Advertisement
১১ মে ২০২৪
কোণঠাসা অখিলেশ

কোণঠাসা অখিলেশ, ভাই আপন ছেলে পর নেতাজির

রাতভর ভুগিয়েছে দাঁতের যন্ত্রণা। কিন্তু চোখের সামনে নিজের হাতে গড়া রাজ্যপাট, নিজের পরিবার ভাঙতে দেখলে, দাঁতের কথা আর কারই বা মনে থাকে! দাঁতের ব্যথা ভুলে, দল ও পরিবারে দ্বন্দ্ব ধামাচাপা দিতে মুলায়ম সিংহ যাদব আজ বার্তা দিলেন, ‘আল ইজ ওয়েল’! ঘোষণা করলেন, সব ঠিকঠাক চলছে। পরিবার একজোট রয়েছে তাঁর।

‘ঐক্যের বার্তা’ দিতে সাংবাদিক বৈঠক মুলায়মের। ভাই শিবপাল পাশে থাকলেও গরহাজির ছেলে অখিলেশ। মঙ্গলবার লখনউয়ে। ছবি: পিটিআই

‘ঐক্যের বার্তা’ দিতে সাংবাদিক বৈঠক মুলায়মের। ভাই শিবপাল পাশে থাকলেও গরহাজির ছেলে অখিলেশ। মঙ্গলবার লখনউয়ে। ছবি: পিটিআই

প্রেমাংশু চৌধুরী
লখনউ শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:১৯
Share: Save:

রাতভর ভুগিয়েছে দাঁতের যন্ত্রণা। কিন্তু চোখের সামনে নিজের হাতে গড়া রাজ্যপাট, নিজের পরিবার ভাঙতে দেখলে, দাঁতের কথা আর কারই বা মনে থাকে!

দাঁতের ব্যথা ভুলে, দল ও পরিবারে দ্বন্দ্ব ধামাচাপা দিতে মুলায়ম সিংহ যাদব আজ বার্তা দিলেন, ‘আল ইজ ওয়েল’! ঘোষণা করলেন, সব ঠিকঠাক চলছে। পরিবার একজোট রয়েছে তাঁর। ঐক্যবদ্ধ রয়েছে দলও। বললেন বটে, কিন্তু ঐক্যের বার্তা দিতে গিয়ে ভাই শিবপাল সিংহ যাদব ও ছেলে অখিলেশ যাদবকে দু’পাশে দাঁড় করাতে পারলেন না। পাশে রইলেন ভাই শিবপাল। গরহাজির থেকে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী ছেলে।

বিরোধীরা কটাক্ষ করার সযোগ ছাড়ছেন না, মুলায়ম যা-ই বলুন, তাঁর দলটা এখন আসলে ‘সমাজবিবাদী পার্টি’! হবে না-ই বা কেন, দলের মাথায় থেকে যে ‘নেতাজি’ ঐক্যের বার্তা দিচ্ছেন, তিনি মোটেই সমদৃষ্টিতে দেখছেন না যুযুধান দুই শিবিরকে। গত কাল ও তার আগের ক’দিন ধরে বহু টানাপড়েন আর নাটকের পরেও মুলায়ম আজ ছেলের উপরেই জোর চাপ তৈরির চেষ্টা চালালেন। অখিলেশ এই চাপের কাছে মাথা নোয়াচ্ছেন, সরাসরি এমন কোনও বার্তা না দিলেও সুর অনেকটাই নরম করে মন দিয়েছেন দলে নিজের সমর্থনের ভিত মজবুত করতে। এ দিন প্রকাশ্যে কোনও বিদ্রোহী মন্তব্য করেননি তিনি।

শিবপালকে পাশে রেখে মুলায়ম আজ অখিলেশকে যা জানিয়েছেন, তা হল: • ছেলে অখিলেশ নয়, ভাই শিবপালেরই পাশে রয়েছেন তিনি। • অটটু থাকছে অমর সিংহের প্রতি তাঁর প্রেম। • আপস করতে হবে অখিলেশকেই। • উত্তরপ্রদেশ ভোটের আগে অখিলেশ যাদবকে দল মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করবে না।
• দল বিধানসভায় গরিষ্ঠতা পেলে তখন মুখ্যমন্ত্রী ঠিক হবে।
• অখিলেশের জন্য একমাত্র সান্ত্বনা পুরস্কার হল, শিবপালের দাবি সত্ত্বেও ভোটের দু’মাস আগে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে তাঁকে সরানো হচ্ছে না।

অখিলেশের হাতে তবে রইল কী! হিসেব কষার জন্য পেনসিল!

অমর সিংহকে দল থেকে তাড়ানোর দাবি তুলে তিনি ও তাঁর সমর্থকেরা কাল জোর হইচই জুড়েছিলেন দলের বৈঠকে। মুলায়ম কালই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, অমরের কাছে তিনি কৃত়জ্ঞ। অমর না থাকলে তাঁকে জেলে যেতে হতো। আজ মুলায়মের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘অমরকে সব কিছুর মধ্যে টানা হচ্ছে কেন?’’ অমরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলেও যুক্তি দিয়েছেন মুলায়ম। ইঙ্গিতটা মুলায়মের খুড়তুতো ভাই রামগোপাল যাদবের দিকে। অখিলেশ-শিবিরে নাম লেখানোয় যাঁকে দল থেকে বরখাস্ত করেছেন শিবপাল। রামগোপাল আজ কটাক্ষ করেছেন, ‘‘আসলি সিক্কে ছেড়ে খোটে সিক্কে তুলে নিচ্ছেন মুলায়ম। কিন্তু অখিলেশ ছাড়া দল চলবে না।’’ খুড়তুতো ভাইয়ের কথা উড়িয়ে দিয়ে মুলায়ম পাল্টা বলেছেন, ‘‘রামগোপালের কথার এখন আর কোনও গুরুত্ব নেই।’’

যদিও ভাই ও ছেলের মধ্যে রফাসূত্র বা ঐক্যের কোনও ইঙ্গিত দিতে পারেননি প্রবীণ লোহিয়াপন্থী। উল্টে দলের অন্দরের ঘুণধরা ছবিটাই ফের প্রকাশ্যে চলে এসেছে। লখনউয়ে বিক্রমাদিত্য মার্গে সমাজবাদী পার্টির সদর দফতরে সাংবাদিক বৈঠক করে মুলায়ম দলীয় ও পারিবারিক ঐক্যের কথা ঘোষণা করার পরে দফতরের বাইরে, ‘নেতাজি’র সামনেই অখিলেশ ও শিবপাল যাদবের অনুগামীদের খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। অখিলেশের অনুগামীরা দাবি তোলেন, শিবপালকে প্রদেশ সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে অখিলেশকে সেই দায়িত্ব দিতে হবে। অখিলেশের নেতৃত্বেই ভোটে যেতে হবে সমাজবাদী পার্টিকে। এঁদের অবরোধে আটকে থাকে মুলায়মের কনভয়। অবরোধ সরাতে পুলিশকে লাঠিও চালাতে হয়। শিবপালের নামে অখিলেশ-ভক্তরা মুর্দাবাদ আওয়াজও তোলেন। শিবপালের অনুগামীদের পাল্টা স্লোগান, ‘ইউপি কি মজবুরি হ্যায়, শিবপাল চাচা জরুরি হ্যায়।’

সোমবার লখনউয়ে দলীয় সভায় মুলায়ম, অখিলেশ, শিবপালের বাদানুবাদই বুঝিয়ে দিয়েছিল, সমাজবাদী পার্টি আসলে ‘সমাজবিবাদী পার্টি’ হয়ে উঠেছে। এতে যে মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি আর বিজেপিরই লাভ, তা বুঝতে দেরি হয়নি প্রবীণ মুলায়মের। সকালেই তাঁর পাঁচ নম্বর বিক্রমাদিত্য মার্গের বাড়ি থেকে টেলিফোন যায় অদূরেই পাঁচ নম্বর কালিদাস মার্গে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে। অখিলেশ তখন নিজের অনুগামী নেতা, বিধায়ক, বিধান পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে দরবার করছেন। যাচাই করে নিচ্ছেন, তাঁর সঙ্গে শক্তি কতটা। অনুগামীদের, বিশেষ করে যুব-নেতাদেরও মনোবল জোগাচ্ছেন। সমাজবাদী পার্টির দফতরে সকাল ন’টার মধ্যে হাজির হয়ে যান প্রদেশ সভাপতি শিবপাল। হাসতে হাসতে বলেন, ‘‘সব কুছ ঠিক হ্যায়। নেতাজি-কা আদেশ মাননা হ্যায়।’’ বেলা ১১টা। মুলায়ম বৈঠকে বসেন অখিলেশ-শিবপালকে। চাচা-ভাতিজার সমঝোতা করাতে ছেলেকে নির্দেশ দেন, তুমি সরকার চালাও। শিবপাল দল চালাবেন। শিবপাল ও তাঁর যে তিন অনুগামীকে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত করেছিলেন তাঁদের ফেরানোরও নির্দেশ দেন তিনি। অখিলেশ বলেন, তিনি রাজি। তবে তার আগে রামগোপালকে দলে ফেরাতে হবে। শিবপাল বলেন, সেটা তাঁর হাতে নেই। তা ছাড়া রামগোপাল বিজেপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। অখিলেশ পাল্টা অভিযোগ তোলেন, শিবপাল নিজেই বিজেপির সভাপতি অমিত শাহর সঙ্গে তিন বার বৈঠক করেছেন। অখিলেশের আর একটি অর্থবহ দাবি, ভোটে প্রার্থী বাছাইয়ের অধিকার তাঁকে দিতে হবে। সেখানে অমরকে রাখলে চলবে না।

রফা সূত্র অধরা রেখেই পৌনে এক ঘণ্টা পরে বেরিয়ে যান অখিলেশ। আরও সওয়া ঘণ্টা শিবপালের সঙ্গে কথা বলে মুলায়ম সাংবাদিক বৈঠক করেন। পাশে শিবপাল ও মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত হওয়া বাকি নেতারা থাকলেও তাঁদের সরকারে ফেরানোর নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ মুলায়ম বলেন, ‘‘এটা মুখ্যমন্ত্রীর উপরে ছেড়ে দিচ্ছি।’’

তা হলে কীসের ঐক্য? রফাসূত্রই বা কোথায়? দলের নেতারা আশায় ছিলেন, অখিলেশের গত পাঁচ বছরের কাজকর্মের খতিয়ান ও মুখ্যমন্ত্রীর স্বচ্ছ ভাবমূর্তিকে সামনে রেখেই ভোটে নামা হবে। কিন্তু কোথায় কী? মুলায়ম তো পাঁচ বছর আগে ক্ষমতায় জিতে আসার কৃতিত্বই ছেলেকে দিতে রাজি নন। তাঁর যুক্তি, ভোট চাওয়া হয়েছিল তাঁর নামে। দলের এক নেতা বলেন, অখিলেশকে এখন, হয় শিবপালের হাতের পুতুল হয়ে থাকতে হবে, নয়তো বিদ্রোহ করতে হবে।

সূত্রের খবর, বাবার রকমসকম দেখে রাতেই ঘনিষ্ঠ বিধায়কদের নিয়ে রণকৌশল ঠিক করতে বসেছেন অখিলেশ। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, এ বার তিনি আপন মতে, আপন পথে চলবেন। এ দিনও মুখে বলেছেন, নেতাজি তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করেছেন। তিনি বললে চলে যাবেন। আপাতত বাবার হয়েই ঘোড়ার মতো ছুটবেন ভোটের লক্ষ্যে। অখিলেশের কথায়, ‘‘জানেন তো ঘোড়া যখন ছোটে, আশপাশে কিছু দেখে না! আমিও যেটা পাল্টাতে পারব না, তা নিয়ে ভাবছি না। আমার নজরে শুধু আসন্ন নির্বাচনে। আমি শুধু মানুষকে বলব সরকার কী কী কাজ করেছে।

এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু অমর প্রসঙ্গ উঠতেই শক্ত চোয়ালে জবাব অখিলেশের, ‘‘বাবার বিশ্বাসের অপব্যবহার করছেন উনি। আমি শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব।’’ দিনের শেষে দলের যুযুধান দুই শিবির তাই একটি বিষয়ে একমত, পিকচার আভি বাকি হ্যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE