Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

বামেদের তুলোধোনা, মমতায় ছাড় মোদীর

পশ্চিমবঙ্গে যখন অমিত শাহের নেতৃত্বে বিজেপি নেতারা তৃণমূলের বিরুদ্ধে আক্রমণের সুর চড়াচ্ছেন, ঠিক সেই সময় সংসদে তৃণমূলকে বাদ দিয়ে সিপিএমকে আক্রমণ করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য তৃণমূলকে নয়, প্রধানমন্ত্রী আজ প্রথম বার সরাসরি দায়ী করেন মার্ক্সবাদী কমিউনিস্টদের তিন দশকের শাসনকে। একের পর এক পরিসংখ্যান তুলে ধরে বোঝাতে চেয়েছেন, শিল্প হোক বা কৃষি, সব মাপকাঠিতেই পশ্চিমবঙ্গ কী ভাবে ক্রমেই পিছিয়ে পড়েছে বাম আমলে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৫ ০৩:৪৫
Share: Save:

পশ্চিমবঙ্গে যখন অমিত শাহের নেতৃত্বে বিজেপি নেতারা তৃণমূলের বিরুদ্ধে আক্রমণের সুর চড়াচ্ছেন, ঠিক সেই সময় সংসদে তৃণমূলকে বাদ দিয়ে সিপিএমকে আক্রমণ করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য তৃণমূলকে নয়, প্রধানমন্ত্রী আজ প্রথম বার সরাসরি দায়ী করেন মার্ক্সবাদী কমিউনিস্টদের তিন দশকের শাসনকে। একের পর এক পরিসংখ্যান তুলে ধরে বোঝাতে চেয়েছেন, শিল্প হোক বা কৃষি, সব মাপকাঠিতেই পশ্চিমবঙ্গ কী ভাবে ক্রমেই পিছিয়ে পড়েছে বাম আমলে। শিল্প, কৃষিতে পিছিয়ে পড়ার পাশাপাশি অনাহারে পশ্চিমবঙ্গ কতটা এগিয়ে রয়েছে, তা-ও উল্লেখ করেন মোদী। এবং এ সবের জন্য সিপিএমের ‘বিদেশ থেকে আমদানি করা’ আদর্শকেই দায়ী করেন মোদী।

সিপিএমকে তুলোধোনা করার পাশাপাশি তাঁর সরকার যে অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গকে অনেক বেশি অর্থসাহায্য করছে, তা-ও সংসদে তুলে ধরেন মোদী। চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী রাজ্যের হাতে আরও বেশি অর্থ তুলে দেওয়ার উদাহরণ দিয়ে মোদী বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ আগের থেকে ২২ হাজার কোটি টাকা বেশি পাবে। যেখানে অন্ধ্রপ্রদেশ বাড়তি পাবে ১৫ হাজার কোটি টাকা ও ওড়িশা ৮ হাজার কোটি টাকা।” তৃণমূলের ডেরেক ও’ব্রায়েন ও সুখেন্দুশেখর রায় রাজ্যের ঋণ সঙ্কটের কথা বলায় মোদী সহানুভূতির সঙ্গে বলেন, “আমি জানি এই সমস্যা আপনারা উত্তরাধিকার সূত্রে (বিরাসত-এ) পেয়েছেন।”

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, রাজ্যসভায় রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা নিয়ে বিতর্কের জবাব দিতে গিয়ে হঠাৎ করে কেন পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গে চলে গেলেন মোদী? আগামী ৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার ঠিক আগে মোদীর এই বক্তব্যের পিছনে সুপরিকল্পিত কৌশল রয়েছে বলে মনে করছেন রাজনীতির লোকজন। রাজ্যসভায় মোদী সরকারের গরিষ্ঠতা নেই। বিভিন্ন বিষয়ে তৃণমূল ও সিপিএম এককাট্টা হয়ে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণে যাচ্ছে। বিরোধীদের এককাট্টা করছে। এর জেরেই রাজ্যসভায় বিল পাশ করাতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে মোদী সরকার। মোদী তাই আজ সুকৌশলে তৃণমূল ও সিপিএমের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন তৈরির চেষ্টা করেছেন। সিপিএমকে আক্রমণ করে তৃণমূলকে আগামী দিনে পাশে পাওয়ার জমি তৈরির চেষ্টা চালিয়েছেন তিনি। বোঝাতে চেয়েছেন, উন্নয়নের প্রশ্নে তাঁর সরকার পশ্চিমবঙ্গকে সাহায্য করছে।

পশ্চিমবঙ্গে যখন সিদ্ধার্থনাথ সিংহ, রাহুল সিংহরা তৃণমূলকে আক্রমণ করছেন, তখন সংসদে তাদের সম্পর্কে মোদীর নরম সুর নেওয়ার মধ্যে অবশ্য কোনও বিরোধ দেখছেন না বিজেপি নেতারা। তাঁদের যুক্তি, প্রধানমন্ত্রী সব সময়ই বলেছেন, উন্নয়নের প্রশ্নে দল বা রাজনীতি দেখা হবে না। আজ সংসদেও প্রধানমন্ত্রী তাই পশ্চিমবঙ্গের মতো পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির পিছিয়ে পড়ার কথা বলেছেন। উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাঁদের দরাজ হাতে সাহায্যের কথা বলেছেন।

মোদীর এই কৌশল কতটা কার্যকরী হবে, তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন উঠে গিয়েছে এ দিনই। কারণ, মোদীর ওই বক্তৃতার পরেই সিপিএম ও তৃণমূল একসঙ্গে ভোটাভুটি করে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতায় সংশোধনী পাশ করিয়ে সরকারকে প্রবল অস্বস্তিতে ফেলেছে। রাজনীতিকরা মনে করছেন, রাষ্ট্রপতির বক্তৃতায় সিপিএমের সংশোধনীতে যে তৃণমূল সমর্থন করতে পারে, মোদী তা আঁচ করেছিলেন। সিপিএমকে আক্রমণ করার জন্য তাই প্রস্তুত হয়েই এসেছিলেন রাজ্যসভায়। সিপিএমের থেকে তৃণমূলকে আলাদা করার চেষ্টাও করেন যথাসম্ভব। তাতে অবশ্য লাভ হয়নি।

রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা নিয়ে বিতর্কে মোদী যে আজ হঠাৎ পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরবেন, সেটা তৃণমূল বা সিপিএমের নেতারা কেউই আঁচ করতে পারেননি। রাজ্যসভার তৃণমূলের নতুন দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন এবং সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি দু’জনেই তখন প্রথম সারিতে বসে। মোদী হঠাৎ করেই বলেন, “যাঁরা বিদেশ থেকে আমদানি করা ভাবনা নিয়ে এই দেশ চালানোর কথা ভাবেন, তাঁরা পশ্চিমবঙ্গে ৩০ বছর রাজত্ব করার সুযোগ পেয়েছিলেন। আজ সেখানে যা পরিস্থিতি, ডেরেক, তার জন্য আমি আপনাদের দোষ দিই না।” রাজ্যসভায় ডেরেকের সরকারের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধং দেহি’ মনোভাব নিয়ে খোঁচাও দেন মোদী। হেসে বলেন, “আপনি যা করার করুন। নিজের সিআর (কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্ট, দলনেত্রীর কাছে কাজের মূল্যায়ন) ঠিক রাখা উচিত।”

মোদী পরিসংখ্যান দিয়ে বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ এক সময় শিল্পায়নের রাজধানী হিসেবে পরিচিত ছিল। যে কলকাতাকে সবাই শিল্পের রাজধানী হিসেবে চিনত, তা আজ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। যে সব রাজ্যে কৃষি উৎপাদনের গতি সব থেকে বেশি ছিল, পশ্চিমবঙ্গ ছিল তার অন্যতম। ৩০ বছরে তা নেতিবাচক হয়ে গিয়েছে। ১৯৮০ সালে দেশের ১০ শতাংশ শিল্প উৎপাদন হতো পশ্চিমবঙ্গে। এখন তা ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬ সালের মধ্যে কৃষি উৎপাদনের বৃদ্ধির হার ছিল ১৭.৩ শতাংশ। ২০০১ থেকে ২০০৭-এর মধ্যে তা ৭.৮ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০০৭ সালে এনএসএসও-র সমীক্ষা অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে অনাহার পরিস্থিতি ছিল সব থেকে প্রকট। রাজ্যের মাত্র ৬০% বালিকা বিদ্যালয়ে চালু শৌচালয় ছিল। জাতীয় গড় ছিল ৭৫%।” সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি, তপন সেনরা উঠে প্রতিবাদ করলেও মোদীকে থামাতে পারেননি।

পিছিয়ে পড়া পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের কথা ভেবেই রাজ্যের হাতে আরও বেশি অর্থ তুলে দেওয়া হচ্ছে বলেও যুক্তি দেন মোদী। তিনি বলেন, খনিজের রয়্যালটি দেড় গুণ বেড়েছে। কয়লা খনির নিলাম থেকে অর্থ উঠছে, তার পুরোটাই রাজ্য পাবে। পশ্চিমবঙ্গ এর থেকেও লাভবান হবে। সর্বোপরি চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ মেনে রাজ্যকে আগের তুলনায় ২২ হাজার কোটি টাকা বেশি অর্থ দেওয়া হবে।

ডেরেক উঠে এর প্রতিবাদ জানান, বাড়তি অর্থের সঙ্গে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের দায়ও রাজ্যের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। সুখেন্দু বলেন, মূল সমস্যা যে ঋণের বোঝা, তার কোনও সমাধান হচ্ছে না। মোদী জানান, তিনি সমস্যা সম্পর্কে অবগত। এই অবস্থায় মমতা-মোদী মুখোমুখি বসলে কি, তার কোনও সমাধান বেরিয়ে আসবে? আপাতত অপেক্ষা ৯ তারিখের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE