Advertisement
০৩ মে ২০২৪

বাগপতের বুকে যেন এক টুকরো বালুচিস্তান

হাজার কিলোমিটার দূরে বিলোচপুরার গায়ে অবশ্য এ সবের আঁচ লাগে না। কোথায় পাথুরে, রুক্ষ মরুভূমির দেশ বালুচিস্তান, আর কোথায় গঙ্গা-যমুনা অববাহিকায় শ্যামল-সবুজ ধানের খেতে মোড়া উত্তরপ্রদেশের বাগপতের একটা অখ্যাত গ্রাম।

ছবি: সংগৃহীত।

ছবি: সংগৃহীত।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৮ ০৩:২২
Share: Save:

এ দেশের মানুষের কাছে দিনটির বিশেষ কোনও তাৎপর্যই নেই। কিন্তু বালুচিস্তানের মানুষের কাছে ২৭ মার্চ দিনটা যন্ত্রণার। ‘পরাধীনতা দিবস’! সাত দশক আগে এই দিনেই পাকিস্তানি সেনা দখল করেছিল বালুচিস্তান। স্রেফ বেয়নেটের খোঁচা আর বন্দুকের জোরে সেখানকার তৎকালীন শাসককে বাধ্য করেছিল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে। বালুচিস্তানের পরবর্তী ইতিহাস বলতে বিদ্রোহ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর কয়েক হাজার মানুষের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া।

হাজার কিলোমিটার দূরে বিলোচপুরার গায়ে অবশ্য এ সবের আঁচ লাগে না। কোথায় পাথুরে, রুক্ষ মরুভূমির দেশ বালুচিস্তান, আর কোথায় গঙ্গা-যমুনা অববাহিকায় শ্যামল-সবুজ ধানের খেতে মোড়া উত্তরপ্রদেশের বাগপতের একটা অখ্যাত গ্রাম। বিলোচপুরা। গ্রামের মানুষগুলোর কাছে এটাই দেশ। ১৫ অগস্ট ওঁরা গলা মেলান ‘জনগণমন অধিনায়ক’-এর সুরে। ‘পাকসার জামিন সাদ বাদ’ ওঁরা হয়তো শোনেনইনি কোনও দিন!

ওঁদের কথাই বা কে জানত! সেই মোগল সম্রাট বাবরের আমল থেকে এ দেশে থাকতে থাকতে ওঁরা তো ভারতীয়ই হয়ে গিয়েছেন। বছর তিনেক আগে, ১৫ অগস্ট লালকেল্লার বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বালুচিস্তানের স্বাধীনতা নিয়ে গলা চড়ানোর পরেই নানা আলোচনার সূত্রে ইতিহাসের ধুলো ঝেড়ে উঠে আসে বিলোচপুরা। মেরঠের ইতিহাসবিদ অমিত পাঠক, অমিত রাই জৈনের হাত ধরে।

বিলোচপুরের পুরনো বাসিন্দারা অবশ্য জানেন এ দেশের সঙ্গে তাঁদের শিকড়ের যোগের কথা। গ্রামের মোড়ল ইরফান পাঠান জানালেন, সম্রাট বাবরের বিখ্যাত গোলন্দাজ বাহিনীতে অনেকেই ছিলেন বালুচ। পানিপথের যুদ্ধ জিতে ভাড়াটে সৈন্যদের অনেকেই দেশে ফিরলেও বালুচ সেনাদের পছন্দ হয়ে যায় সবুজ এই জমির টুকরোটুকু। পরের পাঁচ শতক ধরে সেখানেই বেড়ে উঠেছে এক টুকরো বালুচিস্তান! ভারতীয় পরিচয়েই এ দেশের অংশ হয়ে উঠেছেন ওঁরা। সিপাই বিদ্রোহে অংশ নিয়ে শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের অন্যতম পরামর্শদাতা হন ইরফানের পূর্বপুরুষ আল্লা দিয়া খান। ধরাও পড়েন ব্রিটিশ সেনার হাতে। জেলেই প্রাণ হারান তিনি। তাঁর বংশধরেরা অনেকেই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। গোটা বিলোচপুরা গর্বিত তাঁদের ইতিহাস নিয়ে।

ওই পর্যন্তই। বিলোচপুরার নতুন প্রজন্ম চাষবাস বা পুলিশ-সেনার চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। তার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার সূত্রে পরিচিতি পেয়ে এ গ্রামে ঘুরে গিয়েছেন বালুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত অনেক নেতা। তাঁদের কাছে শুনেছেন, হাজার কিলোমিটার দূরে ‘স্বজন’রা কী ভাবে প্রতিদিন পাক সেনার অত্যাচার সহ্য করছেন। বালুচ নেতা, মাজদাক বালুচের ডাকে সাড়া দিয়ে ইরফানের মতো গ্রামের অনেকেই দিল্লি গিয়ে বিক্ষোভ দেখান পাক দূতাবাসের সামনে।

পাক-বিরোধী রাজনীতির আঁচ পেয়ে আসরে নেমেছে ‘হিন্দ বালুচ ফোরাম’ নামে একটি সংগঠন। এদের পিছনে আরএসএসের মদত রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। যদিও সংগঠনের কর্তারা তা মানতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য, বালুচদের যন্ত্রণার শরিক হয়ে অনেকেই পাকিস্তানের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন।

বালুচ আন্দোলনকারীরা অবশ্য এটুকুতে খুশি নন। তাঁরা চান, ১৯৭১-এ ভারত যে ভাবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল, সে ভাবেই পাশে দাঁড়াক বালুচিস্তানের। ‘বালুচিস্তানের গাঁধী’ বলে পরিচিত আবদুল কাদির বালুচ দিন কয়েক আগে দিল্লি এসে বলেছিলেন, ‘‘মোদী যদি আমাদের করতে চান, তা হলে আমাদের অস্ত্র দিন! যাতে আমরা লড়াই করতে পারি।’’ নিজে অহিংসার পথে স্বাধীনতার দাবিতে লড়াই চালালেও তাঁর দেশের যে আন্দোলনকারীরা সশস্ত্র আন্দোলন করছেন, তাঁদের জন্যই ভারতের কাছে অস্ত্র ভিক্ষা করছেন বালুচিস্তানের গাঁধী!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE