বয়স মাত্র ৫৩। এত অল্প বয়সে তিনি আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা ছিলেন। তারপর রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার গভর্নর। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের পছন্দের রঘুরাম রাজন স্বাধীনচেতা মানুষ বলেই পরিচিত। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে গত দু’বছর ধরে রঘুর সঙ্গে সমস্যা চলছিল সরকারের। আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবারও রঘুকে সরানোর জন্য ধনুক ভাঙা পণ নিয়েছিল।
রঘুর কার্যকালের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী সেপ্টেম্বর মাসে। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছিলেন সরকার তাঁকে আরেকটি মেয়াদের জন্য রাখতে উৎসাহী নয়। রাজ্যসভার সদস্য হয়েই সুব্রহ্মণ্যম স্বামী রঘুরাম রাজনের সরানোর বিষয়ে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন। স্বামী প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে তাঁকে অবিলম্বে সরানোর দাবি তোলেন। প্রকাশ্যে কিছু বিবৃতি না দিলেও আরএসএসের মধ্যস্থতাকারী কৃষ্ণগোপাল প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দেয় যে রঘুকে তাঁরা আমেরিকার এজেন্ট বলেই মনে করেন। তিনি শুধু সে দেশের গ্রিন কার্ড হোল্ডার নন, তিনি মার্কিন লবির হয়ে কাজ করছেন। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য কখনই রঘুরাম রাজনকে সরে যেতে বলেননি। কিন্তু দু’টি ঘটনায় রঘুর মনে হয় তাঁর সরে যাওয়াই ভাল। প্রথমত, প্রধানমন্ত্রী ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের পক্ষ থেকে রঘুর বিষয়ে একটি প্রশ্নের উত্তরে জানান, আরবিআই গভর্নরের মেয়াদ বাড়ানো হবে কি হবে না তা নিয়ে সংবাদমাধ্যমের উৎসাহের কারণ কি? রঘুর মনে হয় এর অর্থ হল প্রধানমন্ত্রী কিন্তু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বিদেশি সংবাদপত্রের কাছে জানালেন না যে রঘু থাকছেনই। দ্বিতীয়ত, সংবাদপত্রে একটি খবর প্রকাশিত হয় যে আরবিআই-র পরবর্তী গভর্নর কে হবে তা ঠিক করতে নিয়োগকর্তাদের একটি প্যানেল তৈরি হচ্ছে। সাধারণত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরেরা দু’টি মেয়াদ পদে থাকেন। আরবিআই আইনের ৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর পাঁচ বছরের অধিক ওই পদে থাকতে পারেন না। বেশির ভাগ গভর্নর পূর্ণ মেয়াদ দায়িত্ব সামলেছেন। এমনকী বিশ্ব ও দেশীয় আর্থিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বিমল জালান ছ’বছর গভর্নর ছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি বুঝতে পেরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে রঘুরাম রাজন নরেন্দ্র মোদীকে জানিয়ে দেন যে তিনি ওই পদে থাকতে ইচ্ছুক নন। এবং তিনি তাঁর পড়াশুনোর জগতে ফিরে যেতে চান।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে মুম্বই ফিরে যান রঘুরাম রাজন। সে দিন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের এক কর্তা এই প্রতিবেদকে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ও অরুণ জেটলি দু’দজনেই ব্যক্তিগত ভাবে রঘুরামকে পছন্দ করেন। কিন্তু এ ব্যাপারে আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবারের চাপ খুবই প্রবল। অরুণ জেটলি বলেছিলেন, সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর প্রকাশ্য বিরোধিতা ভারতীয় শিল্পমহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ উল্টে রঘুকে রাখার জন্য চাপ দিতে শুরু করেছেন। অরুণ অর্থমন্ত্রী হওয়ার পরে বেশ কিছু বিষয়ে রঘুর সঙ্গে মতপার্থক্য হয়েছিল। তারমধ্যে একটি বিষয় ছিল, সুদের হার কমানো। রঘু প্রথমে সরকারের চাপের কাছে নতি স্বাকীর করতে রাজি ছিলেন না। পরে কিঞ্চিত আপস করেছিলেন। আর এ ব্যাপারে অরুণের বক্তব্য ছিল-আমরা রাজনীতি করি। আমাদের কিছুটা রাজনৈতিক পপুলিজমের পথে হাঁটতেই হবে।
বাজেটের আগে রঘুর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ের বেশ কিছু বিরোধ হয়েছিল। রঘু প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি নৃপেন মিশ্রের কাছে চিঠি দিয়ে বেশ কিছু পরামর্শ দেন। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় জানিয়ে দেয়, বাজেট প্রস্তুতিতে আরবিআই কেন সরকারকে জ্ঞান দেবে! রঘু বিশেষজ্ঞদের একটি কমিটি গঠন করতে চেয়েছিলেন, যাদের কাজ হত বাজেটের ব্যাপারে সরকারকে সাহায্য করা। কিন্তু সেই প্রস্তাবও খারিজ করে দেয় প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়। সব দেখে শুনে রাজন সিদ্ধান্ত নেন-ঢের হয়েছে। আর নয়। তিনি যে এই বিষয়ে অনেক দিন আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন তার প্রমাণ হল মাস ছয়েক আগেই রঘুরামের স্ত্রী ও মেয়ে আমেরিকায় চলে যান।
অনেকেই এই প্রশ্ন করছেন যে রাজনকে তাহলে তাড়াল কে? মোহন ভাগবত? নরেন্দ্র মোদী? নাকি সেই সব শিল্পপতিরা যারা বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে কাপ্তানি করছিলেন বলে খড়্গহস্ত হয়েছিল আরবিআই। আসলে মোদী এবং মোহন ভাগবত কারণ ভিন্ন হলেও রাজনকে সরানোর ব্যাপারে এরা একমত ছিলেন। স্বাধীনচেতা রঘুর চেয়ে বশংবদ আমলা সরকারের জন্য ভাল। আর স্বদেশীর তাস ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা বাড়ানোটা মোহন ভাগবতের লক্ষ্য।
আরও পড়ুন...
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy