Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

মোদীর মেহনতের ফলে মিশেল বিতর্কের

একশো ভাগ মেহনতের ফল মিলছে একশো দিনে। দিল্লি থেকে প্রায় ছ’হাজার কিলোমিটার দূরে বসে কতকটা এই ভাষাতেই নিজের সরকারের মূল্যায়ন করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর সরকারের একশো দিন পূর্ণ হচ্ছে কাল। মোদীর পূর্বসূরিরা সরকারের প্রথম একশো দিনের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করতেন। তিনি অবশ্য সে পথে হাঁটেননি। নিজেও কাল থাকছেন না দেশে। একশো দিনকে ঘিরে কোনও উৎসবও করছেন না।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:৫১
Share: Save:

একশো ভাগ মেহনতের ফল মিলছে একশো দিনে। দিল্লি থেকে প্রায় ছ’হাজার কিলোমিটার দূরে বসে কতকটা এই ভাষাতেই নিজের সরকারের মূল্যায়ন করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

তাঁর সরকারের একশো দিন পূর্ণ হচ্ছে কাল। মোদীর পূর্বসূরিরা সরকারের প্রথম একশো দিনের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করতেন। তিনি অবশ্য সে পথে হাঁটেননি। নিজেও কাল থাকছেন না দেশে। একশো দিনকে ঘিরে কোনও উৎসবও করছেন না। কিন্তু যে কোনও সরকারের প্রথম একশো দিনের সাফল্য ও ব্যর্থতার যেমন চুলচেরা বিচার হয়, তেমনটা হচ্ছে মোদী সরকারেরও। রাজধানীতে আলোচনার বিষয় এখন একটাই। বিপুল জনমত নিয়ে আসা একটি শক্তিশালী সরকারের থেকে মানুষের যে পাহাড়প্রমাণ প্রত্যাশা, তার কতটা পূরণ করতে পারলেন মোদী? নীতিপঙ্গুত্ব কাটিয়ে অর্থনীতির হাল ফেরানোর কিছু চেষ্টা হয়েছে, তবে বিতর্কও পিছু ছাড়েনি তাঁর।

মোদী নিজে একশো দিনের তত্ত্বে বিশ্বাসী নন। তবু সরকারের একশো দিন নিয়ে জনমনে যে প্রবল কৌতূহল রয়েছে, সে ব্যাপারে ওয়াকিবহাল তিনি। যে কারণে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার আগেই তিনি সরকারের ১০০ দিনের কাজের খতিয়ান তুলে ধরার নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন মন্ত্রীদের। সেই সূত্র ধরে অরুণ জেটলি গত শনিবারই সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়েছেন, কী ভাবে মোদী-জমানা শুরু হতেই দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। আর জাপানে বসেই মোদীর মন্তব্য, “প্রথম একশো দিনে যা যা পদক্ষেপ করেছি, তার ফল স্পষ্ট।”

মোদী নিজে নন, তাঁর এই মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে আজ মুখ খোলেন তাঁর সেনাপতি জেটলি। তাঁর কথায়, “গত এক দশকে দেশবাসী এমন এক জন প্রধানমন্ত্রীর অভাব বোধ করেছে, একাধিক ক্ষমতাকেন্দ্রের বদলে একক ভাবে যাঁর হাতে থাকবে ক্ষমতার রাশ। যিনি শক্ত হাতে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। নরেন্দ্র মোদী সেই অভাব পূরণ করেছেন। সিদ্ধান্ত যতই কঠোর হোক না কেন, মোদী তা নিতে পারেন। ভবিষ্যতে দেশ কোন পথে এগোবে, তার দিশানির্দেশ দিতে পারেন। আগামী কয়েক মাসে এর ফল সকলের সামনে চলে আসবে।”

এই মুহূর্তে বলার মতো সাফল্য?

জেটলির মতে, মনমোহন সরকার যে সিদ্ধান্তহীনতা ও নীতিপঙ্গুত্বের শিকার ছিল, সেই দশা কেটে উন্নয়নের চাকা চলতে শুরু করেছে। এটাই প্রথম বড় সাফল্য। এতে আম জনতার উন্নয়ন যেমন হচ্ছে, তেমনই শিল্পপতিদের আস্থাও ফিরে এসেছে। মোদী শিল্পবন্ধু পরিবেশ তৈরি করছেন, আবার সামাজিক দিকেও সমান গুরুত্ব দিচ্ছেন। মোদী মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্যেরও বক্তব্য, বিগত সরকার যা যা করতে পারেনি, মোদী তা পেরেছেন। প্রথম একশো দিনেই প্রশাসনকে দিশা দেখিয়েছেন তিনি। সব পরিবারের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার মতো যুগান্তকারী পদক্ষেপ শুরু হয়েছে। মন্ত্রীরা সময়ে দফতরে আসছেন। আমলারা আরও খোলা মনে কাজ করছেন। এই ক’দিনে বিচার ব্যবস্থায় সংস্কার এনেছেন বলেও দাবি মোদীর মন্ত্রীদের। তাঁদের তালিকায় রয়েছে আরও। যেমন, বিদেশি লগ্নির জন্য পরিকাঠামো ক্ষেত্র খুলে দেওয়া, বিমা বিল এবং পণ্য-পরিষেবা কর চালুর ব্যাপারে উদ্যোগ। জনমোহিনী সিদ্ধান্ত না হলেও রেলের ভাড়া বাড়ানোর হিম্মত দেখিয়েছেন মোদী। যোজনা কমিশন বাতিল করে নতুন সংস্থা গড়ার প্রক্রিয়া চলছে। প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকেই বিশেষ তদন্তকারী দল গড়েছেন কালো টাকা উদ্ধারে। সরকারে সাধারণ মানুষের অংশীদারি সুনিশ্চিত করছেন।

মন্ত্রিসভার সদস্যদের আরও বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসার আগে থেকেই মোদী যে ভাবে বিদেশনীতিকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চেয়েছেন, সেই ধারা এখনও অব্যাহত। শপথের অনুষ্ঠানে যেমন তিনি নওয়াজ শরিফকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, তেমনই সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘনের প্রশ্নে কড়া জবাবও দিয়েছেন পাকিস্তানকে। ইরাক থেকে বন্দি ভারতীয়দের দেশে ফেরানোও বড় কূটনৈতিক সাফল্য।

শিল্প ও বণিক সভাগুলি কী ভাবে মূল্যায়ন করছে এই সরকারের?

বণিকসভা সিআইআই-এর সভাপতি অজয় শ্রীরাম বলেন, “নরেন্দ্র মোদীর সরকার আসার পরে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। কারণ, নতুন সরকার আর্থিক উন্নয়ন ও সংস্কারের প্রতি দায়বদ্ধ। বিভিন্ন মন্ত্রী ও আমলাদের সঙ্গে কথা বলার সময় আমরা দেখছি, তাঁরা শিল্পমহলের মতকে অনেক বেশি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীতে বিবেচনা করছেন। ব্যতিক্রমী ভাবনাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।”

ব্যবসায়ীদের প্রসঙ্গে এ দিনই মোদী বলেছেন, “ব্যবসায়ীরা যে সব সময় ছাড় চান, তা নয়। তাঁরা ব্যবসা করার জন্য একটি সুষ্ঠু পরিবেশ চান। সেটি দেওয়াই আমাদের কাজ।” দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন দিতে মোদী যে ভাবে প্রত্যেক মন্ত্রীকে নজরে-নজরে রেখেছেন, তাতে মন্ত্রীরাও সব তটস্থ। মন্ত্রীরাই কবুল করছেন, কোনও রকম দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিতে তাঁরা ভয় পাচ্ছেন। মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকরের কথায়, “মোদী আমাদের মিশনের মন্ত্র দিয়েছেন। কমিশনের নয়।”

কিন্তু মোদী সরকারের একশো দিনের এই যাত্রাপথে সকলেই যে সমান ভাবে আপ্লুত, তা নয়। মোদী ঝড়ের ধাক্কায় গত বারের শাসক দল এখন প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা পেতেই হিমসিম খাচ্ছে। তাদের বক্তব্য, কংগ্রেস শুধু নয়, দেশবাসীও সমান ভাবে হতাশ। ভোটে মোদী প্রচার করেছিলেন, ক্ষমতায় এলেই তিনি যেন জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় ‘আচ্ছে দিন’ (সুদিন) এনে দেবেন। তেমন কিছু তো হয়ইনি। উল্টে কয়েকটি রাজ্যের সাম্প্রতিক উপনির্বাচনই দেখিয়ে দিচ্ছে, মানুষ বুঝতে পারছেন মোদীর প্রতিশ্রুতি সব ফাঁপা। তাঁরা তাই প্রত্যাখ্যান করছেন বিজেপিকে।

কংগ্রেস নেতা রাজীব শুক্লর প্রশ্ন, “মোদীর সাফল্য কোথায়? যে সবের উদ্বোধন তিনি করছেন, তা সবই তো ইউপিএ আমলে গৃহীত। তা সে কাটরা পর্যন্ত রেলই হোক বা আইএনএস কলকাতা। যে আর্থিক বৃদ্ধি নিয়ে মোদী সরকার ঢাক পেটাচ্ছে, সেটিও ইউপিএ-র দৌলতে।” শুক্লর দাবি, এখনও পর্যন্ত এই সরকারের ছাপ কোথাও নেই। উল্টে মোদী ক্ষমতায় আসতেই দেশ জুড়ে গোষ্ঠী-সংঘর্ষ বেড়েছে, নিত্যদিন বিজেপির নেতারা সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিচ্ছেন। কোথাও বিতর্ক ধর্মান্তরকরণ নিয়ে, কোথাও বিকিনি পরা নিয়ে। আর মোদী নিজে একনায়কতন্ত্র চালাচ্ছেন। লালকৃষ্ণ আডবাণীদের পাঠাচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমে।

কংগ্রেসের অভিযোগের জবাবে বিজেপি নেতা রাজীবপ্রতাপ রুডি বলেন, “মোদী সাম্প্রদায়িক বা একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাসী হলে এত মানুষের ভোট পেতেন না। ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’-এর মন্ত্র নিয়ে চলছেন তিনি। তারই অঙ্গ হিসেবে জাত-ধর্ম নির্বিশেষে সব পরিবারের জন্য ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হচ্ছে। লালকেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তৃতা দিয়েছেন, সেটি তাঁর পক্ষেই সম্ভব। সেখানে তিনি শৌচালয় তৈরির মতো মৌলিক সমস্যা নিয়ে সরব হয়েছেন। তাঁর অনুপ্রেরণাতেই শিল্পমহল শৌচালয় নির্মাণে এগিয়ে আসছে। সমাজের তৃণমূল স্তর পর্যন্ত সকলের সুদিন যে আসছে, অচিরেই তা দেখা যাবে। পাঁচ বছর পর সেই রিপোর্ট কার্ডও পেশ হবে জনতার সামনে।”

এটা ঘটনা, লালকেল্লা থেকে প্রথম ভাষণে ধর্ষণ বা শৌচালয়ের মতো সমস্যার কথা তুলে মোদী কিছুটা ভিন্ন আদলের সরকার দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু আম আদমির জন্য কাজ করা, দক্ষ ও স্বচ্ছ প্রশাসন দিতে কিছুটা তৎপরতাই শেষ কথা নয়, জরুরি কিছু সংস্কারের কাজে এখনও তাঁর ভূমিকা নিয়ে উচ্ছ্বসিত নন অর্থনীতির পর্যবেক্ষকরা। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে বিপুল অঙ্কের চুক্তি বাতিল করার পিছনে দেশীয় রাজনীতি ও সহযোগীদের মন রাখার আগ্রহও দেখতে পাচ্ছেন তাঁরা। ভর্তুকি তোলা, নয়া করব্যবস্থা চালু করার ক্ষেত্রেও মোদী সরকার প্রত্যাশা পূরণ করে ফেলেছে এমনটা নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

narendra modi 100 days of govt bjp
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE