Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
অরুণাচল সঙ্কট

নাটক ছ়ড়াল রাজভবনেও, হাইকোর্টে স্বস্তি কংগ্রেসের

এ যেন শিবঠাকুরের আপন দেশ, যেখানে নিয়ম-কানুন সব সর্বনেশে। অরুণাচল প্রদেশের টানাপড়েন ভারতের রাজনৈতিক তথা সাংবিধানিক সঙ্কটের অন্যতম উদাহরণ হয়ে রইল বলে মনে করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত যে সঙ্কটে মুখ্যমন্ত্রী নাবাম টুকিকে সাময়িক স্বস্তি দিয়েছে গৌহাটি হাইকোর্ট।

কালিখো পুলকে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত করার পরে অস্থায়ী বিধানসভার সদস্যরা। বৃহস্পতিবার। ছবি: পিটিআই।

কালিখো পুলকে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত করার পরে অস্থায়ী বিধানসভার সদস্যরা। বৃহস্পতিবার। ছবি: পিটিআই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
গুয়াহাটি ও নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:১৯
Share: Save:

এ যেন শিবঠাকুরের আপন দেশ, যেখানে নিয়ম-কানুন সব সর্বনেশে। অরুণাচল প্রদেশের টানাপড়েন ভারতের রাজনৈতিক তথা সাংবিধানিক সঙ্কটের অন্যতম উদাহরণ হয়ে রইল বলে মনে করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত যে সঙ্কটে মুখ্যমন্ত্রী নাবাম টুকিকে সাময়িক স্বস্তি দিয়েছে গৌহাটি হাইকোর্ট।

রাতারাতি এবং ঘন-ঘন দৃশ্যপট বদল উত্তর-পূর্বের রাজনীতিতে চেনা ঘটনা। এখানকার রাজনীতিতে অর্থ আর ক্ষমতাই শেষ কথা। দল বা আদর্শ গৌণ। সেই ‘ঐতিহ্যে’র মুকুটেই নয়া পালক অরুণাচলের অচলাবস্থা।

৬০ সদস্যের অরুণাচল বিধানসভায় কংগ্রেসের বিধায়ক ৪৭। কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর ২১, বিজেপির ১১ জন ও দুই নির্দল নাবাম টুকির বিরুদ্ধে। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কালিখো পুল এবং ডেপুটি স্পিকার টি এন থন্ডোকের মধ্যস্থতায় টুকির বিপক্ষে একজোট হয়েছেন ওই ৩৪ বিধায়ক। এখন মুখ্যমন্ত্রীর ভাই তথা স্পিকার নাবাম রিবিয়ার অপসারণ ও নির্ধারিত সময়ের এক মাস আগে ১৬ ডিসেম্বর থেকে বিধানসভা অধিবেশন ডাকার কথা ঘোষণা করে দেন রাজ্যপাল তথা প্রাক্তন বিজেপি নেতা জ্যোতিপ্রসাদ রাজখোয়া। মুখ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যেরা প্রথমে চিঠি দিয়ে, পরে রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপালকে ধমক দিয়ে নির্দেশ প্রত্যাহার করতে বলেন। রাজ্যপাল অনড় থাকায় বিধানসভায় তালা ঝুলিয়ে দেন টুকি। ১৫ ডিসেম্বর রাতেই ডেপুটি স্পিকার টি এন থন্ডোক-সহ ১৪ জন বিক্ষুব্ধ বিধায়ককে বহিষ্কার করে দেন স্পিকার তথা টুকির ভাই নাবাম রিবিয়া।

বিধানসভা বন্ধ পেয়ে কাল নাহারলাগুনের টোচি টাকার কমিউনিটি হলের ব্যাডমিন্টন কোর্টে অস্থায়ী বিধানসভা অধিবেশন বসান থন্ডোক। সেখানে স্পিকারকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নেন সংখ্যাগরিষ্ঠ ৩৩ জন বিধায়ক। অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী ওই ‘নকল ও অবৈধ’ বিধানসভার সিদ্ধান্ত মানবেন না বলে জানিয়ে দেন। রাজ্যপালের নির্দেশ এবং অবৈধ ভাবে বিধানসভা অধিবেশন বসানোর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করে রাজ্য সরকার। তার মধ্যেই রাজ্যপাল নির্দেশ দেন, বিধানসভার দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে নাবাম টুকিকে ভোটে নিজের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে।

এর পর রাতেই ওই টোচি টাকার কমিউনিটি হল ভেঙে দেন কংগ্রেসের শাসক গোষ্ঠীর সমর্থকেরা। বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী ও বিজেপির বিধায়করা নাহারলাগুনের যে হোটেলে ছিলেন রাত থেকে তা ঘিরে ফেলেন তাঁরা। পুলিশ ছিল নীরব দর্শক। আজ সকাল থেকে কংগ্রেসের মহিলা মোর্চা রাজভবনও ঘিরে ফেলে। দরজা দিয়ে বেরোতে না পেরে চপার তলব করেন রাজ্যপাল জ্যোতিপ্রসাদ। কিন্তু, পুলিশ সূত্রে খবর, রাজভবন, ইটানগর ও নাহারলাগুনের হেলিপ্যাডের রাস্তাও বন্ধ করে দেওয়া হয়।

উপায় না দেখে, আজ হোটেলের কনফারেন্স রুমেই বিধানসভা বসিয়ে দেন ডেপুটি স্পিকার। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালামের স্মৃতিতে নীরবতা পালনের পরে টুকির বিপক্ষে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন বিজেপির ১১ জন ও ২ নির্দল বিধায়ক। ডেপুটি স্পিকার বাদে ২০ জন বিক্ষুব্ধ কংগ্রেস বিধায়ক মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি অনাস্থা প্রস্তাবে সায় দেন। নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পুলের নামও গৃহীত হয়। নিয়ম মতো সরকার গড়ার দাবি নিয়ে রাজ্যপালের কাছে যেতে হতো। কিন্তু হোটেলে বন্দি থাকায় বিধায়কেরা তা করতে পারেননি। রাজ্যপালও বেরোতে পারেননি।

টুকি ও রিবিয়ার দাবি, ইতিমধ্যেই বহিষ্কৃত এক বিধায়ক ডেপুটি স্পিকার হিসেবে যে কোনও স্থানে বিধানসভা অধিবেশন বসিয়ে ফেলতে পারেন না। অধিবেশনে থাকা ৩৪ জন বিধায়কের মধ্যে ১৪ জনও ইতিমধ্যেই বহিষ্কৃত। ওই অধিবেশন ও তাঁদের সিদ্ধান্তের মূল্য নেই। থন্ডোক পাল্টা দাবি করেন, রাজ্যপালের অনুমতি নিয়েই তিনি কাজ করছেন। উত্তরপ্রদেশে কল্যাণ সিংহ বনাম জে পালের মামলার ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট ‘কম্পোজিট ফ্লোর টেস্ট’-এ স্বীকৃতি দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব ৬ জন বিধায়কই আনতে পারতেন। সেখানে আজ ১৩ জন বিধায়ক এই প্রস্তাব এনেছেন। গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণে ও নিজেদের বক্তব্য রাখার জন্য টুকি ও তাঁর সঙ্গীদেরও ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা আসেননি।

বিরোধী দলনেতা বিজেপির টামিও টাগার দাবি, কংগ্রেসের ঘরোয়া ঝগড়ায় বিজেপির হাত নেই। কিন্তু টুকির শাসনে রাজ্যে অরাজক অবস্থা তৈরি হয়েছে। ভাঁড়ার শূন্য। কর্মীদের বেতন, ঠিকাদারদের পাওনা- সব বাকি। কেন্দ্র থেকে পাওয়া টাকা টুকি ও তাঁর লোকেরা আত্মসাৎ করেছেন। টুকির দলের লোকেরাই তাঁকে ছেড়ে চলে আসছেন। বিধায়কদের মুখ্যমন্ত্রীর উপরে আস্থা নেই।

পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছিল, রাজ্যপাল হয়তো আগামী কাল রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করতেন। কিন্তু তার আগেই টুকি আজ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপের অনুরোধ করে চিঠি পাঠান। তিনি লেখেন, বিশেষ স্বার্থে চালিত হয়ে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত রাজ্য সরকারকে অগ্রাহ্য করে অসাংবিধানিক সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছেন রাজ্যপাল।

অবশ্য এ দিন সন্ধ্যায় রাজ্যপাল ও বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে খানিকটা স্বস্তি পেয়েছেন টুকি। রাজ্যপালের নির্দেশ ও ডেপুটি স্পিকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের অরুণাচল বেঞ্চে হওয়া শুনানিতে রাজ্যের হয়ে লড়েন কপিল সিব্বল। দুই পক্ষের বক্তব্য শোনার পরে হাইকোর্ট রাজ্যপালের নির্দেশ ও অস্থায়ী বিধানসভায় নেওয়া সব সিদ্ধান্তে স্থগিতাদেশ দেয়। ১ ফেব্রুয়ারি দুই পক্ষের সব নথি ও দাবি নিয়ে ফের শুনানির দিন ধার্য হয়েছে। তাই, অস্থায়ী বিধানসভার তিন দিনের অধিবেশনের তৃতীয় দিনে আর অধিবেশন বসার সম্ভাবনা নেই। অবশ্য রাত অবধি বিক্ষুব্ধ বিধায়কদের নাহারলাগুনের হোটেলেই নজরবন্দি করে রেখেছে কংগ্রেসের শাসক গোষ্ঠী।

অরুণাচলের ঘটনা নিয়ে কাল রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে তাঁর হস্তক্ষেপ দাবি করেছিলেন সনিয়া গাঁধী। তার পর দশ নম্বর জনপথে ডাকা কংগ্রেসের কৌশল নির্ধারণ বৈঠকেই স্থির হয়ে যায়, এই বিষয়ে দল আইনি লড়াইয়ের পথে যাবে। আজ রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা গুলাম নবি আজাদ বলেন, ‘‘কেন্দ্রের শাসক দল জঘন্য খেলা খেলছে। সাংবিধানিক ব্যবস্থার শর্তকে পরোয়াও করছে না।’’ অরুণাচলে কেন্দ্র গণতন্ত্রকে হত্যা করছে, এই দাবিতে লোকসভায় ওয়াকআউট করে কংগ্রেস। বিজেপির দাবি, এতে কেন্দ্রের ভূমিকা নেই। কংগ্রেসই বিচিত্র কাজ করছে। কখনও বিধানসভা ভবনে তালা দেওয়া হচ্ছে। কখনও রাজ্যপালকে ধমক দিচ্ছেন শাসক দলের নেতারা। সংসদীয় মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডুর কথায়, ‘‘ওঁরা রাজ্যপালকে ধমক দিচ্ছেন আর কেন্দ্রকে দোষী করছেন। এটা মানা যায় না। সমস্যা থাকলে কোর্টে যাক।’’

তবে তলে তলে একটি বিষয়ে কংগ্রেস খুশি। তাঁদের মতে, অবিজেপি রাজ্যের শাসক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে সিবিআই হানা থেকে শুরু করে রাজ্যপালদের ‘অতিসক্রিয়তা’,-এই ঘটনাগুলিতে বিজেপি সম্পর্কে বিরূপ ধারণা তৈরি হয়েছে। অসমের বিধানসভা ভোটেও অরুণাচলের ঘটনাকে ব্যবহার করা যেতে পারে বলে মনে করছে কংগ্রেস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

guwahati high court arunachal pradesh congress
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE