ঝুঁকি নিয়েছে দু’পক্ষই।
এক দিকে নরেন্দ্র মোদী। আগের প্রায় সব চেষ্টায় হোঁচট খেয়ে এখন নোট বাতিলে বাজি ধরেছেন। রোজ কোনও না কোনও সভায় জনতাকে দাঁড় করিয়ে তালি বাজিয়ে দেখাচ্ছেন, কষ্ট ভোগ করেও মানুষ তাঁর সঙ্গে। অন্য দিকে ঝাঁপিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নোট-বিতর্ককে কাজে লাগিয়ে মোদী-বিরোধী মঞ্চকে একজোট করার চেষ্টায় নেমেছেন সর্বাত্মক ভাবে। দু’জনের কারওই মেপে চলার কোনও ব্যাপার নেই। নোট বাতিলের পক্ষে মোদী এবং বিপক্ষে মমতা ব্যাট করছেন ঝোড়ো গতিতেই।
মানুষের ভোগান্তিকে হাতিয়ার করে আসরে রয়েছেন রাহুল গাঁধী, সীতারাম ইয়েচুরি, লালুপ্রসাদ যাদব, নীতীশ কুমার, মুলায়ম সিংহ যাদব, মায়াবতী, ওমর আবদুল্লাও। তবে পা ফেলছেন সতর্ক হয়ে। ভোগান্তি সহ্য করতে হলেও মোদীর কালো টাকা বিরোধী অভিযান নিয়ে আম জনতা প্রকৃত কতটা রুষ্ট, সেই জলটাও মেপে চলেছেন তাঁরা।
সংসদের অধিবেশন শুরুর আগে সংশ্লিষ্ট এই সব পক্ষের দড়ি টানাটানির এক প্রস্ত মহড়া হয়ে গেল আজ।
সকালেই ভোটমুখী উত্তরপ্রদেশে প্রধানমন্ত্রী মোদী আজ নেহরুর জন্মদিনেই তাঁকে আক্রমণ করে একই সঙ্গে বিঁধেছেন রাহুলকে। নোট বাতিল নিয়ে মানুষের হেনস্থার প্রসঙ্গে টেনেছেন ইন্দিরাকেও। বলেছেন, কুর্সির জন্য ১৯ মাস দেশ জেলখানা হয়েছিল জরুরি অবস্থায়। আর আমি তো গরিবের জন্য মাত্র ৫০ দিন চেয়েছি! পরে দিল্লি ফিরে দলের বৈঠকে বলেছেন, পিছু হঠবেন না নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত থেকে। জানিয়েছেন, রাত জেগে জেগে মানুষের ভোগান্তি লাঘবের ব্যবস্থা তিনি করছেন।
এই নাছোড় মোদীর বিরুদ্ধেই প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে চাইছেন মমতা। রাষ্ট্রপতির কাছে পরশু তৃণমূল দলবল নিয়ে যাওয়ার আগে আজ দিল্লিতে বিরোধী দলগুলির একপ্রস্ত বৈঠক হয়েছে সংসদ ভবনে। তাতে কংগ্রেসের গুলাম নবি আজাদ, আনন্দ শর্মা, মল্লিকার্জুন খাড়্গে, তৃণমূলের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়-ডেরেক ও ব্রায়েন, লালুর দলের প্রেমচন্দ্র গুপ্ত, নীতীশের শরদ যাদব ছিলেন। ‘যাব কি যাব না’ করে একটু দেরিতে এসেছিলেন ইয়েচুরিও। সিপিআইয়ের ডি রাজাও।
চারটি বিষয়ে সকলের মত প্রায় এক। প্রথমত, সকলে কালো টাকার বিরুদ্ধে অভিযানের সমর্থক। দ্বিতীয়ত, সেই কাজ যে প্রক্রিয়ায় হচ্ছে, তার জেরে মানুষের ভোগান্তির বিপক্ষে সবাই। তৃতীয়ত, উত্তরপ্রদেশে অন্য দলকে বিপাকে ফেলে বিজেপি নিজেদের টাকার বন্দোবস্ত আগে করে রেখেছে বলে বিরোধীদের সকলের অভিযোগ। চতুর্থত, রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়ারও পক্ষে সকলে। কিন্তু হাত মিলিয়ে, একে অপরের বুকে জড়িয়ে বৈঠক করেও একটি ‘কিন্তু’ থেকে গিয়েছে! রাষ্ট্রপতির কাছে কবে যাওয়া হবে, সে ব্যাপারে একমত হয়নি বিরোধীদের সবাই। যার অর্থ, মমতা ১৬ তারিখ দুপুর দেড়টায় সময় নিয়েছেন। এত তড়িঘড়ি বাকি বিরোধীরা যেতে রাজি নয়।
ইয়েচুরি থেকে গুলাম নবিদের যুক্তি, আগে সংসদে সরকারকে চেপে ধরা হোক। তার পরে পরিস্থিতি দেখে রাষ্ট্রপতি ভবন তো শেষ গন্তব্য। গোড়াতেই রাষ্ট্রপতির কাছে দরবার কেন? রাষ্ট্রপতি তো বলতেই পারেন, আগে সরকারের বক্তব্য শুনুন। কংগ্রেসের মতো দলগুলির মমতার এই ‘নেতৃত্ব’ মেনে নিতে যে আপত্তি আছে, সে কথাও গোপন করছেন না ঘরোয়া স্তরে। পথ খুঁজতে অবশ্য কাল মমতা দিল্লি আসার আগেই ফের বৈঠক হবে এই নেতাদের। গুলাম নবির কথায়, ‘‘এটা ক, খ বা গ –র নেতৃত্বের ব্যাপার নয়। মানুষের ভোগান্তি যে হচ্ছে, সে বিষয়ে সবাই একমত। তবে প্রতিবাদের পথ ও ভাষা নিয়ে একে অপরের সঙ্গে কিছুটা ফারাক রয়েছে। ’’
মমতার নেতৃত্বে রাষ্ট্রপতি ভবনে যাওয়া নিয়ে যে ইয়েচুরিদের আপত্তি আছে, সকালেই তা স্পষ্ট করে দিয়েছে সিপিএম। বরং বিজেপি-র ঘাঁড়ে বন্দুক রেখে মমতাকে বিঁধে সীতারাম বলেছেন, কেন্দ্র কালো টাকার বিরুদ্ধে এত পদক্ষেপ করলে সারদা-নারদা বাদ যায় কী করে? বেলা শেষে রাষ্ট্রপতি ভবনে যাওয়া নিয়ে ইয়েচুরির সুরেই সুর মেলাতে দেখা গেল কংগ্রেসকে। সংসদে কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের সমন্বয় কয়েক বছর ধরেই মসৃণ। হঠাৎ সেখানে মমতার অনুপ্রবেশে চিড় ধরতে দিতে রাজি হয়নি দু’পক্ষই। তা ছাড়া, সিপিএম বাংলার রাজনীতির কথাও মাথায় রাখতে চেয়েছে। কংগ্রেস-সিপিএমের এই গা বাঁচিয়ে চলা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তৃণমূলের মুখ্য জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেন, ‘‘অন্য কিছু দলের মনোভাব আরও ৮-১০ দিন পর রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়ার। আমরা বলছি, গড়িমসি ঠিক হবে না।’’ আর ঘরোয়া আলোচনায় মমতার বক্তব্য, কেউ যাক বা না যাক, তৃণমূল যাবে। তৃণমূল সূত্রের দাবি, কেজরীবাল তো যাচ্ছেনই। আরও কিছু দলকে সঙ্গে পেতে ফের বৈঠক হবে। শিবসেনার সঙ্গেও কথা চলছে। শরদ, ওমরকে সঙ্গে পেতে সক্রিয় দীনেশ ত্রিবেদীও।
প্রধানমন্ত্রীও চুপ করে বসে
নেই। বিজেপি-র মমতা-বিরোধী মুখ সিদ্ধার্থনাথ সিংহকে আজই তৃণমূল নেত্রীর বিরুদ্ধে সারদা-নারদা, বোমা-সন্ত্রাস নিয়ে তোপ দাগতে নামানো হয়েছে। মোদী নিজেও বিরোধীদের এক হাত নিয়েছেন।
আজ গাজিপুরের সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘সীমান্তপারের শত্রুরা জাল নোট ভারতে ঢোকাচ্ছিল। দুশমনের সেই চাল কি চলতে দেওয়া উচিত? যাঁরা বিরোধিতা করছেন, সেই সব নেতাদের কাছে আমার প্রশ্ন, সন্ত্রাসবাদ-মাওবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সঙ্গে আছেন? সাহস থাকলে প্রকাশ্যে বলুন, কালো টাকা চলা উচিত! দুর্নীতি-বেইমানি চলা উচিত!’’
তা ছাড়া আজ সকালে দলের নেতাদের প্রধানমন্ত্রী আশ্বস্ত করে জানান, সরকার ৫০ দিন সময় নিলেও আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। বিরোধীদেরও অনেকে মনে করছেন, মানুষের ভোগান্তি কমে গেলে এই প্রশ্নে এখনই আগ বাড়িয়ে চড়া প্রতিবাদ পরে ব্যুমেরাং হতে পারে। তবে তৃণমূলের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়েরা মনে করেন, অন্তত বিরোধী দলগুলির সঙ্গে একটি মঞ্চের প্রস্তুতি তো হয়েছে। সমন্বয়ে সুবিধা হবে অন্য বিষয়েও। কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্কও সহজ হয়েছে। তৃণমূল নেতৃত্বের মতে, এটাই মমতার ‘মাস্টার স্ট্রোক’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy