Advertisement
১১ মে ২০২৪

সিবিআইকে দ্বিগুণ পুলিশ, ঘাটতি তবু বিপুল

টানাটানি লোকবলের। পশ্চিমবঙ্গে সারদা ও অন্যান্য অর্থলগ্নি সংস্থার কেলেঙ্কারির তদন্তে যত লোকবল দরকার, সিবিআইয়ের কাছে তা নেই। রাজ্যের কাছে চেয়েও যথেষ্ট সংখ্যায় পুলিশ অফিসার মিলছে না। সিবিআই যা চাইছে, রাজ্য দিতে চাইছে ঢের কম।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০১৫ ০৩:০০
Share: Save:

টানাটানি লোকবলের। পশ্চিমবঙ্গে সারদা ও অন্যান্য অর্থলগ্নি সংস্থার কেলেঙ্কারির তদন্তে যত লোকবল দরকার, সিবিআইয়ের কাছে তা নেই। রাজ্যের কাছে চেয়েও যথেষ্ট সংখ্যায় পুলিশ অফিসার মিলছে না। সিবিআই যা চাইছে, রাজ্য দিতে চাইছে ঢের কম। সিবিআইয়ের এই অভিযোগ শুনে সুপ্রিম কোর্ট আজ নির্দেশ দিয়েছে, রাজ্য সরকার যত জনকে দিতে রাজি হয়েছে, দিতে হবে তার দ্বিগুণ। কিন্তু তাতেও দেখা যাচ্ছে, বিপুল ঘাটতি থেকে যাচ্ছে সিবিআইয়ের লোকবলে। বিভিন্ন স্তরে ঘাটতির মাত্রাটা ৭৫ থেকে ১০০ শতাংশ!

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, শীর্ষ আদালতের রায় তাদের পক্ষে গেলেও আখেরে লাভটা কী হল সিবিআইয়ের? লাভ যে তেমন হল না এবং এ ভাবে লোক চেয়েচিন্তে যে সমস্যা মেটার নয়, সেটা মানছে শীর্ষ আদালতও। যে কারণে সিবিআইয়ের নিজস্ব প্রস্তুতি নিয়েও এ দিন প্রশ্ন তুলেছেন বিচারপতি টি এস ঠাকুর।

সারদা ও পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য অর্থলগ্নি সংস্থার তদন্তের জন্য রাজ্যের থেকে ৩৪০ জন পুলিশকর্মী চেয়েছিল সিবিআই। কিন্তু রাজ্য পুলিশ বাহিনীতেই যথেষ্ট লোক নেই— এই যুক্তি দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার মাত্র ২০ জন দিতে রাজি হয়েছিল। তা-ও ডেপুটেশনে নয়। শুধুমাত্র সিবিআইয়ের তদন্তে সাময়িক ভাবে সাহায্য করার জন্য। সিবিআইয়ের হয়ে কাজ করলেও তাঁদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে মমতা সরকারের হাতেই। কিন্তু সারদা কেলেঙ্কারিতে যেখানে রাজ্য প্রশাসন ও শাসক দলেরই রাঘববোয়ালরা অভিযুক্ত, সেখানে ওই সব পুলিশ অফিসারের উপরে ভরসা করা কি আদৌ সম্ভব! রাজ্য সরকারের হাতেই তো তাদের টিকি বাঁধা থাকছে। সিবিআইয়ের এই যুক্তি মেনে নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, ডেপুটেশনেই রাজ্যের পুলিশকর্মীদের সিবিআইয়ে পাঠাতে হবে।

বিচারপতি টি এস ঠাকুরের মন্তব্য, ‘‘থানায় বসে ঘুষ না নিয়ে ওঁরা এখানে এসে কাজ করুন।’’ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আইনজীবী কপিল সিব্বল মন্তব্য করেন, ‘‘সিবিআইয়ে এলে সে দিক থেকে (ওঁদের) আরও বেশি লাভ হবে।’’ বিচারপতি ঠাকুর বিস্ময় প্রকাশ করেন, ‘‘এত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলছেন যেন, ভিতরের খবর জানেন!’’ সিবিআইয়ের তরফে হাজির ছিলেন সলিসিটর জেনারেল রঞ্জিত কুমার। তাঁর টিপ্পনি, ‘‘উনি জানতেই পারেন, দশ বছর সরকারে ছিলেন কিনা!’’ কিছুটা হাল্কা মেজাজে সওয়াল জবাব এগোলেও বিচারপতি শেষ পর্যন্ত, রাজ্যকে তাদের বলা সংখ্যার দ্বিগুণ সংখ্যক পুলিশকর্মীকে ডেপুটেশনে সিবিআইয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

তবে শীর্ষ আদালত এ-ও মনে করছে, রাজ্য থেকে সিবিআইয়ে পুলিশ পাঠানোটা কোনও সমাধান নয়। কারণ, শুধু সারদা কেলেঙ্কারি নয়। ব্যপম থেকে শুরু করে সব তদন্তের জন্যই লোক জোগাতে গিয়ে সিবিআইয়ে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে। আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছে তারা। উপর থেকে নিচুতলা পর্যন্ত সিবিআইয়ের ৪,৫৪৪টি পদের মধ্যে ৭৫৪টি পদ ফাঁকা পড়ে রয়েছে। অথচ প্রতিদিনই নতুন নতুন মামলা সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকেও প্রস্তুত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিচারপতি ঠাকুর। তাঁর কথায়, ‘‘নদীতে জোয়ার এলে কতখানি জল উঠবে, তা আঁচ করেই সেতু তৈরি হয়। সিবিআইয়ের মতো প্রথম সারির তদন্ত সংস্থাকেও সেই ভাবেই তৈরি থাকতে হবে।’’

শীর্ষ আদালত সিবিআইয়ের কাছে জানতে চেয়েছে, তাদের কত অফিসার প্রয়োজন, তার পর্যালোচনা শেষ কবে হয়েছিল? সিবিআইয়ের হাতে তখন কত মামলা ছিল? এখন কত রয়েছে? সিবিআইয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোথায় কী বাধা রয়েছে? এ বিষয়ে দু’সপ্তাহের মধ্যে সিবিআইকে হলফনামা দিতে বলা হয়েছে। সেই হিসেব ও তথ্য হাতে পাওয়ার পরে প্রয়োজনে সিবিআইয়ের অন্দরমহল ঢেলে সাজতে শীর্ষ আদালত হস্তক্ষেপ করবে বলেও এ দিন জানিয়ে দিয়েছেন বিচারপতি ঠাকুর।

প্রধান বিচারপতি এইচ এল দাত্তূর বেঞ্চেও আজ ব্যপম কেলেঙ্কারির শুনানিতে একই বিষয়ে বিতর্ক হয়। অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতগি জানান, তিনি সব রাজ্যকে চিঠি লিখে সিবিআইয়ে অফিসার পাঠিয়ে সাহায্য করতে বলবেন। কিন্তু বিচারপতি ঠাকুর বলেন, ‘‘তাতে সমস্যার সমাধান হবে না। সব রাজ্যই বলবে তাদের লোক নেই।’’

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হাতে যথেষ্ট পুলিশ না থাকার প্রসঙ্গ আগেও উঠেছে শীর্ষ আদালতে। তখনই বিচারপতি প্রশ্ন তোলেন, সারদা তদন্ত তো রাজ্য সরকার নিজেদের পুলিশকে দিয়েই করাতে চেয়েছিল। এখন তারা কী ভাবে বলে, সিবিআইকে দেওয়ার মতো যথেষ্ট পুলিশ নেই তাদের হাতে! আজও পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে রেয়াত করেনি শীর্ষ আদালত। রাজ্য ২০ জন পুলিশকর্মী দেবে বলেছিল। আদালতের নির্দেশ, তার চার গুণ অর্থাৎ ৮০ জনের একটি প্যানেল সিবিআইকে দিতে হবে। সিবিআই তার মধ্যে ৪০ জনকে বেছে নেবে। এক মাস আগে শীর্ষ আদালত নির্দেশ দিয়েছিল, সিবিআইয়ের কত লোক দরকার, রাজ্য কত দিতে পারবে, রাজ্য পুলিশের ডিজি ও সিবিআইযের যুগ্ম-অধিকর্তা আলোচনা করে তার মীমাংসা করবেন। আজ সিবিআইয়ের তরফে অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল রঞ্জিত কুমার জানান, ‘‘দু’বার সিবিআইয়ের যুগ্ম-অধিকর্তা রাজ্যের ডিজিপি-র সঙ্গে বৈঠক করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। শেষে গত ১২ অগস্ট বৈঠক হয়েছে।’’

কী হল সেই বৈঠকে?

সিবিআই রাজ্যের থেকে ১০ জন পুলিশ সুপার, ১৫ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার চেয়েছিল। রাজ্য এক জনকেও ছাড়তে রাজি হয়নি। ৩০ জন ডিএসপি চাওয়া হলে রাজ্য ৩ জনকে দিতে রাজি হয়। ৮৫ জন ইনস্পেক্টরের জায়গায় ২ জন, ৪০ জন এসআই-এর বদলে ৫ জন এবং ১৬০ জন কনস্টেবলের জায়গায় ১০ জন মিলবে বলে রাজ্য জানায়। সিবিআইয়ের ডিআইজি শঙ্খশুভ্র বাগচী আদালতে জানান, সারদা ছাড়া আরও ২৬৫টি সংস্থার বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে। এত কম লোকবলে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মতো বৃহত্তর ষড়যন্ত্রর রহস্য উদ্ধারে সমস্যা হবে। সিবিআইয়ের আর্জি মেনে রাজ্যকে সিবিআইয়ের হাতে চার সপ্তাহের মধ্যে ৮০ জনের প্যানেল তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত।

সারদায় সিবিআই তদন্ত চেয়ে মামলা করেছিলেন কংগ্রেসের আব্দুল মান্নান। তিনি এতেই সন্তুষ্ট। বলেছেন, ‘‘লোক না দিয়ে রাজ্য সরকার তদন্তে বাধা তৈরি করতে চাইছে। সুপ্রিম কোর্টর নির্দেশে আমি খুশি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE