোগান দিয়েছিলেন, আজ মনুবাদী এবিভিপি-র বহু সদস্যই মনুর বহ্ন্যূৎসবে যোগ দিলেন।
মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা সম্ভবত ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বার পোড়ানো বই। জাতপাত এবং বর্ণভেদ ব্যবস্থাকে শক্ত ভিতে দাঁড় করানোয় মনুস্মৃতির বিশেষ ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়। ১৯২৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর বি আর অম্বেডকর মনুস্মৃতি পুড়িয়েছিলেন। সেই থেকে দিনটি দলিতদের কাছে ‘মনুস্মৃতি দহন দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত এবং পালিত।
পরবর্তী কালে বহুজন সমাজ পার্টির তরফেও অনেক বার মনুস্মৃতি পোড়ানো হয়েছে।
আবার নারী আন্দোলনের চোখেও মনুস্মৃতির ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক এবং নিন্দা কম নয়। কারণ মনুর শাস্ত্রে নারীকে নরকের দ্বার হিসেবে দেখানো হয়েছে। নারীর প্রতি পুরুষের পূর্ণাঙ্গ কর্তৃত্বের বিধান রয়েছে। সেই কারণেই নারীদিবসকে মনুস্মৃতি পোড়ানোর দিন হিসেবে বেছে নিয়েছিল জেএনইউ। আজ সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়-প্রশাসনের নির্দেশ অমান্য করেই মনুসংহিতার প্রায় ৪০টি পাতা পোড়ান জনা ষাটেক ছাত্র। উপস্থিত ছিলেন এবিভিপির একাধিক ছাত্র নেতা ও সদস্য। জেএনইউয়ের এবিভিপি সংগঠনের সহ-সভাপতি যতীন গোরাইয়া বলেন, ‘‘মনুসংহিতায় মেয়েদের স্থান ভীষণ হীন ভাবে দেখানো হয়েছে। বাবাসাহেব অম্বেডকরও মনুসংহিতার বিরুদ্ধে সরব ছিলেন।’’
কিন্তু প্রশ্ন হল, বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবারের ছাত্র সংগঠন মনুস্মৃতি পোড়ায় কী ভাবে? তাদের তো মনুবাদে অচলা ভক্তি রাখারই কথা। এর ব্যাখ্যায় উঠে আসছে দু’টি তত্ত্ব। একটি গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের, অন্যটি দু’মুখো কৌশলের।
জেএনইউ সূত্রের খবর, হায়দরাবাদে রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা এবং দেশদ্রোহের অভিযোগে কানহাইয়া কুমারের গ্রেফতারের ঘটনায় জেএনইউ-এর এবিভিপি-তে কার্যত বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছে। প্রদীপ নারওয়াল, রাহুল যাদব এবং অঙ্কিত হংস নামে তিন ছাত্রনেতা সংগঠন ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন। আর এক নেতা যতীন গোরাইয়াও দোনামনায় আছেন। তিনিই এ দিনের বই পোড়ানোর হোতা। তাঁর কথায়, মনুকে নিয়ে এবিভিপি-র ভিতরে অনেক দিন ধরেই বিরোধ চলছে। কানহাইয়া নিজেও তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, জেএনইউ-এর এবিভিপি বাইরের এবিভিপি-র চেয়ে অনেকটা আলাদা। সূত্রের মতে, জেএনইউ-তে এবিভিপি খুব শক্তিশালী নয়। এ বারই ছাত্র সংসদে একটি আসন দখল করতে পেরেছে তারা। এই অবস্থায় জেএনইউ-এর মূলধারা থেকে খুব উল্টো সুর গাওয়াটা তাদের পক্ষে মুশকিল। আজ যারা মনুসংহিতা পোড়াতে এসেছিলেন তাঁরা নিজেদের এবিভিপি-র সদস্য বলে পরিচয়ও দিতে চাননি। যতীনের বক্তব্য, ‘‘আমি ব্যক্তি হিসেবে প্রতিবাদ করতে এসেছি।’’ এবিভিপি-র যে অংশটি এই কর্মসূচিতে থাকেনি, তাদের এক নেতা সৌরভ শর্মা বলেন, ‘‘কেউ মনুস্মৃতি পোড়াতে চাইলে পোড়াবেন। এগুলো ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা।’’
ব্রাহ্মণ্য আইনবিধির আকরগ্রন্থ মনুস্মৃতি। মনু কোনও এক জন ব্যক্তি নন। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী সাতটি জাতির আদি পুরুষ সাত মনু। মনুস্মৃতি মনুর নামাঙ্কিত সংকলন। ব্রাহ্মণ্য আইন-রীতি-কর্তব্যকে বিধিবদ্ধ করাই এর উদ্দেশ্য। কারও মতে, মনুস্মৃতি বর্তমান চেহারায় পৌঁছেছে ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। আবার কারও মতে, ৯০০ খ্রিস্টাব্দের কিছু আগে এই সঙ্কলনের নির্মাণ, যা ধর্মশাস্ত্র বা মনুসংহিতা নামেও পরিচিত। পরবর্তী কালে জাতপাত এবং লিঙ্গবৈষম্যের প্রশ্নে মনুস্মৃতি বিতর্কের মুখে পড়েছে। নারী বাল্যে পিতার, যৌবনে স্বামীর, ও বার্ধক্যে পুত্রের অধীন-এর মতো বহুচর্চিত শ্লোক মনুস্মৃতিতেই আছে।
৯ ফেব্রুয়ারি আফজল গুরুকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠানেই দেশ-বিরোধী স্লোগান উঠেছিল বলে অভিযোগ। সেই ঘটনার জেরেই কানহাইয়া গ্রেফতার হন। যেখানে ওই অনুষ্ঠানটি হয়েছিল, সেই সবরমতী ধাবার সামনেই আজ মনুস্মৃতি পোড়ে।
আর একটি মত অবশ্য বলছে, খুব ভেবেচিন্তেই এ দিন বই পোড়ানোর ডাক দেওয়া হয়েছিল। এবিভিপি-র মধ্যে দুই গোষ্ঠীর দূরত্ব রেখে চলাটাও সেই কৌশলেরই অঙ্গ। প্রকাশ্যে এবিভিপি-র কট্টর অংশটি যেমন মনু পোড়ানো সমর্থন করেনি, তেমনই প্রকাশ্য বিরোধিতাতেও নামেনি। কারণ রোহিত এবং কানহাইয়াকে কেন্দ্র করে বিজেপি যে ভাবে মুখ পুড়িয়েছে, এ দিন তার থেকে খানিকটা পরিত্রাণের উপায় খুঁজতেই মনুস্মৃতি পোড়ানোর মতো কর্মসূচি মেনে নেওয়া হয়েছে। কানহাইয়া ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে রোহিতকে নিজের আইকন মেনেছেন। বারবার মনুবাদ নিয়ে বিজেপিকে খোঁচা দিয়েছেন। এ সবের ফলে দলিত শিবিরে বিজেপির জমি কিছুটা হলেও আলগা হয়েছে বলে আশঙ্কা। এই পরিস্থিতিতে আজ মনুসংহিতা পুড়িয়ে দলিতদের বার্তা দেওয়ার একটা চেষ্টা করা হয়েছে। পাশাপাশি, নারীদিবসকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষিত সমাজের কাছেও নিজেদের প্রগতিশীল মুখ তুলে ধরার কথা ভাবা হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy