নতুন ট্রেনের অপেক্ষায়। হাইলাকান্দির লালা স্টেশনে ভিড়। শুক্রবার অমিত দাসের তোলা ছবি।
১৪ কামরার ট্রেন। যাত্রী মাত্র ১৯ জন। তাঁদের মধ্যে ১০ জন শিলচরের সাংবাদিক। রেলবিভাগই তাঁদের টিকিটের ব্যবস্থা করেছে।
আজ বিকেলে জিরিবাম-শিলচর প্রথম ব্রডগেজ ট্রেনের ছবিটা ছিল এমনই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শিলঙে বসে রিমোট কন্ট্রোলে যাত্রা শুরুর সংকেত দেন। জিরিবাম স্টেশনে দাঁড়িয়ে সবুজ পতাকা নাড়েন মণিপুরের দুই সাংসদ— থাকসেম মৈনা ও থাংসু বাইতে। ছিলেন উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের মুখ্য প্রশাসনিক অফিসার অজিত পণ্ডিত, মণিপুর সরকারের পরিবহণ কমিশনার এম লক্ষ্মীকুমার। ওই ট্রেনের মাধ্যমে মণিপুর যুক্ত হল ব্রডগেজে। কিন্তু এমন মুহূর্তের সাক্ষ্মী হতে তেমন ভিড় দেখা যায়নি জিরিবাম স্টেশনে। শিলচরে যে দিন প্রথম ব্রডগেজের ইঞ্জিন ঢোকে, বা ৮ বছর আগে আগরতলায় মিটারগেজের ট্রেন পৌঁছেছিল, স্থানীয় জনতার সে-দিনের উৎসাহের ছিঁটেফোটাও ছিল না মণিপুরের একমাত্র স্টেশনটিতে।
ঘোর কাটে যাত্রা শুরুর ৭ মিনিট পর ট্রেন অসমের জিরিঘাটে পৌঁছলে। মহিলারা উলুধ্বনিতে বরণ করেন নতুন ট্রেনকে। কামরাঙা রেলগেটে স্থানীয় জনতা ট্রেন দাঁড় করিয়ে আক্ষরিক অর্থেই পুজো করলেন। ইঞ্জিনের সামনে ধুপকাঠি-মোমবাতিতে আরতি চলে কিছুক্ষণ। নতুন গাড়ি বা মোটরসাইকেল কিনলে যেমন করেন মা-বোনেরা। পরে লোকো-পাইলট অশোক মজুমদার, সহকারী পাইলট অভিজিৎ ভট্টাচার্য-দের ঠাণ্ডা সরবত দেওয়া হয়। ইঞ্জিনে বিজেপির পতাকা বেঁধে দেন কয়েক জন। পরবর্তী প্রতিটি স্টেশনে লোকের ভিড় ছিল নজরকাড়া। তাঁদের অধিকাংশই বিজেপির কর্মী। শ্রীবার স্টেশনে গেরুয়া পতাকা হাতে ট্রেন ঘিরে মিছিল করলেন শতাধিক নারী-পুরুষ। অন্যান্য জায়গায়ও নরেন্দ্র মোদীর নামে জয়ধ্বনি ওঠে।
তাই বলে সবটাই রাজনৈতিক বলা যায় না। বাড়িঘর থেকে সাধারণ মানুষ লাইনের ধারে ছুটে আসেন। স্বাগত জানান ব্রডগেজে নতুন ট্রেনকে।
কিন্তু মণিপুরে সেই আবেগ কেন দেখা গেল না, আগেই এর ব্যাখ্যা দেন দুই কংগ্রেস সাংসদ। বাইতে বলেন, ‘‘মণিপুরে আজ এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হল। যোগাযোগ ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন আসতে চলেছে। তবে সে জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। ব্রডগেজে ইম্ফল জুড়ে গেলেই মূল সুবিধা মিলবে।’’
একই সুরে মৈনা বলেন, ‘‘ইম্ফল পৌঁছলেই লাভজনক হবে যাত্রিট্রেন। কারণ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জিরিবামে পৌঁছনো কম কষ্টকর নয়। এর চেয়ে সহজতর, ইম্ফল হয়ে সড়কপথে গুয়াহাটি পৌঁছনো। সেখান থেকে মেলে বাইরের ট্রেন।’’
মুকুলচন্দ্র দাস, এমডি বাঁদায়ে, কে শান্তিকুমারের মতো কংগ্রেস নেতারা যেমন, তেমনি হরিদাস সিংহ, সন্ধ্যারানি দেবীর মতো বিজেপি নেতৃবৃন্দ ট্রেন ছাড়ার সময় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। একই কথা বলেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী এ বিনোদ সিংহ, বেসরকারি সংস্থার এম সিংহ-রা। তাঁদের বক্তব্য, এখনই মণিপুরের অন্যান্য অংশের মানুষ এই ট্রেনে চড়বেন, তা আশা করা যায় না। জিরিবামের মানুষের কথা ভেবেই ট্রেনের সময় ঠিক করতে হবে। এই অঞ্চলের সঙ্গে শিলচরের সম্পর্ক বাজার-হাটের। মূলত মানুষ সকালে শিলচর যান কেনাকাটা করতে। বিকেলে ফিরে আসেন। কিন্তু উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেল এই ট্রেন চালানোর জন্য উল্টো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতি দিন শিলচর থেকে সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে ট্রেন ছাড়বে। ১১টায় জিরিবাম পৌঁছবে। ৪৫ মিনিট পর ফের রওনা হবে জিরিবাম থেকে।
মণিপুরবাসীর দাবি, জিরিবাম থেকে ট্রেন ছাড়া হোক সকাল ৮টার মধ্যে। বিকেলে শিলচর থেকে। বিজেন্দ্রবাবু, মুকুলবাবুরা প্রশ্ন তোলেন, ছোট-বড় প্রচুর গাড়ি চলে জিরিবাম ও শিলচরের মধ্যে। চরম বেহাল রাস্তা-সেতু। তার উপর ভাড়া ৫০-৬০ টাকা। তা হলে ১৫ টাকা ভাড়ার রেলে মানুষ চড়বেন না কেন। শিলচর থেকে বাইরের ট্রেনগুলি যেন ধরা যায়, সে দিকেও খেয়াল রাখতে তাঁরা অনুরোধ করেন।
উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের মুখ্য প্রশাসনিক অফিসার অজিত পণ্ডিত বলেন, ‘‘ইম্ফল পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণের কাজ এগিয়ে চলেছে। ২০১৯ সালের মধ্যে টুপুল পৌঁছবে। পরের বছরই ইম্ফল। ট্রেনের সময়সূচি পরিবর্তনের বিষয়টি ভেবে দেখা হতে পারে। যাত্রিবাহী ট্রেন ফাঁকা চলার আশঙ্কা থাকলেও তিনি মালগাড়ির উপর গুরুত্ব দেন।’’ পণ্ডিত বলেন, মণিপুরের সরবরাহ লাইন শিলচর-জিরিবাম লাইন। ওই রুটেই মণিপুরে পৌঁছয় সরকারি রেশন সামগ্রী। অন্যান্য পণ্যসামগ্রীও পরিবহণ হয়।
উদ্বোধনী ট্রেনেই শিলচর আসেন জিরিবামের স্টেশন সুপার সুজিত মার। তিনি জানান, এ ভাবেই প্রতি দিন শিলচর থেকে ট্রেনে জিরিবাম যাবেন। ৪৫ মিনিট কাউন্টারে বসে টিকিট বিক্রি করবেন। পরে ওই ট্রেনেই ফিরবেন শিলচর। একই রুটিন গার্ড, ড্রাইভার সহ সকলের। জিরিবামে কারও থাকার ব্যাপার নেই। সবাই আসবেন-যাবেন। এমনই চলছিল মিটারগেজ আমলেও।
তবে মিটারগেজ আর ব্রডগেজে কোনও ফারাক নেই, এমন নয়। আগে এই ট্রেনের লেভেল ক্রসিংয়ে গেটের ব্যবস্থা ছিল না। তার সামান্য আগে ট্রেন থামত। গার্ড নামতেন। তিনি ট্রেন চলার সিগন্যাল দিতেন। ক্রসিং পেরিয়ে আবার ট্রেন দাঁড়াত গার্ডকে তুলে নেওয়ার জন্য। অজিত পণ্ডিত জানান, এমন দু’টি লেভেল ক্রসিংয়েই এখন গেট বসেছে। ট্রেন আসার আগেই লোকজনের চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য গেট পড়বে, আবার ট্রেন যাওয়ার পর গেট খুলে দেওয়া হবে। সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হয়েছে।
অন্য দিকে, শিলং থেকে প্রধানমন্ত্রী মোদীর ‘ইশারা’ পেয়ে মিজোরামের ভৈরবী স্টেশনে হাজির রাজ্যের বনমন্ত্রী লালরিনমাওয়িআ রালটে সবুজ পতাকা দেখিয়ে ভৈরবী-শিলচর প্যাসেঞ্জার ট্রেনের যাত্রা শুরুর সঙ্কেত দেন। ঘড়িতে তখন বেলা সওয়া ১টা। প্ল্যাটফর্মে রাজ্য প্রশাসনের উচ্চপদস্থ আমলাদের পাশাপাশি হাজির ছিলেন সাধারণ মানুষও। একটি অনুষ্ঠানও করা হয় সেখানে। রামনাথপুর, জামিরা, কাটলিছড়া, লালা ছুঁয়ে বিকেল সওয়া ৫টা নাগাদ ১৬ কামরা ট্রেনটি পৌঁছয় হাইলাকান্দিতে। প্রত্যেকটি স্টেশনেই ছিল বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের ভিড়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নামে স্লোগান দেওয়া হয় সব জায়গাতেই। বিজেপি কর্মীরা দাবি করেন, মোদীর আমলেই ব্রজগেজে জুড়ল মিজোরাম। যা কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার করতে পারেনি। পদ্মফুল-পতাকা কার্যত ঢেকে যায় গোটা ট্রেনটি। পুরো সময়ই লাইনের পাশে ভিড় জমিয়েছিলেন জেলার মানুষ। গ্রামের মহিলারা উলুধ্বনি দিয়ে ট্রেনটিকে স্বাগত জানান। হাইলাকান্দি স্টেশনে পৌঁছনোর পর বিজেপি নেতাদের পাশাপাশি নাগরিক অধিকার সুরক্ষা সমিতি, রেলযাত্রী অধিকার সুরক্ষা কমিটির সদস্যরা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। স্টেশন চত্বরে একটি অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছিল। কিছ ক্ষণ পর ট্রেনটি শিলচরের দিকে এগিয়ে যায়।
জেলার বাসিন্দাদের বক্তব্য, নতুন ট্রেন পরিষেবা শুরু হওয়ায় সংশ্লিষ্ট এলাকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও মজবুত হবে। সুবিধা বাড়বে যাতায়াতের। উপকৃত হবেন সাধারণ মানুষ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy