Advertisement
০৫ মে ২০২৪

নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে পাল্টা হামলার চিন্তা নয়াদিল্লির

১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধের সময় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘হট পারস্যুট’-এর নীতি নিতে চেয়েছিলেন।

কপ্টার-অ্যাম্বুল্যান্সে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জখম সেনাদের। ছবি: পিটিআই

কপ্টার-অ্যাম্বুল্যান্সে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জখম সেনাদের। ছবি: পিটিআই

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:৫৫
Share: Save:

১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধের সময় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘হট পারস্যুট’-এর নীতি নিতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ, পাকিস্তান থেকে আসা সন্ত্রাসবাদীদের ধাওয়া করে, প্রয়োজনে সীমান্ত বা নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে জঙ্গি ঘাঁটিতে প্রত্যাঘাতের সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছিলেন তাঁরা। মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটি তখন এ নিয়ে আলোচনাও করেছিল।

সতেরো বছর পর নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির বৈঠকে আজ আবার ‘হট পারস্যুট’-এর প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হল। এ নিয়ে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল ভিডিও প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে মন্ত্রিসভাকে বুঝিয়েছেন, ভারত-পাক সীমান্ত বা নিয়ন্ত্রণরেখা জুড়ে এখন যেটা চলছে তা সীমিত যুদ্ধেরই ক্ষুদ্র সংস্করণ। গোটা দেশ জুড়ে যা ছিল ছায়াযুদ্ধ, এখন তা এক সম্মুখসমরে পরিণত হওয়ার পথে। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীকে ডোভাল দেখিয়েছেন, কাশ্মীরে এ বার বরফ গলার পর থেকে পাক সেনা অন্তত ৪৫ বার সীমান্ত দিয়ে ঢুকে পড়ে আক্রমণ হেনেছে। সেটা কখনও ঘটেছে পুঞ্চে, কখনও বা উরি সেক্টরে। আর দক্ষিণ কাশ্মীরে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিরা বহু এলাকার দখল নিয়েছে।

সঙ্ঘ ও বিজেপির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাক সন্ত্রাস দমনে কঠোর প্রত্যাঘাতের নীতি অনুসরণ করতে চাইছে। উরির ঘটনায় তাঁদের গলার জোর আরও বেড়েছে। সঙ্ঘ থেকে বিজেপিতে আসা নেতা রাম মাধব আজ মন্তব্য করেছেন, ‘একটা দাঁতের জবাবে গোটা চোয়ালটাই নিয়ে নিতে হবে।’ কিন্তু সন্ত্রাস মোকাবিলার ক্ষেত্রে অন্য মতও রয়েছে, বিশেষ করে মন্ত্রিসভায়। রাজনাথ সিংহ নিজে আরএসএসের ঘনিষ্ঠ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি বলার চেষ্টা করেছেন, পাকিস্তান বিরোধিতাকে স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করলেও শান্তি প্রক্রিয়া থমকে দেওয়া ঠিক নয়। রাজনাথ এখনও পাকিস্তানের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে চান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজে পাকিস্তানের সঙ্গে একটা জোরদার মোকাবিলার পক্ষে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে সেই ইঙ্গিত মিলেছে। হট পারস্যুট নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে মোদী সেনাকে আরও বেশি করে পাক সীমান্তে প্রস্তুত থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। সেনার প্রস্তুতিও বাড়ানো হচ্ছে।

আড়াই বছর আগে নওয়াজ শরিফকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন নিজের শপথগ্রহণের অনুষ্ঠানে। তার পরে কখনও আবার কূটনীতির বাধাপথ থেকে সরে গিয়ে মোদী পৌঁছে গিয়েছেন লাহৌর। কখনও আবাব সন্ত্রাসে পাক মদত নিয়ে দেশ-বিদেশে জোরালো ভাবে সরব হতেও চেয়েছেন তিনি। তবে তাঁর এই ‘কখনও প্রেম কখনও ঘৃণা’ মডেলের পাকিস্তান নীতিতে ধারাবাহিকতার অভাব রয়েছে বলে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। উরির ঘটনার পরে সেই বিতর্ক থেকে বেরিয়ে মোদী আপাতত কঠোর পাক-বিরোধী নীতি নিয়েই এগোতে চান। মোদীর সমর্থনে এগিয়ে এসে রাম মাধব আজ বলেছেন, ভারতীয় সেনাদের হত্যা করেছে যারা, তাদের সুদে আসলে এর শাস্তি ফেরত পেতে হবে। ফলে চলতি পরিস্থিতিতে নভেম্বর মাসে ইসলামাবাদে সার্ক সম্মেলনে মোদীর যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

পাকিস্তান সম্পর্কে মোদীর কঠোর অবস্থান নেওয়ার পিছনে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ভূমিকা রয়েছে বলেও অনেকে মনে করছেন। উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব, গুজরাতে নির্বাচন আসছে। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, শুধু বিধানসভার ভোটই নয়, আগামী লোকসভা নির্বাচন পর্যন্তও এই কঠোর পাক-বিরোধী নীতি চলতে পারে।

কিন্তু পাকিস্তান সম্পর্কে ঠিক কতটা ও কী ধরনের কঠোর নীতি নেওয়া সম্ভব, সে বিষয়ে বিজেপির ভিতরে এবং বাইরে অনেক প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে। প্রথমত, কূটনীতিকরা বলেছেন, বাস্তবে সীমিত যুদ্ধ বলে কিছু হয় না। যে কোনও মুহূর্তে তা ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে। আর ভারত পাকিস্তান উভয়েই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র। দ্বিতীয়ত, সংযত থাকার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক চাপও রয়েছে। বিশেষ করে আমেরিকা দু’দেশের রাজনৈতিক উত্তাপ কমানোর পক্ষে। কূটনীতিকদের একাংশ বলছেন, উরির ঘটনা আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করার নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিকে বিচক্ষণতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে নয়াদিল্লিকে। মোদীকে তাই সব মতামতই খতিয়ে দেখতে হবে।

সে দিন অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায় আডবাণী আর ফার্নান্ডেজ চাইলেও হট পারস্যুট করতে দিতে রাজি হননি তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী যশোবন্ত সিংহ আর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্র। আর আজ আরএসএস তো বটেই— দল ও সরকারের কট্টরপন্থীরাও পাক বিরোধিতার সুর চড়াতে চাইছেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেও সে দিকেই ঝুঁকে রয়েছেন। কিন্তু গর্জনের পাশাপাশি শেষ পর্যন্ত বর্ষণ হবে কি না— তা নিয়ে এখনই কেউ বাজি ধরতে প্রস্তুত নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

India Terrosism Pakistan counter attack
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE