Advertisement
০৪ মে ২০২৪
নগদ নয়, সংশয়ই সম্বল

নোট বদলের সীমা কমে দু’হাজার

যেন তেল মাখা বাঁশে বাঁদরের ওঠা-নামার সেই পুরনো পাটিগণিত। শুরুতে মোট ৪,০০০ টাকার অচল নোট সরাসরি নতুনে বদলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কেন্দ্র। রবিবার সেই ঊর্ধ্বসীমা বাড়িয়ে ৪,৫০০ টাকা করে অর্থ মন্ত্রক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৩৫
Share: Save:

যেন তেল মাখা বাঁশে বাঁদরের ওঠা-নামার সেই পুরনো পাটিগণিত।

শুরুতে মোট ৪,০০০ টাকার অচল নোট সরাসরি নতুনে বদলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কেন্দ্র। রবিবার সেই ঊর্ধ্বসীমা বাড়িয়ে ৪,৫০০ টাকা করে অর্থ মন্ত্রক। এ দিন তারাই সেই সীমা নামিয়ে আনল দু’হাজারে। জানাল, ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক জন মোট ২,০০০ টাকার পুরনো নোট বদলে আনতে পারবেন। আর তার জন্য ওই সময়ের মধ্যে ব্যাঙ্কে যাওয়া যাবে এক বারই।

সেই সঙ্গে বৃহস্পতিবার অর্থ বিষয়ক সচিব শক্তিকান্ত দাসের ঘোষণা, যে সমস্ত পরিবার বিয়ের তোড়জোড় করছেন, প্যান দাখিল করে অ্যাকাউন্ট থেকে আড়াই লক্ষ টাকা পর্যন্ত তুলতে পারবেন তাঁরা। শর্ত হল, বর ও কনেপক্ষ মিলিয়ে এক জনই তা করতে পারবেন। টাকা তোলা যাবে বর, কনে কিংবা তাঁদের বাবা-মায়ের অ্যাকাউন্ট থেকে। তবে সেই অ্যাকাউন্টের জন্য কেওয়াইসি নথি জমা থাকা জরুরি।

নোট বিধান

• পুরনো নোট বদলের ঊর্ধ্বসীমা ৪৫০০ থেকে কমিয়ে ২০০০

• নোট বদলানো যাবে এক বারই

• বিয়ের জন্য বর ও কনে পক্ষ মিলিয়ে তুলতে পারবে মোট আড়াই লাখ

• জমা দিতে হবে বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র ও আবেদনপত্র

• কৃষি বাজারের ব্যবসায়ীরা তুলতে পারবেন সপ্তাহে ৫০ হাজার

• চাষিরা কৃষিঋণের কাগজ বা কিষান ক্রেডিট কার্ড দেখিয়ে তুলতে পারবেন সপ্তাহে ২৫ হাজার

• কেন্দ্রীয় সরকারের গ্রুপ সি এবং ডি কর্মীরা ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন নগদে আগাম নিতে পারবেন

• ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত আড়াই লাখের বেশি নগদ জমায় প্যান বাধ্যতামূলক

• ২৪ তারিখ মাঝ রাত পর্যন্ত জাতীয় সড়কে টোল মকুব

নগদের অভাবে যাতে মাথায় হাত না পড়ে, সে জন্য এ দিন চাষিদের সপ্তাহে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত তুলতে দেওয়ার কথা জানিয়েছে মন্ত্রক। কেন্দ্রীয় সরকারি গ্রুপ-সি কর্মীরাও (সেনাবাহিনী, রেল, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সমেত) নভেম্বরের বেতন থেকে আগাম তুলতে পারবেন ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত।

বিয়েবাড়ি আর চাষিদের কেন্দ্র কিছুটা আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেও, নোট বদলের ঊর্ধ্বসীমা কমায় কপালে ভাঁজ পড়েছে অনেকের। বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন করছেন, বড় নোটের (২০০০ ও নতুন ৫০০ টাকা) জোগান এখনও পর্যাপ্ত নয় বলেই কি এই সিদ্ধান্ত নেওয়া? কারও আবার প্রশ্ন, সেই কমাতেই যদি হল, তাহলে রবিবার ঊর্ধ্বসীমা কেন বাড়িয়েছিল কেন্দ্র? তার মানে কি পরিকল্পনার পাশাপাশি পরিস্থিতির পর্যালোচনায় খামতি থাকছে? সব জায়গায় টাকা পৌঁছে দিতে কত সময় লাগবে, তা আঁচ করতে খাবি খাচ্ছে কেন্দ্রই?

অর্থ মন্ত্রকের দাবি, নগদের জোগানে কোনও ঘাটতি নেই। আরও বেশি মানুষ যাতে নোট বদলের সুবিধা পান, তা নিশ্চিত করতেই ঊর্ধ্বসীমা কমানোর সিদ্ধান্ত। এক জনের এক বারের বেশি নোট বদলানো আটকাতে আঙুলে কালি লাগানো হচ্ছেও সেই কারণে। যদিও এ রাজ্যে অধিকাংশ ব্যাঙ্কের দাবি, বৃহস্পতিবার অন্তত সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত টাকা তাদের হাতে এসে পৌঁছয়নি।

অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির মতে, এ দিন ভিড় কিছুটা পাতলা হয়েছে ব্যাঙ্কের দরজায়। সংবাদমাধ্যমের সামনে এ দিন একই কথা বলেছেন আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের কর্ণধার চন্দা কোচর এবং অ্যাক্সিস ব্যাঙ্কের এমডি-সিইও শিখা শর্মাও। তাঁদের দাবি, লাইন আগের থেকে ছোট হয়েছে। পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হবে আগামী কয়েক দিনে। একই কথা বলছে এইচডিএফসি ব্যাঙ্কও।

কিন্তু দিল্লিতে খাস পার্লামেন্ট স্ট্রিটে কিছু ব্যাঙ্কে এ দিন ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। কলকাতাতেও ব্যাঙ্কের যে সমস্ত শাখায় ভোটের কালি পৌঁছয়নি, তার সামনে লাইন পড়েছে সাপের মতো এঁকেবেঁকে। প্রায় সব এটিএমের পেটেই অধিকাংশ সময় নোট নেই। ব্যাঙ্ক কর্তারা বলছেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পাঠানো টাকা রাখার জায়গা (চেস্ট) কার্যত খালি।

ব্যাঙ্ক কর্মীদের সংগঠন বিইএফআই (বেফি)-এর দাবি, কেন্দ্র ৮ তারিখ নোট তুলে নেওয়ার পরে শালবনির ছাপাখানা থেকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কলকাতা শাখায় নোট এসেছে মাত্র দু’দিন। ৯ ও ১৫ নভেম্বর। মোট ৭,৩২০ কোটি টাকার। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এই অঙ্ক অনেকটাই বেশি। কিন্তু বিপুল সংখ্যক পুরনো নোট বেরিয়ে যাওয়ার পরে বাজারে নতুন যেটুকু ঢুকেছে, চাহিদার তুলনায় তা নস্যি। মনে রাখতে হবে, দেশে যে টাকা চালু ছিল, তার মোট মূল্যের (১৪ লক্ষ কোটি টাকা) ৮৬ শতাংশই ছিল ওই দুই নোটে।

তা ছাড়া, কেন্দ্রের নিত্যনতুন ঘোষণায় যেমন বিভ্রান্তি বাড়ছে, তেমনই অনেকে অভিযোগ তুলছেন নিয়ম সর্বত্র এক না-হওয়ার। কোথাও নোট বদলালে আঙুলে কালি পড়ছে, তো কোথাও তার বালাই নেই। কোনও ব্যাঙ্কের শাখায় গিয়ে হয়তো ১০ হাজার টাকা তোলা যাচ্ছে। অথচ কোথাও মুখের উপর সটান বলে দিচ্ছে যে, এখন দুই বা পাঁচ হাজারের বেশি দেওয়া যাবে না। এমনকী এই সমস্যার কথা উড়িয়ে দিচ্ছেন না অর্থ মন্ত্রকের কর্তারাও। জেটলি বলেছেন, এখনই ১০০০ টাকার নোট আনার পরিকল্পনা নেই। অনেকের আশঙ্কা, এর ফলে দু’হাজারের নোট ভাঙাতে গিয়েও সমস্যা হবে যথেষ্ট।

গোড়া থেকেই সকলে বলছেন, আমজনতার ভোগান্তি কমবে সমস্ত এটিএম ২০০০ ও নতুন ৫০০ টাকার নোটের উপযুক্ত হয়ে উঠলে। জেটলির দাবি, এখন দিনে গড়ে ২২,৫০০টি এটিএম-কে উপযুক্ত করে তোলা হচ্ছে। অর্থাৎ এই হার বজায় থাকলে, দেশের ২ লক্ষ ২০ হাজার এটিএম নতুন নোটের উপযুক্ত করে তুলতে দশ দিনেরও কম সময় লাগার কথা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী সাধারণ মানুষের কাছে ৫০দিন সময় চেয়েছেন ঠিকই। কিন্তু কেন্দ্র বিলক্ষণ জানে যে, পরিস্থিতি এ মাসের মধ্যে প্রায় স্বাভাবিক না হলে বিস্তর সমস্যা হবে অর্থনীতির। তাঁদের যুক্তি, পরের মাস পড়লেই তার শুরুতে মোটা টাকা লাগবে গেরস্থের। স্কুলের ফি, মুদিখানায় মাসকাবারি, পরিচারিকার মাইনে— এই সমস্ত খরচ মেটানো হয় মূলত নগদে। ফলে তখনও এই নোটের টান বজায় থাকলে, বিভিন্ন খাতে টাকা মেটানো শক্ত হবে। আমজনতা (বিশেষত খেটে খাওয়া মানুষ) তাতে অসুবিধাই তো পড়বেই, জোর ধাক্কা খাবে অর্থনীতিও।

চাষ থেকে ছোট শিল্প— অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রকে ইতিমধ্যেই ধাক্কা দিয়েছে নোটের আকাল। এবং তা স্পষ্ট সমস্যার বিভিন্ন টুকরো ছবি থেকেই। খদ্দের না থাকায় এখন দোকানিদের মাথায় হাত।
আবার তাঁরা জিনিসপত্র না কেনায় বিক্রিবাটা কমছে পাইকারি বাজারে। সব মিলিয়ে কমছে চাহিদা। ছোট শিল্পের ঘরেও নগদ টাকা নামমাত্র। ফলে কর্মীদের বেতন দিতে সমস্যায় পড়ছে তারা।

শুধু ছোট শিল্পে নয়, নগদের অভাবে সরঞ্জাম কেনা কিংবা শ্রমিক জোটানো কঠিন হচ্ছে চাষবাসেও। যেমন, হুগলির পুড়শুড়ার কেলেপাড়ায় প্রায় দু’হাজার খেতমজুর কাজ করেন উত্তর চব্বিশ পরগনার গোসাবা, মোল্লাখালি থেকে এসে। সপ্তাহ শেষে বাড়িতে টাকা দিতে যান তাঁদের অনেকে। কিন্তু এখন টাকার অভাবে তাঁদের মজুরি দেওয়াই দায় হয়েছে চাষিদের। এমনই এক চাষি পরেশ ধোলের কথায়, ‘‘আলু বীজ কেনার বা মজুরদের দেওয়ার টাকা পাব কোথা থেকে?’’ কেউ বলছেন, ট্রাক্টরে তেল ভরার পয়সাটুকু নেই। গ্রামের দোকানদাররা আবার অনেকে বলছেন বাকিতে সার, কীটনাশক ইত্যাদি বিক্রি করে এখন তার টাকা ফেরত পেতে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে তাঁদের। অপেক্ষা
করতে হচ্ছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার জন্য। সমবায় ব্যাঙ্কের কাছ থেকে চাষের জন্য ধার পেতেও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ অনেকের।

বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, এখন রবিচাষে বীজ বোনার সময়। তাই চাষিদের হাতে এখন নগদের টান থাকলে, তার ফল টের পাওয়া যাবে জানুয়ারি নাগাদ, ফসল তোলার সময়ে। ফলন ভাল না হলে তখন দাম চড়বে খাদ্যশস্যেরও। অর্থাৎ, নোট বাতিলের পদক্ষেপে জিনিসপত্রের দাম কমবে বলে যে দাবি সরকার করছে, তার উপরেও প্রশ্নচিহ্ন ঝুলছে বলে মনে করছেন তাঁরা।

এও যেন তেলমাখা বাঁশে বাঁদরের ওঠা-নামার আর এক গল্প। যেখানে এখন নামলেও, ফের মাথা তোলার সম্ভাবনা জাগিয়ে রাখছে মূল্যবৃদ্ধি।

টাকা মিলবে পাম্পেও

এ বার টাকা তোলার সুযোগ মিলবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার পেট্রোল পাম্প থেকেও। বৃহস্পতিবার স্টেট ব্যাঙ্কের চেয়ারপার্সন অরুন্ধতী ভট্টাচার্যের সঙ্গে বৈঠকের পরে আইওসি, বিপিসিএল ও এইচপিসিএলের তরফে এ খবর জানানো হয়েছে। যে সব পেট্রোল পাম্পে স্টেট ব্যাঙ্কের পয়েন্ট অব সেলস (পিওএস) মেশিন আছে, সেখানেই ডেবিট কার্ড দিয়ে মাথাপিছু দিনে সর্বোচ্চ দু’হাজার টাকা তোলা যাবে। প্রাথমিক ভাবে আড়াই হাজার পাম্পে এই সুযোগ মিলবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Notes Exchange
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE