Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কৌটিল্যকে ভুলে মোরারজির পথে নীতীশ

চণ্ডীতে রয়েছে, মহিষাসুর বধের আগে নাকি সুরা (মধু) পান করেছিলেন মা দুর্গা! সরকারি পাঠ্যপুস্তকে দুর্গার সুরাপানের সেই কাহিনির উল্লেখ নিয়ে লোকসভায় তুমুল বিতর্ক।

শঙ্খদীপ দাস
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:২৫
Share: Save:

চণ্ডীতে রয়েছে, মহিষাসুর বধের আগে নাকি সুরা (মধু) পান করেছিলেন মা দুর্গা! সরকারি পাঠ্যপুস্তকে দুর্গার সুরাপানের সেই কাহিনির উল্লেখ নিয়ে লোকসভায় তুমুল বিতর্ক। তা থামাতে চণ্ডী থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন সভার তৎকালীন নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায়— ‘গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ়, মধু যাবৎ পিবাম্যহম!’ বিষয়টি ব্যাখ্যাও করেন তিনি। আবার সুরা থেকে রাজস্ব আদায়ের কী কী সূত্র হবে, তা তাঁর অর্থশাস্ত্রে সবিস্তার ব্যাখ্যা করেছিলেন স্বয়ং কৌটিল্য! উৎসব-পার্বণে মদ বিক্রি থেকে কী ভাবে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করা যায়, তারও উপায় বাতলে দিয়েছিলেন বিষ্ণু গুপ্ত!

কিন্তু পুরাণ ও শাস্ত্র-দর্শিত পথ ছেড়ে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার যে উলটপুরাণ শুরু করেছেন, সেটাই এখন জাতীয় স্তরে আলোচনার মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার পর এক সপ্তাহ কেটেছে, তার মধ্যেই নীতীশ ঘোষণা করেছেন, বিহারে মদ বিক্রি ও পান করা নিষিদ্ধ হবে। ১ এপ্রিল থেকে সেই নীতি কার্যকর করবে তাঁর সরকার।

নীতীশের এই ‘নীতি পুলিশি’ ঘিরে সংসদের অলিন্দ আজও ছিল তর্ক-বিতর্কে আন্দোলিত! কেউ কেউ আবার হেঁয়ালি করে নীতীশকে বলছেন কালিদাস! যে ডালে বসেছেন, সেই ডালই কাটছেন। চণ্ডী ও কৌটিল্যের প্রসঙ্গ ফিরে ফিরে আসছে সেই সূত্রেই।

বাজপেয়ী জমানায় ‘বিমারু’ বন্ধনীতে রাখা রাজ্যগুলির মধ্যে সর্বাগ্রে ছিল বিহার! একদা বর্ধিষ্ণু পাটলিপুত্র কালচক্রে আজও পিছিয়ে। বিহারে মদ বিক্রি নিষিদ্ধ হলে ‘বিমারুর’ পথ্য জোগানে রাজ্যের যে নাভিশ্বাস উঠবে, তা বুঝতে অর্থশাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। হিসেব মতো এ জন্য বিহারের বার্ষিক রাজস্ব ক্ষতি হতে পারে চার হাজার কোটি টাকা। রাজ্যের রাজস্ব সংগ্রহে ১০ শতাংশেরও বেশি ঘাটতি হবে।


সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন...

ক্ষতি শুধু বিহারের নয়, নীতীশের ঘোষণার ধাক্কায় গত কাল শেয়ার বাজারে মদ উৎপাদক সংস্থাগুলির শেয়ারের দাম পড়েছে ঝপ করে। এই আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি সর্বস্তরে আশঙ্কা, এর পর বিহারে মদের কালোবাজারি যেমন বাড়বে, তেমনই বিষাক্ত চোলাইয়ের চোরাগোপ্তা উৎপাদন ও বিক্রিও বেড়ে যেতে পারে। বিষ মদে গরিব মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কাও বেড়ে গেল।

তবু নীতীশ রইলেন নীতীশেই। অতীতে রেলমন্ত্রী হিসেবে ভাড়া না বাড়াতে ধনুকভাঙা পণ করেছিলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠার চেষ্টায় আজও ততটাই তত্পর। ‘মামুলি রাজস্ব ক্ষতি’-র আশঙ্কা থাকলেও তাঁর মতে, ‘‘মদের জন্য সব থেকে ক্ষতি হয় গরিব মানুষের। খরচ হয়ে যায় দিন মজুরের টাকা। আবার মহিলাদের উপর অত্যাচারের পিছনেও রয়েছে এই মদ।’’

রাজনীতির বিশেষজ্ঞদের মতে, মহাত্মা গাঁধীর নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারাতেই মদ ও মদ্যপান বিরোধিতার বীজ রোপিত। স্বাধীনতার পর ক্ষমতাসীন দলগুলির নেতৃত্বও মদকে কখনও রাজস্ব-বৃদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে দেখেননি। স্বাধীনতার পরে তত্কালীন বম্বে প্রদেশের (গুজরাত-মহারাষ্ট্র) মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মোরারজি দেশাই প্রথম আইন প্রণয়ন করে মদ্যপান ও তার বিক্রির উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিন্তু পান ও বিক্রি তিনি ঠেকাতে পারেননি। বরং বিষ মদে মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে গিয়েছিল। পরে বম্বে প্রদেশ ভেঙে গুজরাত ও মহারাষ্ট্রের জন্ম। গাঁধীর জন্ম-রাজ্য গুজরাতে নিষেধাজ্ঞা জারি থাকলেও মহারাষ্ট্র আর্থিক দিকটিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। তবে সেই সময়ে অন্য বেশ কিছু রাজ্যও গুজরাতের পথে হাঁটতে চেয়েছিল।

কোনও কোনও রাজ্য নিষেধাজ্ঞা জারি করেও শেষ পর্যন্ত রাজস্বের কারণে সরে এসেছিল। কেননা, এ বাবদ রাজস্ব ঘাটতি পূরণের যে প্রতিশ্রুতি কেন্দ্রীয় সরকার প্রাথমিক ভাবে দিয়েছিল, তা পূরণ করা হয়নি।

মোরারজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর কিন্তু কেন্দ্রীয় ভাবে মদ নিষিদ্ধ করার কোনও সিদ্ধান্ত নেননি। বরং রাজ্যগুলির হাতে বিষয়টি ছেড়ে দিয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হন মোরারজি-ঘনিষ্ঠ কর্পূরী ঠাকুর। সরকারে এসেই মদ নিষিদ্ধ করেন তিনি। সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পৃথক একটি দফতরও তৈরি করেছিলেন। আবগারি বিভাগের সঙ্গে আজও জুড়ে রয়েছে সেই দফতর। কিন্তু অবৈধ মদের রমরমা ভয়ঙ্কর আকার নেওয়ায় দেড় বছরের মধ্যেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন কর্পূরী ঠাকুর।

খোদ গাঁধীর রাজ্যের খবর কী? গত পাঁচ দশকে সেখানে মদ উৎপাদন ও বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বম্বে নিষেধাজ্ঞা (গুজরাত সংশোধন) বিল ২০০৯ অনুযায়ী, গুজরাত একমাত্র রাজ্য যেখানে বেআইনি মদ উৎপাদন ও বিক্রির দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধানও রয়েছে। কিন্তু বাস্তব ছবিটা কী? আমদাবাদে নেমে অটোচালককে কানে কানে বললেই কালোবাজার থেকে মদ এনে দেয়। আর পকেটে ভিন রাজ্যের পরিচয়পত্র থাকলে, সে ড্রাইভিং লাইসেন্সও হতে পারে, মিলে যাবে আবগারি-পারমিট। আর সে রাজ্যের মানুষ? সপ্তাহান্তে যানজট পাকিয়ে যায় গুজরাত থেকে দমন কিংবা মাউন্ট আবু যাওয়ার পথে। অর্থাৎ যাঁদের মদ্য পানের শখ, তাঁরা তা কালোবাজার কিংবা প্রতিবেশী রাজ্যে গিয়ে কিনে খাচ্ছেন। খামোখা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকারি কোষাগার। কিন্তু রাজ্যটা যে হেতু গুজরাত, নাম জড়িয়ে রয়েছে গাঁধীর সঙ্গে, সে কারণে ইচ্ছে থাকলেও কোনও প্রশাসক নিষেধাজ্ঞা তোলার কথা ভাবেন না। ভোট ব্যাঙ্কের কথা মাথায় রাখেন তাঁরা।

আসল কথা এই ভোট ব্যাঙ্ক। কারণ এই নীতীশ কুমারই ২০০৬ সালে বিহারে বিজেপিকে সঙ্গী করে ক্ষমতায় এসে চালু করেন নতুন আবগারি নীতি। তাতে রাজস্ব আদায়ও বেড়েছিল। রাজ্যের আবগারি দফতরের হিসেব মতো, গত দশ বছরে বিহারে মদ থেকে রাজস্ব বৃদ্ধির পরিমাণ বারো গুণেরও বেশি। ২০১৫-১৬ সালের বাজেটেই আবগারি খাতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪০০০ কোটি টাকা। তবে মদ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর এই উল্টো পথে হাঁটার পিছনে যে ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি, সে কথা মানছেন জেডিইউ নেতারাও।

জাতের অঙ্কে নীতীশের ভোট ব্যাঙ্ক খুবই ছোট। মহিলাদের নিয়ে একটি পৃথক ভোট ব্যাঙ্ক গঠনের আশাতেই ভোট ইস্তাহারে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ক্ষমতায় এলে মদ বিক্রি ও পানে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন। অনেকেই মনে করছেন, সেই মহিলা ভোটব্যাঙ্ককে অটুট রাখতে নীতীশের এ ছাড়া অন্য পথ ছিল না।

মদ বিক্রিতে উপর নিষেধাজ্ঞা জারির তালিকায় সর্বশেষ কেরল। সেই পথে চলার কথা ভাবতে শুরু করেছে মহারাষ্ট্রও। তবে কেরল কংগ্রেসের এক নেতা তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কথায়, ‘‘কেরলেও কালোবাজারি শুরু হয়ে গিয়েছে। সৈকতাবাসে গিয়ে মদের কথা বলতেই বেয়ারা পসরা সাজিয়ে নিয়ে আসে।’’ হরিয়ানাতেও একাধিক বার মদ বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই তা প্রত্যাহার করতে হয়েছে সরকারকে। অবিভক্ত অন্ধ্রে এনটিআরের শাসনের শেষ দিকে একই ভাবে নিষিদ্ধ হয়েছিল মদ। কিন্তু বিষ মদে মৃত্যুতে জেরবার এই সব রাজ্যে শেষ পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। মদ বন্ধ করা নিয়ে তামিলনাড়ুতেও রাজনৈতিক লড়াই কম হয়নি। অন্তত পাঁচ দফায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়েছে, আবার তুলেও নেওয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এখন তামিলনাড়ুতে দেশি মদ ও তাড়ির দোকানগুলিকে সরকারি রাজস্বের জালে আনা হয়েছে। সরকারি নিগমের মাধ্যমে মদ বিক্রির ব্যবস্থাও করা হয়েছে। গত আর্থিক বছরে এই খাতে তামিলনাড়ু সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকা! আর বাণিজ্য কর বাবদ আয় হয়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকা! মহারাষ্ট্রে মদ বিক্রি থেকে রাজ্যের শুল্ক আদায় হয় প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। অভিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশে এই খাতে আদায়ের পরিমাণ ছিল সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা।

নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তে নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব তো রয়েছেই। কিন্তু এর পাশাপাশি চোলাই মদের উৎপাদন বেড়ে যাওয়া ও বিষ মদের প্রাণহানি নিয়ে আশঙ্কাও বড় বিষয় হয়ে উঠছে। বিহারে মাথাপিছু গড় আয় কম। ফলে খেটে খাওয়া মানুষগুলির বিষাক্ত চোলাই চক্রের ফাঁদে পা দেওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।

প্রশ্ন হল, পোড় খাওয়া রাজনীতিক নীতীশ কুমার কি এই সমস্যাগুলি বুঝছেন না? নাকি জনমোহিনী নীতির জন্য সব জলাঞ্জলি দিয়েছেন তিনি?

বিহারে কংগ্রেসের নেতা প্রাক্তন এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কথায়, নীতীশ বুদ্ধিমান প্রশাসক। মদ নিষিদ্ধ করার কথা ঘোষণা করে বিতর্কটা হয়তো ইচ্ছা করেই শুরু করে দিলেন তিনি। কারণ, ইস্তাহারে মদ বন্ধের প্রতিশ্রুতি নিয়ে টিপ্পনি কাটতে শুরু করেছিল বিজেপি। নেতাটির ব্যাখ্যা, এমনও তো হতে পারে, সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক হলে, তার দোহাই দিয়েই ভবিষ্যতে মদে নিষেধাজ্ঞা ‘লঘু’ করে দেবেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

nitish kumar liqour ban bihar morarji desai
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE