Advertisement
২০ মে ২০২৪

পাক-পথে প্রশ্নের মুখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী

ব্যবধানটা মাত্র আট দিনের। গত শুক্রবারই উপমহাদেশের মানুষকে অবাক করে দিয়ে আচমকা লাহৌরের মাটি ছুঁয়েছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিমান।

বিমানঘাঁটি জঙ্গিমুক্ত করতে শনিবার পাঠানকোটে সেনা অভিযান। এএফপি-র তোলা ছবি।

বিমানঘাঁটি জঙ্গিমুক্ত করতে শনিবার পাঠানকোটে সেনা অভিযান। এএফপি-র তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:২৯
Share: Save:

ব্যবধানটা মাত্র আট দিনের। গত শুক্রবারই উপমহাদেশের মানুষকে অবাক করে দিয়ে আচমকা লাহৌরের মাটি ছুঁয়েছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিমান। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের জন্মদিন ও তাঁর নাতনির বিয়ে— রাশিয়া ও আফগানিস্তান সফর সেরে দেশে ফেরার পথে এই জোড়া উৎসবে যোগ দিয়ে এক নজিরবিহীন দৌত্যের পথে হেঁটেছিলেন মোদী। তার আট দিনের মাথায়, নতুন বছরের দ্বিতীয় সকালে গোটা দেশের ঘুম ভাঙল পাঠানকোট বিমানঘাঁটিতে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলার খবরে!

শনিবার ভোর রাতে পাঠানকোটে যে ভাবে জঙ্গি-হামলা হল, তা নতুন করে প্রশ্ন তুলে দিল মোদীর পাক নীতি নিয়ে। বিরোধী কংগ্রেসের প্রশ্ন, প্রধানমন্ত্রী কি এ বার পাকিস্তানের কাছে এই হামলা নিয়ে সরব হবেন? পাক মদতে সন্ত্রাসবাদী হামলা ঠেকাতেই বা মোদী সরকার কী করতে চায়?

দেড় দশক আগে এক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর লাহৌর বাসযাত্রার পরিণতি ছিল কার্গিল যুদ্ধ। এ বার আর এক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর লাহৌর-সৌজন্যযাত্রার পরিণতি পাঠানকোটের জঙ্গি হামলা! তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে দু’বারই কেন্দ্রে এনডিএ সরকার! আজকের হামলার পরে মোদী বলেছেন, ‘‘মানবতার যে শত্রুরা ভারতের উন্নতি দেখতে চায় না, তারাই পাঠানকোটে হামলা চালিয়েছে। কিন্তু আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী তাদের সফল হতে দেয়নি।’’

তাঁর সরকারের পাক নীতি নিয়ে নানা মহলের সমালোচনার মধ্যেই গত কয়েক মাসে একটু একটু করে এগোচ্ছিলেন মোদী। গত নভেম্বরে প্যারিস এবং আট দিন আগে লাহৌরে তিনি নিজে কথা বলেন শরিফের সঙ্গে। আর মাঝে ব্যাঙ্ককে দু’দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) পর্যায়ের বৈঠক ইঙ্গিত দিচ্ছিল কিছুটা হলেও আস্তে আস্তে বরফ গলছে ভারত-পাক সম্পর্কে। যদিও নয়াদিল্লির এ আশঙ্কাও ছিল যে, এটা ভেস্তে দেওয়ার চেষ্টা হবেই। কিন্তু সেটা যে এত তাড়াতাড়ি, তা ভাবেননি অনেকেই। বস্তুত সেটাই যেন টুইটারে লিখেছেন জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা, ‘‘এত তাড়াতাড়ি! পাকিস্তান নিয়ে মোদীর চালের পরে প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ!’’

স্বাভাবিক ভাবেই আজকের হামলায় ফের দু’দেশের সম্পর্কে নতুন করে বরফ পড়া শুরু! ১৫ জানুয়ারি ইসলামাবাদে দু’দেশের বিদেশসচিবদের বৈঠক হওয়ার কথা। তার পরেই দাভোসে ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’-এর ফাঁকে ফের বৈঠকের সম্ভাবনা মোদী-শরিফের। সে সব কতটা কী হবে, সন্দেহ থাকছেই। প্রশ্ন উঠেছে, পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই, পাক সেনা না পাক প্রশাসন— কারা সক্রিয় শান্তি আলোচনা ভেস্তে দিতে? কাদের নির্দেশে এই হামলা? তা হলে কি পাক সেনা এখনও আলোচনা চায় না ভারতের সঙ্গে?

বিস্তারিত পড়তে ক্লিক করুন...

সরকারি ভাবে আজ পাক বিদেশ মন্ত্রক পাঠানকোট হামলার নিন্দা করেছে। যদিও দিল্লির কাছে এটা স্পষ্ট যে, পাক সেনা-আইএসআই-এর প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছাড়া এমন হামলা অসম্ভব। পাক সেনার একটি অংশ যে আইএসআই ও জঙ্গিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভারত-বিরোধী সন্ত্রাসে সক্রিয়, এ অভিযোগ প্যারিসের বৈঠকেও শরিফকে করেছিলেন মোদী। পাক সেনার শীর্ষ নেতৃত্বের সিলমোহর ছাড়া যে শান্তি আলোচনা সফল হবে না, তা মাথায় রেখেই নয়াদিল্লি চাইছিল, শরিফ এগোন। তবে পাক সেনার সম্মতি নিয়ে।

এই ভাবনা থেকেই ব্যাঙ্ককে এনএসএ-পর্যায়ের বৈঠক সফল হওয়ায় কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিল দিল্লি। কারণ বর্তমান পাক এনএসএ নাসির জনজুয়া সেনার অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল। তিনি বর্তমান সেনাপ্রধান রাহিল শরিফের ঘনিষ্ঠ। রাহিলের ইচ্ছাতেই সরতাজ আজিজকে সরিয়ে এনএসএ হয়েছেন জনজুয়া। তাই এ বারের আলোচনায় পাক সেনার সম্মতি রয়েছে বলেই মনে করছিল দিল্লি। বিশেষ করে যখন সীমান্তে অনুপ্রবেশ ও গোলাগুলির ঘটনা গত দু’মাসে কিছুটা কমেছে।

কিন্তু আজকের ঘটনা অনেক হিসেবই উল্টে দিয়েছে। সাউথ ব্লকের এক কর্তার কথায়, ‘‘মোদী যে দিন লাহৌরে যান, সে দিন সেখানে জনজুয়া ছিলেন না। কেন, তা জানা যায়নি। আজকের পরে মনে হচ্ছে, পরিকল্পিত ভাবেই জনজুয়া সে দিন অনুপস্থিত ছিলেন।’’ যদিও আরেকটি অংশের মতে, জইশ বা লস্করের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলির উপরে পাক সেনার রাশ এখন অনেক আলগা। ওই সংগঠনগুলির নিচুতলার নেতারা কী করতে চলেছে, সে বিষয়ে অনেক সময়েই পাক সেনা কর্তাদের কাছে খবর থাকে না!

হামলার কারণ যা-ই হোক, ঘরোয়া রাজনীতিতে তিরের মুখে মোদী। কংগ্রেসের মুখপাত্র রণদীপ সূর্যেওয়ালার প্রশ্ন, ‘‘লাহৌর ঘুরে আসার পর প্রধানমন্ত্রী এ বার কীভাবে পাকিস্তানের সামনে সন্ত্রাসের বিষয়টি তুলবেন?’’ শরিক শিবসেনার প্রশ্ন, পাকিস্তান সন্ত্রাসে মদত দেওয়া বন্ধ না করলে ভারত আলোচনায় বসবে না, মোদী সরকার কেন এই অবস্থান থেকে সরে এল?

এমন নয় শিবসেনার তোলা প্রশ্নটা আজ প্রথম উঠল। মোদীর লাহৌর যাত্রার পরেই কূটনীতিকদের একাংশ প্রশ্ন তুলেছিলেন, এর পরে কি পাকিস্তান সন্ত্রাসে মদত দেওয়া বন্ধ করবে? এ দিনের পরে পোড় খাওয়া কূটনীতিকেরা মনে করছেন, মোদীর পাক-নীতিতে ধারাবাহিকতার অভাব স্পষ্ট। ভারত ঠিক করেছিল, পাকিস্তান সন্ত্রাস দমনে বাড়তি উদ্যোগ না নেওয়া পর্যন্ত ইসলামাবাদের ক্ষেত্রে চিনের মডেল অনুসরণ করা হবে। যেখানে বাড়তি আবেগের জায়গা নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যের মতো বিষয়গুলি নিয়েই কথা হবে শুধু।

সাম্প্রতিক সময়ে সেই নীতি মেনেই এগোচ্ছিল ভারত। কিন্তু প্যারিসে মোদী-শরিফ বৈঠকের এক সপ্তাহের মধ্যেই ব্যাঙ্কক-বৈঠক বদলে দেয় দ্বিপাক্ষিক আবহ। ভারত বিরোধী অংশ বা সংবাদমাধ্যমের অযথা হইচই এড়াতে বাছা হয়েছিল নিরপেক্ষ দেশ। তার পর একটি সম্মেলনে যোগ দিতে পাকিস্তান যান বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। সেটা নিয়েও মাতামাতি চাননি মোদী। কারণ এতে একদিকে ভারত-বিরোধী শক্তিগুলি যেমন নতুন করে সক্রিয় হবে, তেমনই ঘরোয়া রাজনীতিতেও চাপ বাড়বে। পাকিস্তান নিয়ে আবেগবর্জিত এই কূটনীতিতে জল ঢেলে দেয় মোদীর আচমকা লাহৌর যাত্রা! তার পরেই আজকের ঘটনা বৃত্ত সম্পূর্ণ করে দু’দেশের সম্পর্ককে ফের আগের জায়গায় ফিরিয়ে দিল কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE