Advertisement
E-Paper

ডোভালই ডোবালেন পঠানকোটে

শুধু কয়েকটি ভুল। তারই মাসুল দিল দেশ! সময়: শুক্রবার সন্ধে ৭টা। পঠানকোটে সংঘর্ষ শুরু হতে তখনও আট ঘণ্টা বাকি। স্থান: দিল্লি। পঠানকোটে জঙ্গিরা ঢুকে পড়ায় হামলা রুখতে বৈঠকে বসেছেন সেনাপ্রধান দলবীর সিংহ সুহাগ ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। জঙ্গি হামলা রোখার জন্য সুহাগের কাছে মাত্র ৫০ জন সেনা চাইলেন ডোভাল।

অনমিত্র সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:৫২
পড়ে রয়েছে নিহত জঙ্গির দেহ। বুধবার পঠানকোটের বায়ুসেনা ঘাঁটিতে। ছবি: পিটিআই।

পড়ে রয়েছে নিহত জঙ্গির দেহ। বুধবার পঠানকোটের বায়ুসেনা ঘাঁটিতে। ছবি: পিটিআই।

শুধু কয়েকটি ভুল। তারই মাসুল দিল দেশ!

সময়: শুক্রবার সন্ধে ৭টা। পঠানকোটে সংঘর্ষ শুরু হতে তখনও আট ঘণ্টা বাকি।

স্থান: দিল্লি। পঠানকোটে জঙ্গিরা ঢুকে পড়ায় হামলা রুখতে বৈঠকে বসেছেন সেনাপ্রধান দলবীর সিংহ সুহাগ ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। জঙ্গি হামলা রোখার জন্য সুহাগের কাছে মাত্র ৫০ জন সেনা চাইলেন ডোভাল।

সিদ্ধান্ত: সেনার সঙ্গে পাঠানো হবে ১৫০ জন এনএসজি কম্যান্ডোকেও।

পঠানকোট অভিযানের ময়নাতদন্ত বলছে, দীর্ঘস্থায়ী অভিযানের বীজটি পোঁতা হয়ে গিয়েছিল ওই একটি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তেই। ওই একটি ভুলের ফলে গোটা অভিযানের নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে, তা নিয়ে সেনাবাহনী, এনএসজি ও বায়ুসেনার বিশেষ কম্যান্ডো বাহিনী গরুড়ের মধ্যে তীব্র সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। শুরু হয় চাপানউতোর।

এরই প্রভাব পড়েছে গ্রাউন্ড জিরোতে। প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি বেড়েছে। দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে অভিযান। ভারতে জঙ্গি দমন অভিযানে এত বড় মাপের সমন্বয়হীনতার নজির খুব কম রয়েছে বলে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হচ্ছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।

অভিযান শেষে এখন নিরাপত্তা ও সমন্বয়ের প্রশ্নে নিরাপত্তাবাহিনীগুলির মধ্যে দিশাহীনতার কঙ্কালসার চেহারাটাই বিভিন্ন দিক থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ময়নাতদন্তে। গোটা কাণ্ডে একাধিক কেন্দ্রীয় কর্তা নিজেদের ভূমিকা পালনে কেবল অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন তা নয়, দায়িত্ব পালনে তাঁদের পিছিয়ে থাকাটাও পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে।

সমন্বয়ের প্রশ্নে ব্যর্থতার অভিযোগ উঠেছে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ডোভাল, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পর্রীকরের মধ্যেও। ফাঁকটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন খোদ রাজনাথ ও পর্রীকররাই। গত শনিবার রাতে অভিযান শেষ বলে রাজনাথের টুইটই বুঝিয়ে দিয়েছে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ঠিক তথ্য নেই। বা তাঁকে ভুল পথে চালানো হচ্ছে। ওই টুইট কেলেঙ্কারির পরে তাই আর পঠানকোট নিয়ে সে ভাবে মুখ খুলতে দেখা যায়নি রাজনাথকে। ঘটনাস্থলে যাওয়া বা দিল্লিতে থেকে পরিস্থিতি সামলানোর বদলে তিনি চলে যান অসমে। একই অবস্থা পর্রীকরের ক্ষেত্রেও। প্রথম তিন দিন কার্যত উধাও থাকার পরে গত কাল পঠানকোটে যান তিনি। ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন। প্রকাশ্যেই বলেন, ‘‘ঘাঁটির নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ত্রুটি ছিল।’’ খোদ প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এই মন্তব্যে অসন্তোষ ছড়িয়েছে সরকারের অন্দরে। প্রশ্ন তুলেছে বিরোধী কংগ্রেসও। গোটা অভিযানে যার দিকে সব থেকে বেশি অভিযোগের আঙুল উঠেছে, তিনি হলেন অজিত ডোভাল। তাঁর নেওয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন সেনাকর্তারাও।

এই সংক্রান্ত আরও খবর...
সীমান্তের গুরুদ্বারে সেই রাতেই প্রথম যান এসপি

অভিযানের নেতৃত্ব নিয়ে বেনজির সঙ্কট

দুই জঙ্গির খোঁজে চলছে তোলপাড়

অভিযানের ময়নাতদন্তে প্রথম যে প্রশ্নটি উঠেছে, তা হল, সেনাকে না দিয়ে অভিযানের দায়িত্ব এনএসজির হাতে তুলে দেওয়া হল কেন? গত তিন দশকে এই ধরনের সন্ত্রাসবাদী হামলা মোকাবিলার অভিযান হয়েছে সেনাবাহিনীরই নেতৃত্বে। এ বারই ঘটল ব্যতিক্রম। মূলত ডোভালের নির্দেশে শুক্রবার রাতেই ঘাঁটির দায়িত্ব হাতে তুলে নেন এনএসজি কম্যান্ডোরা।

প্রাক্তন সেনাকর্তা ভি পি মালিকের বক্তব্য, সাধারণত জঙ্গি দমনে সেনা ডাকা হলে তাদের হাতেই অভিযানের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে সেনার হাত থেকে দায়িত্ব এনএসজির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। আক্রমণের বদলে রক্ষণাত্মক ভূমিকায় দেখা যায় সেনাকে। পরে যার খেসারত দিতে হয়েছে। প্রাক্তন সেনাকর্তারা বলছেন, প্রাক্তন আমলা ডোভাল ভেবেছেন কম্যান্ডোরা প্রতি-আক্রমণে সব থেকে দক্ষ। তাই তাঁদের হাতেই দায়িত্ব তুলে দেওয়া হোক। দ্রুত জঙ্গি দমন সম্ভব হবে। কিন্তু তিনি সম্ভবত পরিবেশ–পরিস্থিতি, আক্রমণ রুখে কী ভাবে প্রতিআক্রমণ করা সম্ভব— এই সব তুল্যমুল্য বিচারের রাস্তায় হাঁটেননি। আর তাই প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেতা সুশীল শিন্দের প্রশ্ন, খবর পাওয়া সত্ত্বেই কেন পঠানকোট ক্যান্টনমেন্টের ৫০ হাজার সেনার মধ্যে কয়েক হাজার সেনা দিয়ে ওই বায়ুসেনা ঘাঁটি ঘিরে ফেলা হল না। তাঁর যুক্তি, তা হলে ওই হামলাই হতো না।

সেনাকর্তাদের মতেও, ডোভালের ভুল সিদ্ধান্তেই প্রথম থেকেই ধাক্কা খেয়েছে অভিযান। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকে সব পক্ষ। বসিয়ে রাখা হয় সেনাদের। সেনা সূত্র বলছে, এনএসজি কম্যান্ডোদের দক্ষতা নিয়ে তাদের কোনও সংশয় নেই। কিন্তু অভিযানের চরিত্র বুঝে যে তাদের ব্যবহার করা উচিত, সেই ব্যাকরণটাই মানেননি ডোভাল। স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ (এসএজি)-র যে কম্যান্ডোদের পঠানকোটে পাঠানো হয়েছে, তাঁরা ছোট এলাকায় দ্রুত আক্রমণে গিয়ে প্রতিপক্ষে নিকেশ করতে দক্ষ। পণবন্দি উদ্ধার বা বিমান ছিনতাইয়ের মতো ঘটনার মোকাবিলায় এঁদের জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু পঠানকোট ঘাঁটিতে অভিযান চলছে কয়েকশো একর এলাকা জুড়ে।

বড় এলাকা জুড়ে অভিযানের ক্ষেত্রে কম্যান্ডোদের চেয়ে সেনা জওয়ানরা বেশি পারদর্শী। সেনা তাই প্রথমেই স্পেশাল ফোর্স স্কোয়াড পাঠায় পঠানকোটে। যারা জঙ্গি দমনে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। কিন্তু তাদের লড়াইয়ে ব্যবহার করার বদলে ঘাঁটির বিমান, হেলিকপ্টার ও যুদ্ধ সরঞ্জামের পাহারায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। পরে যখন ডোভাল আরও ১৫০ সেনা চেয়ে পাঠান, তখনও তাঁদের মুখোমুখি লড়াইয়ে ব্যবহার করা হয়নি। সেনার মতে, ঠিক উল্টোটা অর্থাৎ সেনাকে লড়াইয়ে ও কম্যান্ডোদের পাহারার কাজে ব্যবহার করলে অনেক আগেই জঙ্গিদের নিকেশ করা যেত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ডোভাল যেহেতু এনএসজি-কে মূলত দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন, তাই সেনাকর্তারা সেই নির্দেশ অমান্য করার সাহস দেখাননি। কিন্তু দীর্ঘায়িত অভিযানে ৭টি প্রাণ বলিদানের পর সব শিবির থেকেই এখন আঙুল উঠছে ডোভালের দিকে।

MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy