অসমিয়া ‘জাপি’, ‘গামোসা’য় স্বাগত মোদীকে। বৃহস্পতিবার অসম জয়ের পর দিল্লিতে বিজেপির সদর দফতরে। ছবি: রমাকান্ত কুশওয়াহা।
উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের আগে বিহার-দিল্লির ক্ষত মিটিয়ে যে সঞ্জীবনী বটিকাটি দরকার ছিল, আজ বিধানসভা ভোটের ফল তা তুলে দিল নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের হাতে। আর দুই রাজ্যে ক্ষমতা হারিয়ে এবং আরও দুই রাজ্যে জোটের হারে প্রশ্ন উঠে গেল রাহুল গাঁধীর নেতৃত্ব নিয়ে। কংগ্রেসের পক্ষে পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে, মোদী-বিরোধী জোট এখন ভয় পাচ্ছে তাদের ছুঁতে!
পশ্চিমবঙ্গে বাম-কংগ্রেস জোটকে উড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপুল জয়েও বিজেপির দখলে তিনটি আসন এবং ১০ শতাংশের বেশি ভোট, তামিলনাড়ুতে ডিএমকে-কংগ্রেস জোটকে হারিয়ে আম্মার জয় এবং কেরল-অসমে কংগ্রেসের হারকে সার্বিক ভাবে নিজেদের জয় হিসেবেই দেখছেন মোদী-অমিত শাহরা। কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই মোদী গোটা দেশকে ‘কংগ্রেস-মুক্ত’ করার যে স্লোগান দিয়েছিলেন, সেই লক্ষ্যেই আরও এক ধাপ এগোনো গেল বলে আজ দাবি করলেন অমিত শাহ। ফলে দিল্লি ও বিহার বিধানসভার ভরাডুবির পর দলের কর্মীদের মনোবলে যে ধাক্কা লেগেছিল, উত্তরপ্রদেশ-সহ গো-বলয়ের বিভিন্ন রাজ্যে ভোটের আগে সেই ক্ষত অনেকটাই মেরামত হল। শুধু তা-ই নয়, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রথম রাজ্য হিসেবে অসমে জয় বিজেপিকে নতুন অক্সিজেন দিয়েছে। মোদী সরকারের সাফল্য নিয়েও অনেক প্রশ্ন উঠেছিল। সরকারের দু’বছর পূর্তির মুখে এই ফলের পর এ বার আরও বড় করে মোদী-সরকারের সাফল্য মেলে ধরা হবে।
সেটার প্রতিফলনও দেখা গেল বিজেপির সদর দফতরে। সন্ধ্যায় দলের সংসদীয় বোর্ডের বৈঠকে যোগ দিতে আসেন মোদী। সেখানে উপস্থিত ছিলেন অমিত শাহ, অরুণ জেটলিরা। দফতরের সামনে জড়ো হওয়া কয়েক হাজার উচ্ছ্বসিত সমর্থকের পুষ্পবৃষ্টি আর মুখে বহু দিন পরে ‘মোদী মোদী’ ধ্বনি বুঝিয়ে দিল, ‘ব্র্যান্ড মোদী’র পুনরুজ্জীবন হয়েছে বিজেপির অন্দরে। গত কয়েক মাসে নানা কারণে ধাক্কা খাওয়া মোদীর কাছে আজ সত্যিই ‘অচ্ছে দিন’। অসমের ‘গামোসা’ পরিয়ে বরণ করার পরে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় মোদী বোঝালেন, তাঁর সরকারের উন্নয়নের ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে যে উন্নতি এসেছে, তা স্বীকৃতি পেল। সংগঠন নেই, এমন রাজ্যেও এখন স্বীকৃতি পাচ্ছে বিজেপি। পাশাপাশি বোঝালেন, তিনি এনডিএ-কেও শক্তিশালী করার পথে হাঁটবেন। সেই পথে হেঁটেই আজ অমিত শাহ এনডিএ জোটে ফেরার ডাক দিয়েছেন পুরনো জোটসঙ্গী মমতাকে।
পাঁচ রাজ্যে ভোটের আগে অসম ছাড়া আর কোথাওই সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখেনি বিজেপি। কিন্তু এ বারে তারা যে ভাবে পশ্চিমবঙ্গে তিনটি আসনে জিতেছে এবং কেরলে প্রথম বার বিধানসভায় পা রাখার সুযোগ পেয়েছে, সেটিই বড় জয় হিসেবে দেখছে দল। কারণ, এত দিন বিজেপি মূলত গো-বলয়ের দল হিসেবেই পরিচিত ছিল। কর্নাটকে এক বার ক্ষমতা দখল করেও পরে তা হাতছাড়া হয়েছে। বিহার নির্বাচনের পর বাড়ির বাইরে বেরোননি অমিত শাহ। কিন্তু আজ বাড়ির বাইরে পা রেখে হাসিমুখে সাংবাদিক বৈঠক করলেন। সকাল থেকে টুইটে অভিনন্দনের বন্যায় ছয়লাপ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীও।
অন্য দিকে রাহুল গাঁধী। আজ টুইটে তিনি হার স্বীকার করে নিয়েছেন। ভবিষ্যতে আরও মেহনত করে মানুষের আস্থা অর্জনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। কিন্তু এই হারের পর দলের মধ্যেই রাহুলের নেতৃত্ব প্রশ্নের মুখে পড়ে গেল। অসম-কেরল হাত থেকে তো ফস্কে গেলই, পশ্চিমবঙ্গে বামেদের সঙ্গে জোটেও সায় দিয়েছিলেন রাহুল। নীতীশ কুমারের শপথ অনুষ্ঠানে মমতার নিষেধ সত্ত্বেও। দলের নেতা শশী তারুর প্রকাশ্যেই দাবি তুলেছেন, এ বারে দলের কেন্দ্রীয় সংগঠনে রদবদল করা উচিত।
কংগ্রসের তরফে রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা অবশ্য বলেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে রাহুলের কোনও ভূমিকা নেই। রাজ্য নেতৃত্বের কোথায় গরমিল ছিল, সেটি পর্যালোচনা করা হবে।’’ মুখে এ কথা বললেও কংগ্রেস নেতৃত্বের আশঙ্কা, এ বারে মোদী-বিরোধী গোষ্ঠীর মুখ হওয়া থেকেও ক্রমশ ছিটকে পড়ছেন রাহুল গাঁধী। ক’দিন আগেও পরবর্তী লোকসভা ভোটে রাহুলের মোকাবিলায় নিজেকে এগিয়ে রাখার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছিলেন নীতীশ কুমার। এখন মমতা থেকে জয়ললিতা— অনেকেই সেই দৌড়ে সামিল হওয়ার দাবি তুলতে পারেন। কংগ্রেস বুঝতে পারছে, একের পর এক বিপর্যয়ে এ বারে দল ধীরে ধীরে অচ্ছুৎ হয়ে পড়ছে। অসমের এইউডিএফ নেতা বদরুদ্দিন আজমল আজ বলেই ফেলেছেন, ‘‘কংগ্রেসের সঙ্গে যে যাবে, তার পতন অনিবার্য!’’
কংগ্রেসের এই ‘সর্বনাশে’ বিজেপি নিজেদের ‘পৌষ মাস’ দেখছে। কংগ্রেসের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে তাই আরও বেশি করে আক্রমণ শানাতে শুরু করেছেন অমিত শাহরা। মোদীর উন্নয়ন বাস্তবে দেখা যায় না বলে যে অভিযোগ উঠছে, তার দায়ও সুকৌশলে ঠেলে দিলেন কংগ্রেসের ঘাড়ে। এই কৌশলে ভর করে মোদীর দু’বছরের কাজেও সিলমোহর বসিয়ে নিতে চাইছে বিজেপি। দিল্লি ও বিহারের হারের পর আজকের জয়ে অমিত শাহ দলে ফের নিজের সাংগঠনিক কর্তৃত্ব আরও শক্ত করে ফেলার সুযোগ পেলেন। সঙ্ঘ পরিবার অতীতে তাদের নেতাদের মুখ করার দাবি তুলত। কিন্তু এ বারে সঙ্ঘের বাইরের ব্যক্তি সর্বানন্দ সোনোয়ালকে অসমের মুখ করা, এমনকী কংগ্রেস থেকে আসা শক্তিশালী নেতা হিমন্ত বিশ্বশর্মাকে গুরুত্ব দেওয়ার কৌশলও কাজ দিয়েছে। অ-বিজেপি রাজ্যে বিস্তার ঘটাতে এনডিএ-কেও যে বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে, সেটিও প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। ফলে সব মিলিয়ে সঙ্ঘকেও কিছুটা প্রশমিত করতে পেরেছেন অমিত শাহ।
কিন্তু আসল পরীক্ষা যে এ বারে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, পঞ্জাব, হিমাচল মায় মোদীর নিজের রাজ্য গুজরাতও— সেটি ভালই জানেন মোদী-শাহ। অমিতের কথায়, ‘‘যে ভাবে বিজেপি তাদের সংগঠন কেরল থেকে কাশ্মীর, কচ্ছ থেকে কামরূপে বিস্তার করতে পারছে, তা পরের নির্বাচনগুলির ভিত। ২০১৯ সালের লোকসভায় এর সুফল পাওয়া যাবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy