Advertisement
১০ মে ২০২৪

ঘরবন্দি বসুন্ধরা, হাসছেন ললিত

রাজস্থান রসাতলে যাক, ঘড়ির কাঁটা রাত ৮টা পেরোলেই তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে। সশরীরে দেখা তো দূর, মোবাইল বা ল্যান্ডলাইনেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা মুশকিল। সরকারি আমলা থেকে বিজেপি নেতা, মন্ত্রটা সবাই জানেন। জানেন, ওই সময়ের সীমারেখা পেরিয়ে গেলে মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজের ব্যক্তিগত জীবনে ব্যাঘাত ঘটানো নিষেধ। জানেন, ‘এইট পিএম, নো সিএম!’

জয়পুরের সোঁয়াই মান সিংহ স্টেডিয়ামে রাজস্থান ক্রিকেট সংস্থার বন্ধ দফতরের সামনে ললিত মোদীর ব্যানার। — নিজস্ব চিত্র।

জয়পুরের সোঁয়াই মান সিংহ স্টেডিয়ামে রাজস্থান ক্রিকেট সংস্থার বন্ধ দফতরের সামনে ললিত মোদীর ব্যানার। — নিজস্ব চিত্র।

প্রেমাংশু চৌধুরী
জয়পুর শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৫ ০৩:২৬
Share: Save:

রাজস্থান রসাতলে যাক, ঘড়ির কাঁটা রাত ৮টা পেরোলেই তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে। সশরীরে দেখা তো দূর, মোবাইল বা ল্যান্ডলাইনেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা মুশকিল।

সরকারি আমলা থেকে বিজেপি নেতা, মন্ত্রটা সবাই জানেন। জানেন, ওই সময়ের সীমারেখা পেরিয়ে গেলে মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজের ব্যক্তিগত জীবনে ব্যাঘাত ঘটানো নিষেধ। জানেন, ‘এইট পিএম, নো সিএম!’

জয়পুরের নেতা-মন্ত্রী-আমলা মহলে লব্জটা জনপ্রিয়। অবশ্যই আড়ালে। তবে ঘটনা হল, যাঁকে নিয়ে এই ‘সতর্ক’ রসিকতা, সেই মুখ্যমন্ত্রী যেন ইদানীং পুরোদস্তুর আড়ালেই চলে গিয়েছেন। ললিত মোদী বিতর্ক জট পাকিয়ে ওঠার পর ১৩ নম্বর সিভিল লাইন্সের বাংলোতেই নিজেকে বন্দি করে ফেলেছেন বসুন্ধরা রাজে।

বিদেশে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বৈঠক করতে যাওয়ার কথা ছিল। সে সফর বাতিল হয়েছে। নিরাপত্তা কর্মীদের জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, গত এক সপ্তাহে মাত্র এক বারই সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে যোগ দিতে গিয়েছিলেন বসুন্ধরা। আর এক বার নীতি আয়োগের বৈঠকে যোগ দিতে দিল্লিতে। বাকি সময় তিনি বাড়িতেই। সেখানেই মন্ত্রী-পারিষদ-আমলাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। এমনকী নিজের পক্ষে যুক্তি দিতে সাংবাদিক সম্মেলনটুকুও করেননি। নেতা-মন্ত্রীরাই সে সব ঝক্কি সামলাচ্ছেন।

একটা ব্যতিক্রম অবশ্য হয়েছিল ৩০ জুন। জয়পুরের মানসরোবরে শ্রীমদ্ভাগবত জ্ঞানযজ্ঞ এবং লক্ষীনারায়ণ মহাযজ্ঞের আয়োজন হয়েছিল। সেখানে প্রায়ই সাধ্বী প্রিয়ংবদার কথা শুনতে যান বসুন্ধরা। ওই দিনও গিয়েছিলেন। পুজো, আরতি করেছেন। পুরোহিতের আশীর্বাদ চেয়েছেন। সঙ্কটমুক্তির আশায় হাতে লাল সুতোর ‘রক্ষাসূত্র’ও বেঁধেছেন। লোকসভা ভোটের সময়ে, বিজেপির ভাল ফলের প্রার্থনায় বসুন্ধরার নির্দেশে সরকারি দেবস্থান দফতর এক সপ্তাহ ধরে বিশেষ পুজো-যজ্ঞের আয়োজন করেছিল। খুব শীঘ্রই সেই নির্দেশ ফের আসতে চলেছে বলে অনেকেই মনে করছেন।

পুজো-আরতি করে, রক্ষাসূত্র বেঁধে রাহুর দশা কাটবে কি না, তা সময় বলবে। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে জমা হওয়া গণ-অসন্তোষ কাটবে কি? বিধানসভায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দু’বছর আগে ক্ষমতায় এসেছিলেন। লোকসভা ভোটেও রাজস্থান থেকে কংগ্রেস সাফ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার পর থেকেই মুখ্যমন্ত্রী ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন বলে রাজ্যবাসীর একটা বড় অংশের অভিযোগ। বিশেষত ব্যবসায়ী মহলের। তা সে হোটেল ব্যবসায়ীই হোন বা ছোট-বড় শিল্পপতি। তাঁদের অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী কোনও সমস্যার কথা শুনতে চান না। দল হোক বা সরকার, তাঁর কথাই শেষ কথা। তোষামোদ ভালবাসেন। আর হ্যাঁ, দরকারে দেখাও করা যায় না।

গত মাসে জয়পুরের এক খ্যাতনামা ব্যবসায়ী কিছু সমস্যা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দরবারে গিয়েছিলেন। সিভিল লাইন্সের বাসভবনে সকাল ৯টায় তাঁর ‘অ্যাপয়েন্টমেন্ট’ ছিল। বসুন্ধরা দেখা দিয়েছিলেন বেলা ১২টায়। দেরির কোনও কারণ দেখাননি। ‘সরি’ বলা তো দূরের কথা। বিজেপির এক নেতার কথায়, ‘‘আসলে উনি এখনও নিজেকে মহারানি ভাবেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখেন না। সেটাই সমস্যা।’’

ব্যতিক্রম আছে। জয়পুর জেলা দায়রা আদালতের আইনজীবী বিনোদ খাণ্ডেলওয়ালের প্রশ্ন, ‘‘বসুন্ধরার আমলে জনতার কোনও সুরাহা হয়নি ঠিকই। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী সরকারও কি সুদিন আনতে পেরেছে?’’ মাহেশ্বরী কলেজে বাণিজ্যের ছাত্রী নম্রতা বিয়ানি আবার বলছেন, ‘‘বসুন্ধরা রাজের মতো এমন ক্যারিশমা কারও নেই। উনি যে রঙের শাড়ি পরেন, সেটাই ফ্যাশন। শুধু মুখ্যমন্ত্রী নন, উনি আমাদের ফ্যাশন আইকনও।’’

কিন্তু শুধু ক্যারিশমা দিয়ে যে রাজনীতি হয় না, এ দেশে তার প্রমাণ ভূরি ভূরি। বরং রাজনীতির পরিহাস এমনই যে, ২০০৩ সালে যখন বসুন্ধরা মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন মন্ত্রী-আমলা মহলের অন্দরে ‘সুপার চিফ মিনিস্টার’ ডাকনাম পেয়েছিলেন আপাত ক্যারিশমার ছিটেফোঁটা-বিহীন এক শিল্পপতি। বসুন্ধরার সংসারে তখনও নাকি তাঁর জবরদস্ত প্রভাব ছিল। লোকটির নাম— ললিত মোদী।

‘ফেরার’ ক্রিকেট কর্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার মাসুল দিয়ে খোদ বসুন্ধরা যখন ঘরবন্দি, তখন ললিতের কী প্রচণ্ড উপস্থিতি জয়পুরে! হতে পারে তিনি রয়েছেন লন্ডনে, কিন্তু এখানে তাঁর ক্ষমতার শিকড় এখনও গভীরে। বিদেশে থেকেই গত বছর রাজস্থান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন (আরসিএ)-এর প্রেসিডেন্ট পদে জিতে গিয়েছিলেন। তার পর তাঁকে সেই পদ থেকে সরানোও হয়েছে। কিন্তু সোঁয়াই মান সিংহ স্টেডিয়ামে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের দফতরের মাথায় এখনও ললিতের হাসিমুখের ছবি। ‘টিম ললিত মোদী— নিউ এগ্‌জিকিউটিভ কমিটি ২০১৪-১৮’-র বিরাট ব্যানার। দফতর অবশ্য বন্ধ। তাঁকে বেআইনি ভাবে আরসিএ-র প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরানো হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন ললিত। সবটাই লন্ডনে বসে। মার্চ মাসে আদালতের নির্দেশে আরসিএ-র দফতর সিল করে দেওয়া হয়েছে। ‘নিজে আরসিএ-তে না ঢুকলে আর কাউকে ঢুকতেও দেব না’— ব্যানার থেকে হাসিমুখে যেমন এমনটাই বলছেন ললিত।

পুরনো বন্ধু ললিত যে এমন গলার কাঁটা হয়ে উঠবেন, ভাবতে পেরেছিলেন বসুন্ধরা? অভিযোগ উঠেছে, তাঁর সিন্দুকে নাকি ঢুকেছে ললিতেরই কালো টাকা। এই পরিস্থিতিতে বসুন্ধরা-পুত্র দুষ্মন্ত সিংহকে নিয়েও হতাশ বিজেপি নেতৃত্ব। ঝালওয়ারের এই সাংসদ কেন সামনে আসছেন না? জানা গেল, ‘রাজকুমার’ এখন স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে ইউরোপে ছুটি কাটাচ্ছেন। দু’একদিনের মধ্যেই ফিরবেন। ছেলে এসে মায়ের হয়ে মুখ খুলবেন বলে ঘনিষ্ঠ মহলের ধারণা। কংগ্রেস যদিও হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে— তাতেও বিপদ কাটবে না।

হাল্কা মেজাজে কেউ কেউ বলছেন, ‘ঢোলপুরের কপালে এটা হওয়ারই ছিল।’ কেন? ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এক জন বললেন, বসুন্ধরা আসলে মরাঠি শিন্দে বা সিন্ধিয়া রা‌জপরিবারের মেয়ে। আর তাঁর প্রাক্তন স্বামী হেমন্ত সিংহ হলেন বামরৌলিয়া জাঠ। অষ্টাদশ শতকে সিন্ধিয়ারা এই জাঠদের ঢোলপুর-ছাড়া করেছিল। পরে ব্রিটিশদের কল্যাণে ঢোলপুর ফেরত পায় জাঠেরা। ঢোলপুরের আসল রাজা কিন্তু ছিলেন হেমন্ত সিংহের দাদামশাই। তাঁর মৃত্যুর পর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী না থাকায় হেমন্তকে দত্তক নেন তাঁর দিদিমা। সে যা-ই হোক, মোদ্দা কথা হল, সেই জাঠ রাজার সঙ্গেই বিয়ে হয়েছিল সিন্ধিয়া রাজকন্যার। সেই বিয়ে ভেঙেছে, এখন প্রাসাদের উত্তরাধিকার নিয়েও চলছে খোঁড়াখুঁড়ি।

সিভিল লাইন্সের ১৩ নম্বর বাংলোর ঢিলছোড়া দূরত্বে সরকারি ‘মুখ্যমন্ত্রী নিবাস’। গদিতে বসেও সেই বাড়িতে যাননি বসুন্ধরা। সবাই বলতেন, অশুভ ১৩-ই বসুন্ধরার পয়া সংখ্যা। কংগ্রেসের মুখপাত্র অর্চনা শর্মার কটাক্ষ, ‘‘এ বার ওই ১৩ নম্বরই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অপয়া হয়ে উঠেছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jaipur Rajasthan PM CM Lalit Modi Delhi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE