Advertisement
০৫ মে ২০২৪
আটকে সংস্কার, বিভ্রান্তি পাক নীতি নিয়েও

এক বছরেই নাজেহাল কেন্দ্র

দিল্লির মসনদ দখল করার পরে এক বছর চার মাস কেটে গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এখন নিজেই বুঝতে পারছেন, সরকারের নানা ক্ষেত্রে নানা ধরনের বিড়ম্বনা সৃষ্টি হয়েছে। ২৮২টি আসন পাওয়ায় প্রথম দিকে সরকারে এক চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। ফলে, আত্মসমালোচনার কোনও পরিসর তৈরি হয়নি। কিন্তু এখন শুধু গোয়েন্দা সূত্র নয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক সূত্র থেকেও নরেন্দ্র মোদী জানতে পারছেন যে একেবারে ল্যাজেগোবরে হচ্ছে সরকার।

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:২৯
Share: Save:

দিল্লির মসনদ দখল করার পরে এক বছর চার মাস কেটে গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এখন নিজেই বুঝতে পারছেন, সরকারের নানা ক্ষেত্রে নানা ধরনের বিড়ম্বনা সৃষ্টি হয়েছে। ২৮২টি আসন পাওয়ায় প্রথম দিকে সরকারে এক চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। ফলে, আত্মসমালোচনার কোনও পরিসর তৈরি হয়নি। কিন্তু এখন শুধু গোয়েন্দা সূত্র নয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক সূত্র থেকেও নরেন্দ্র মোদী জানতে পারছেন যে একেবারে ল্যাজেগোবরে হচ্ছে সরকার।
মনমোহন সরকারের দশ বছরের শাসনের পর নীতিপঙ্গুত্ব হয়েছিল। তার পরে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া মহানায়কের কাছ থেকে শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় যাকে বলা হয়েছিল ‘প্রত্যাশার বিপ্লব’। সাধারণ মানুষের মধ্যে অতিরিক্ত প্রত্যাশা জন্ম নিল। কিন্তু মিলল অতিকেন্দ্রীভূত একটি শাসন। ভারতের মতো বহুত্ববাদী জটিল সমাজব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সহিষ্ণুতার প্রয়োজন রয়েছে। এই সরকারের মধ্যে তার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।
বিজেপি ক্ষমতায় এসেই জমি আইন সংশোধন করার যে চেষ্টা শুরু করে, তার বিরুদ্ধে সওয়াল করেছিলেন কয়েক জন আমলা। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা প্রধানও প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন, রাজ্যসভায় যে হেতু সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, তাই শুধু লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এই বিল পাশ করার চেষ্টা না করাই ভাল। বরং ধাপে ধাপে বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের মাধ্যমে রাজ্যসভায় সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা উচিত।
কিন্তু তখন বিজেপি-র শীর্ষ নেতারা মনে করেছিলেন, এমন বিপুল জনসমর্থন যে সরকারের রয়েছে, সেই সরকার জমি বিল পাশ করানোর ক্ষমতা রাখে। কিন্তু এখন মোদী সরকার হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছে, যৌথ অধিবেশন ডেকে বিল পাশ করানোও সহজ নয়। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীকে ঘরোয়া ভাবে পরামর্শ দিয়েছিলেন যাতে মন্ত্রিসভা এই বিষয়ে আর অধ্যাদেশ না আনে। এমনকী, যৌথ অধিবেশনের চেষ্টাও না করাই বাঞ্ছনীয়। প্রধানমন্ত্রী কিন্তু রাষ্ট্রপতির পরামর্শ শুনেছেন।
সমস্যা হল, কংগ্রেসের পক্ষ থেকে যে সব সংশোধন প্রস্তাব করা হয়েছিল, তার কিছু মেনে নিয়ে কংগ্রেসকেও এই বিল পাশ করানোর একটা কৃতিত্ব দিয়ে যৌথ ভাবে কাজটা সারতে রাজি ছিল না সরকার। কেন্দ্রের মনোভাব ছিল, কংগ্রেস বিলটা পাশ করতে দিচ্ছে না। আমরা বিলটা পাশ করিয়ে ছাড়ব। এই জেদাজেদিতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে যায়। কংগ্রেস ও অন্য বিরোধী দলগুলি আরও একজোট ও আক্রমণাত্মক হয়।

দ্বিতীয়ত, এক বছরে দেশের আর্থিক অবস্থার কোনও নজরকাড়া উন্নতি হয়নি। শেয়ার বাজারের অধোগতি প্রায় স্থায়ী হতে চলেছে। ইউয়ানের অবমূল্যায়নের ফলে চিনের অর্থনীতি ধাক্কা খেয়েছে। কিন্তু তার সুযোগ ভারত নিতে পারেনি।

উল্টে অর্থ মন্ত্রক সূত্রে জানা যাচ্ছে, মার্কিন প্রশাসন শীঘ্রই তাদের ফেডেরাল ব্যাঙ্কের সঙ্গে সমন্বয় করে সুদের হার বাড়িয়ে ডলারকে তেজি করতে চলেছে। তাতে শুধু চিন নয়, ভারতও আরও সমস্যার মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি সুদের হার কমানোর জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন।

কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তা সম্ভব নয়। একটাও বড় সংস্কারের কর্মসূচি পূরণ করতে পারেনি সরকার। সংসদেও কোন সংস্কারের প্রস্তাব পাশ করানো যায়নি। শুধু কিছু সামাজিক প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করা গিয়েছে। বৃদ্ধির হারও ০.৫ শতাংশ কমেছে। এতে জগদীশ ভগবতী, অরবিন্দ পানাগড়িয়ার মতো অর্থনীতিবিদরাও অসন্তুষ্ট। বণিক মহলও মনে করছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার হিসেবে প্রথম বছরে বড় পদক্ষেপ করার সুযোগ হাতছাড়া করেছে মোদী সরকার।

তৃতীয়ত, আমলাতন্ত্র সামলানোর প্রশ্নেও সমন্বয়ের অভাব স্পষ্ট। যে ভাবে দু’জন স্বরাষ্ট্রসচিব ও এক জন বিদেশসচিবকে সরানো হল তাতে সামগ্রিক ভাবে আমলাতন্ত্রের মধ্যে একটা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।

চতুর্থত, বিদেশনীতি বিশেষ করে, পাকিস্তান নীতি রূপায়ণের প্রশ্নে এক ধরনের অস্থিরতা এবং ধারাবাহিকতার অভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। কখনও বন্ধুত্ব, কখনও শত্রুতার ফলে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে।

বিহারের ভোটে তাই বিরোধীরা নরেন্দ্র মোদীর এক বছরের শাসনের বিরুদ্ধে সরব হলেও মোদী নিজে তাঁর সরকারের এক বছরের কাজের থেকে বিহারের ভোটকে আলাদাই রাখতে চাইছেন। তিনি বলছেন, বিহারের ভোটে লড়াই হোক রাজ্যের ইস্যুতেই। আজকেও বিহারের জনসভায় তাই কিছুটা রক্ষণাত্মকই দেখিয়েছে মোদীকে।

বিজেপি সূত্র বলছে, প্রধানমন্ত্রী নিজেই বুঝতে পারছেন পরিস্থিতি প্রতিকূল। এবং এটাই আশার কথা। মোদীর বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত কোনও দুর্নীতির অভিযোগ নেই। এখনও তাঁর ভাবমূর্তি কঠোর প্রশাসকের।

এমনকী বিজেপি নেতারা অনেকে এখনও মনে করছেন, চটজলদি সুষমা স্বরাজ এবং বসুন্ধরা রাজের ইস্তফা গ্রহণ না করে প্রধানমন্ত্রী সঠিক কাজ করেছেন। তা না হলে বিরোধীরা আরও রক্তের স্বাদ পেত। এই পরিস্থিতিতে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে দল ও সরকারের অন্দরে। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের মতো নেতারাও এখন বলছেন, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে কোনও ভুলচুক হয়ে থাকলে তাও শুধরোতে হবে।

তবে প্রধানমন্ত্রী চুপ করে রয়েছেন। তা দেখে অনেকের ধারণা হল, তিনি নীরবে আগামী চার বছরের একটা রণকৌশল মনে মনে ভাবছেন। মন্ত্রিসভায় একটা বড় ধরনের রদবদল করা হবে। তার আগে আপাতত আমলাতন্ত্রের ঘুঁটি সাজাচ্ছেন মোদী। ক্যাবিনেট সচিব অজিত শেঠ প্রস্তাব দিয়েছেন, বিভিন্ন মন্ত্রকে উপদেষ্টা কমিটি তৈরি করার জন্য। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সঙ্গে অন্যান্য মন্ত্রকের এই উপদেষ্টা কমিটি তৈরি হলে জনমানসে ধারণা তৈরি হবে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সকলের অংশগ্রহণ রয়েছে। মন্ত্রকের উপদেষ্টারাও বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের হয়ে কথা বলবেন। তবে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। ইউপিএ সরকারের সময়ে সনিয়া গাঁধীর নেতৃত্বে জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদ তৈরি হয়েছিল। ক্যাবিনেট সচিবের মতে, উপদেষ্টা কমিটির মত শুনলে সরকারের বাইরের কিছু দৃষ্টিভঙ্গি জানার সুযোগ পাওয়া যায়। আবার সংবাদমাধ্যমে সরকারের মত তুলে ধরার কাজও করতে পারেন উপদেষ্টারা।

বিহার নির্বাচনের পরে প্রধানমন্ত্রী সরকারের ভাবমূর্তি ফেরানোর কাজে ফের ঝাঁপাবেন বলে আশা বিজেপি নেতৃত্বের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Modi government Inc think Delhi Narendra Modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE