Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

রাজ্যসভায় একজোট বাম ও তৃণমূল, হার মানল সরকার

কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী সরকারকে আকণ্ঠ অস্বস্তিতে ফেলে দিয়ে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতায় সংশোধনী প্রস্তাব আজ রাজ্যসভায় পাশ করিয়ে নিলেন বিরোধীরা। এবং তার মধ্যে দিয়ে আরও একবার পরিষ্কার হয়ে গেল, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে লোকসভায় দাপট ধরে রাখলেও সংসদের উচ্চসভায় কত দূর সংখ্যালঘু মোদী সরকার! কতটা দুর্বল! রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার ধন্যবাদ প্রস্তাবের ভোটাভুটিতে হেরে যাওয়া যে কোনও শাসক দলের পক্ষেই চূড়ান্ত অস্বস্তির।

বিজেপি সংসদীয় বোর্ডের বৈঠকে নরেন্দ্র মোদী। মঙ্গলবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।

বিজেপি সংসদীয় বোর্ডের বৈঠকে নরেন্দ্র মোদী। মঙ্গলবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৫ ০৩:৪৮
Share: Save:

কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী সরকারকে আকণ্ঠ অস্বস্তিতে ফেলে দিয়ে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতায় সংশোধনী প্রস্তাব আজ রাজ্যসভায় পাশ করিয়ে নিলেন বিরোধীরা। এবং তার মধ্যে দিয়ে আরও একবার পরিষ্কার হয়ে গেল, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে লোকসভায় দাপট ধরে রাখলেও সংসদের উচ্চসভায় কত দূর সংখ্যালঘু মোদী সরকার! কতটা দুর্বল!

রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার ধন্যবাদ প্রস্তাবের ভোটাভুটিতে হেরে যাওয়া যে কোনও শাসক দলের পক্ষেই চূড়ান্ত অস্বস্তির। কারণ এর অর্থ, রাষ্ট্রপতির মর্যাদা রক্ষা করতে পারল না সরকার। সংসদীয় ইতিহাসে এর দৃষ্টান্ত বিরল। একই সঙ্গে আজ আরও একটি বিরল ঘটনা ঘটল রাজ্যসভায়। ধন্যবাদ প্রস্তাবে এক যোগে সংশোধনী প্রস্তাব আনল সিপিএম এবং তৃণমূল! আজ বিজেপিকে ‘শিক্ষা’ দিতে গিয়ে ‘ইগো’-র পাঁচিল ভেঙে ফেলল দু’দল! এবং এ ব্যাপারে রাজ্যসভায় সিপিএমের আনা প্রস্তাবের সমর্থনে দাঁড়ানোর জন্য তৃণমূলকে নির্দেশ দিলেন খোদ দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! দলের নির্দেশ মেনে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোটাভুটিতে অংশ নিলেন তৃণমূল সাংসদ মুকুল রায়ও। কংগ্রেস, সপা, বসপা, জেডিইউ, ডিএমকে এমনকী বিজু জনতার মতো দলও আজ একজোট হয়ে ১১৮-৫৭ ভোটে হারিয়ে দিল নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে।

সংসদের বাজেট অধিবেশনের প্রথম দিন রীতি অনুযায়ী যৌথ অধিবেশনে বক্তৃতা দেন রাষ্ট্রপতি। সরকার সেই বক্তৃতার বয়ান লিখে দেয় এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা তা অনুমোদন করে। মূলত সরকারের সাফল্য, নীতি ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচির দিগ্নির্দেশ থাকে ওই বক্তৃতায়। রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার পর তা নিয়ে সংসদের উভয় কক্ষে ধন্যবাদ প্রস্তাবে আলোচনা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে লোকসভায় ওই প্রস্তাব গত শুক্রবারই পাশ করিয়ে নিয়েছিল সরকার। সেখানে তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ের সংশোধনী প্রস্তাব ধোপে টেকেনি।

কিন্তু রাজ্যসভায় আজ সিপিএম সাংসদ সীতারাম ইয়েচুরি ও তৃণমূল সাংসদ সুখেন্দু শেখর রায় সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করেন। পৃথক প্রস্তাব হলেও উভয়েরই মোদ্দা বক্তব্য, উচ্চ স্তরে দুর্নীতি রুখতে এবং বিদেশে গচ্ছিত কালো টাকা উদ্ধার করতে সরকার যে ব্যর্থ হয়েছে, তা ধন্যবাদ প্রস্তাবে (রাষ্ট্রপতির বক্তৃতায়) নেই। সুতরাং সেখানে এই বক্তব্যটি যোগ করা হোক। সংশোধনী প্রস্তাবের ভোটাভুটিতে বিরোধীরা জিতে যাওয়ার অর্থ, ধন্যবাদ প্রস্তাবে এ কথা জুড়তে হবে সরকারকে।

সাংবিধানিক এই খুঁটিনাটির চেয়েও আজ বড় হয়ে উঠেছে মোদী সরকারের রাজনৈতিক অস্বস্তিটাই। কারণ, একে তো বিরোধীরা ভোটাভুটির মাধ্যমে প্রমাণ করতে চাইলেন দুর্নীতি দমনে মোদী ব্যর্থ হয়েছেন। একই সঙ্গে তাঁরা এও বুঝিয়ে দিলেন, বিরোধীরা এক কাট্টা হলে রাজ্যসভার বাধা টপকানো সরকারের পক্ষে কত কঠিন হয়ে পড়তে পারে! বিরোধীদের কটাক্ষ, রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার ধন্যবাদ প্রস্তাবই পাশ করাতে পারে না যে সরকার, তারা বিল পাশ করাবে কী ভাবে?

অতীতে রাজ্যসভায় এ ধরনের ঘটনা মাত্র তিন বার ঘটেছে। প্রথমে ১৯৮০ সালে জনতা পার্টি সরকারের আমলে। পরে ১৯৮৯ সালে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের নেতৃত্বে জাতীয় ফ্রন্ট সরকারের জমানায়। তার পর ২০০১ সালে বাজপেয়ী সরকারের সময়। মজার ঘটনা হল, কেন্দ্রে গত দশ বছর টানা সরকার চালালেও রাজ্যসভায় গোড়া থেকেই সংখ্যালঘু ছিল ইউপিএ। তখন প্রতিবারই বিরোধীরা রাষ্ট্রপতির বক্তৃতায় সংশোধনী প্রস্তাব আনতেন। কিন্তু কংগ্রেসের রাজনৈতিক ম্যানেজারেরা বিরোধী নেতাদের সঙ্গে পৃথক ভাবে বসে হয় সেই প্রস্তাব প্রত্যাহার করিয়ে নিতেন, না হলে মায়াবতী-মুলায়মকে পাশে নিয়ে রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতেন।

সে দিক থেকেও ব্যর্থ হল বিজেপি। রাজনৈতিক সূত্রে বলা হচ্ছে, আসলে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে তামাম বিরোধী দল এখন এককাট্টা। রাজ্যসভায় তৃণমূল, কংগ্রেস, বাম, জেডিইউ এবং সপা-বসপা এক হলেই সরকার প্যাঁচে পড়ে যায়। দিল্লি ভোটে বিজেপির ভরাডুবির পর এই দলগুলি চাইছিল রাজ্যসভাতেও মোদী সরকারকে একটা বার্তা দিতে। তাই গত কয়েক দিন ধরে ন’টি বিরোধী দলের নেতারা নিজেদের মধ্যে কক্ষ সমন্বয় করে চলছিলেন। এক সময় এই প্রশ্নও উঠেছিল যে, রাষ্ট্রপতির বক্তৃতায় সংশোধনী প্রস্তাব আনা ঠিক হবে কিনা। কিন্তু লোকসভায় বিরোধীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর আক্রমণ, বেঙ্কাইয়া নায়ডুর মতো মন্ত্রীদের আচরণে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন বিরোধী নেতারা। তার উপর এ দিন রাজ্যসভায় জবাবী ভাষণ দেওয়ার পরেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। দীর্ঘদিনের প্রথা মেনে বিরোধীরা তাঁর কাছে ব্যাখ্যা চাওয়ার সুযোগই পাননি। এর পরেই ক্ষুব্ধ বিরোধী নেতারা একজোট হয়ে ঠিক করে ফেলেন, রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার উপর সংশোধনী প্রস্তাব আনা হবে। তবে বামেদের সঙ্গে একই বিষয়ে সংশোধনী প্রস্তাব আনা ঠিক হবে কিনা, সে বিষয়ে জানতে আজ দুপুর বারোটা নাগাদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোনও করেন রাজ্যসভায় তৃণমূলের নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন। কিন্তু মমতা তাঁকে বলেন, দুর্নীতি প্রশ্নে সরকারকে বার্তা দিতে কোনও ‘ইগো’ রাখা ঠিক হবে না। তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, মমতা নবান্নে বসে দূরদর্শনে গোটা ভোটাভুটি কাণ্ড দেখেন। পরে তৃণমূলের রাজ্যসভার নেতা বলেন, “সংসদীয় ব্যবস্থার এটাই ভাল দিক যে, প্রয়োজন পড়লে সরকারকে কঠোর বার্তা দিতে পারেন বিরোধীরা। ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিরোধীরা আজ সেটাই করেছেন।”

বিজেপি অবশ্য এর পরেও সাহসী মুখ দেখাতে চেয়েছে। দলের নেতা শাহনওয়াজ হুসেন বলেন, রাজ্যসভায় সরকার যে সংখ্যালঘু, এ কথা সত্যি। ফলে এই পরিস্থিতি যে হতে পারে, সে আশঙ্কা ছিলই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজ রাজ্যসভায় যে কথা বলেছেন, সেটাই আসলে দেশের বাস্তব রাজনৈতিক ছবি। রাজ্যসভায় বিভিন্ন বিরোধী দলের যে সাংসদরা এখনও রয়েছেন, তাঁদের নিজেদের রাজ্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে গেছে। লোকসভা ভোটে সেখানে বিজেপি হই হই করে জিতেছে। আর এই নেতারা রাজ্যসভার সদস্য থাকার দৌলতে এখনও কাগুজে বাঘ হয়ে রয়েছেন! বিজেপি এবং সরকারের তরফে বলা হয়েছে, রাজ্যসভায় পাশ হওয়া সংশোধনী প্রস্তাব আর লোকসভায় এনে ভোটাভুটি করাতে হবে না। কারণ, এটা কোনও বিল নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE