Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

প্রার্থনা দেশ জুড়ে, তবু ঘোর সঙ্কটে হনুমন্থাপ্পা

উত্তরপ্রদেশে লখিমপুরের গৃহবধূ নিধি পাণ্ডে একটি সংবাদ চ্যানেলে ফোন করেছেন। জানতে চেয়েছেন দিল্লির সেনা হাসপাতালের ফোন নম্বর। কেন? ওই গৃহবধূ ল্যান্সনায়েক হনুমন্থাপ্পা কোপ্পাড়কে তাঁর কিডনি দান করতে চান। সংবাদমাধ্যমে তিনি জেনেছেন, জওয়ানের অবস্থা সঙ্কটজনক। কিডনি কাজ করছে না।

দিল্লির সেনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ল্যান্সনায়েক হনুমন্থাপ্পা কোপ্পাড়। বুধবার। ছবি: পিটিআই।

দিল্লির সেনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ল্যান্সনায়েক হনুমন্থাপ্পা কোপ্পাড়। বুধবার। ছবি: পিটিআই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:৫১
Share: Save:

উত্তরপ্রদেশে লখিমপুরের গৃহবধূ নিধি পাণ্ডে একটি সংবাদ চ্যানেলে ফোন করেছেন। জানতে চেয়েছেন দিল্লির সেনা হাসপাতালের ফোন নম্বর। কেন? ওই গৃহবধূ ল্যান্সনায়েক হনুমন্থাপ্পা কোপ্পাড়কে তাঁর কিডনি দান করতে চান। সংবাদমাধ্যমে তিনি জেনেছেন, জওয়ানের অবস্থা সঙ্কটজনক। কিডনি কাজ করছে না।

সিআইএসএফ-এর অবসরপ্রাপ্ত জওয়ান প্রেম স্বরূপ তো সরাসরি পৌঁছেই গিয়েছেন হাসপাতালে। তিনিও কিডনি বা শরীরের অন্য কোনও অঙ্গ দান করতে চান। একই ইচ্ছে ঠাণের প্রাক্তন নৌসেনা জওয়ান এস এস রাজুর। শুধু কি এঁরা? মুম্বইয়ের ডাব্বাওয়ালা থেকে স্কুলপড়ুয়া, অমিতাভ-ক্যাটরিনা-সচিন-আমিরের মতো সেলিব্রিটি থেকে আম আদমি— সকলের একটাই প্রার্থনা, সুস্থ হয়ে উঠুন হনুমন্থাপ্পা! ৩৫ ফুট বরফের নীচে টানা ছ’দিন চাপা পড়ে থেকেও যখন মৃত্যুর কাছে হার স্বীকার করেননি, হাসপাতালের বিছানায় যেন তিনি শেষ নিঃশ্বাস না ফেলেন!

৩ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে তিনটে অবধিও হনুমন্থাপ্পা আর তাঁর ন’জন সঙ্গী রেডিও-বার্তায় জানিয়েছিলেন, তাঁরা সবাই ঠিক আছেন। পরের দু’ঘণ্টায় স্রেফ অদৃশ্য হয়ে যায় সেনা চৌকিটা। বরফের ধস গিলে ফেলে সব। কয়েক ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পরেও যখন কারও চিহ্ন পাওয়া গেল না, সেনা-কর্তারা ধরে নিয়েছিলেন সব শেষ। কিন্তু ৪ তারিখ হঠাৎ একজনের রেডিও সংযোগ মেলে। সেই সূত্র ধরেই এক অলীক আশা নিয়ে পাঁচ দিন ধরে বরফ খুঁড়ে যাচ্ছিলেন তাঁরা। হনুমন্থাপ্পাকে খুঁজে পাওয়ার পরে যখন উদ্ধারকারীরা সেনা জেনারেলকে জানালেন খবরটা, জেনারেল কোনও মতে বললেন ‘‘জলি গুড!’’ সেনা উর্দির কাঠিন্য তছনছ করে তার পরেই কান্নায় বন্ধ হয়ে এল গলা। এই অলৌকিক ‘উদ্ধার’ যাতে নিষ্প্রাণ না হয়ে যায়, তার জন্য মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে বাহিনীও।

কিন্তু সব প্রার্থনা আর প্রয়াস এক দিকে। অন্য দিকে মেডিক্যাল বুলেটিন, যেটা আশাব্যঞ্জক নয়! আইসিইউ-এর ভিতরে জীবন-মৃত্যুর লড়াই ক্রমেই অসম হয়ে উঠছে। বুধবার বিকেলের বুলেটিন বলছে, ৩৩ বছরের হনুমন্থাপ্পার শারীরিক সঙ্কট আরও বেড়েছে। সিটি স্ক্যান রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, তাঁর মস্তিষ্কে অক্সিজেনের খুবই অভাব। দু’টি ফুসফুসেই থাবা বসিয়েছে নিউমোনিয়া। সব রকম চেষ্টা সত্ত্বেও একাধিক অঙ্গ কাজ করছে না।

এ দিন সকালেই কর্নাটক থেকে দিল্লি এসে পৌঁছেছেন হনুমন্থাপ্পার পরিবারের সদস্যরা। দিল্লি বিমানবন্দরে পৌঁছনোর পর বুকভরা আশা নিয়ে স্ত্রী মহাদেবী বলেন, ‘‘আমাদের সকলের পুনর্জন্ম হয়েছে। আমার স্বামীর জীবনের অনুপ্রেরণা ওঁর ঠাকুমা। তাঁর প্রার্থনাই ওঁকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে এনেছে।’’ হনুমন্থাপ্পার ভাইপো ঈশ্বর বলছিলেন, ‘‘আমাদের বেতাদুর গ্রামে সকলে মন্দিরে বসে প্রার্থনা করছে। সেনা অফিসাররা বলেছেন আমরা ওঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারব।’’ তখনও ওঁরা জানতেন না, সন্ধেবেলায় চিকিৎসকরা হনুমন্থাপ্পার শারীরিক অবস্থার অবনতির কথাই জানাবেন।

পরিস্থিতি যে খারাপের দিকে যেতে পারে, সকালের মেডিক্যাল বুলেটিনে অবশ্য তার একটা ইঙ্গিত ছিল। চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টায় ঝড় অপেক্ষা করছে। কারণ এখন ল্যান্সনায়েকের শরীরের বাইরে থেকে তাপমাত্রা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। শরীরের যে সব অংশে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেই সব অংশে ফের রক্ত পাঠানো হচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে জটিলতা দেখা দিতে পারে।

আজ বিকেলে এইমস হাসপাতালের চিকিৎসকদের একটি দলও হনুমন্থাপ্পাকে পরীক্ষা করেন। সেনা হাসপাতালের বক্তব্য, যথাসম্ভব শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা ও অভিজ্ঞতাই কাজে লাগানো হচ্ছে হনুমন্থাপ্পার জন্য। তাঁর শরীরে জলের পরিমাণ বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। বাষ্পীভূত উষ্ণ অক্সিজেন দিয়ে রক্তচাপ ও তাপমাত্রা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। নানা অ্যান্টিবায়োটিক তো আছেই।

ছোটবেলায় নিজের বেতাদুর গ্রাম থেকে রোজ পায়ে হেঁটে ছয় কিলোমিটার দূরের আরালিকাট্টি স্কুলে পড়তে যেতেন হনুমন্থাপ্পা। ছোটবেলা থেকেই সেনাবাহিনীতে চাকরি করার ইচ্ছে। তিন-তিন বার পরীক্ষায় খারিজ হয়ে যাওয়ার পরেও আবার পরীক্ষায় বসলেন। নির্বাচিত হলেন। মাদ্রাজ রেজিমেন্টে যোগ দেওয়ার পর থেকেই তাঁর সাহস দেখে অবাক সেনা অফিসাররা। একবার জম্মু-কাশ্মীরের পোস্টিং শেষ হওয়ার পর ফের কাশ্মীরে পোস্টিং নিলেন হনুমন্থাপ্পা। তাঁর সাহস ও শারীরিক সক্ষমতা দেখেই তাঁকে সিয়াচেনের জন্য বেছে নেওয়া হয়। গত ডিসেম্বরে পাঠানো হয় ১৯,৬০০ ফুট উঁচুতে সোনাম হেলিপ্যাডের বরফরাজ্যে।

মাত্র চার বছর হল হনুমন্থাপ্পার বিয়ে হয়েছে। দেড় বছরের একরত্তি মেয়ে। স্ত্রী মহাদেবী বলছিলেন, ‘‘আমরা তো সব আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। ও বেঁচে রয়েছে এই খবরটাই মুখে হাসি ফিরিয়ে এনেছে।’’

এই হাসি অমলিন থাকুক, দেশ জুড়ে এখন শুধু তার জন্যই প্রার্থনা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Hanumanthappa national LanceNaik
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE