অর্থনীতিতে ভাটার টান। নোট বাতিলের ফলে সে টান আরও বেড়েছে। চাঙ্গা করতে টাকা ঢালতে হবে গ্রামে, সড়কে, পরিকাঠামোয়। সেই খরচ করতে চাইছেন অরুণ জেটলি। তার জন্য রাজকোষ ঘাটতি বাড়লেও, সেই ঘাটতি মেটানোর জন্য বেশি টাকা ধার করতে হলেও তাঁর আপত্তি নেই।
আগামী অর্থ বছরে (২০১৭-১৮) রাজকোষ ঘাটতি জিডিপি-র ৩ শতাংশে কমিয়ে আনার কথা ছিল। কিন্তু অর্থ মন্ত্রক সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী আগামী বাজেটে রাজকোষ ঘাটতি বাঁধতে পারেন ৩.৫ শতাংশে। ০.৫ শতাংশ-বিন্দুর তফাতটা শুনতে সামান্য মনে হলেও টাকার অঙ্কে পরিমাণটা যথেষ্ট। অর্থ মন্ত্রকের কর্তাদের হিসেবে, ঘাটতির রাশ এইটুকু আলগা হলেই প্রায় ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি অর্থ চলে আসবে জেটলির হাতে। যা থেকে ১০০ দিনের কাজ, গ্রাম সড়ক, কৃষি সেচ, আবাসন, সামাজিক প্রকল্পে আরও টাকা ঢালা যাবে।
অঙ্কটা কতখানি? চলতি বছরে ১০০ দিনের কাজে খরচ হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। চাষিদের মন জিততে নরেন্দ্র মোদীর ঢাক পেটানো ফসল বিমা যোজনার জন্য বরাদ্দ মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। গোটা দেশে গ্রাম সড়ক যোজনা রূপায়ণ করতে ২০ হাজার কোটি টাকাও ব্যয় হয় না। যার অর্থ, এই এক লক্ষ কোটি টাকা দিয়ে জেটলি চাইলে ১০০ দিনের কাজে দ্বিগুণ টাকা ঢালতে পারেন। কিংবা ১৫ থেকে ২০টি ফসল বিমা যোজনার মতো প্রকল্প চালু করে নরেন্দ্র মোদীকে গ্রামের মানুষের হৃদয় জয়ের সুযোগ তৈরি করে দিতে পারেন তিনি, যে সুযোগ এখনই উত্তরপ্রদেশে মোদীর বিশেষ কাজে লাগতে পারে।
টাকার অঙ্কটা বিপুল বলেই ঘাটতি বেড়ে যাওয়া নিয়ে বড় চিন্তাও আছে অর্থমন্ত্রীর। এমনিতেই নোট বাতিলের ধাক্কায় অর্থনীতিতে ধাক্কা লাগার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সেই ধাক্কা হিসেবের মধ্যে না ধরেও মোদী সরকারেরই পরিসংখ্যান মন্ত্রকের আশঙ্কা, চলতি বছরে জিডিপি-র বৃদ্ধির হার ৭.১ শতাংশে নেমে আসবে। এরই মধ্যে আবার আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (আইএমএফ) পূর্বাভাস করেছে, চলতি বছরে বৃদ্ধির হার নেমে আসবে ৬.৬ শতাংশে। আগামী বছরেও বৃদ্ধির হার ৭.২ শতাংশেই আটকে থাকবে। রাজকোষ ঘাটতির হিসেব কষা হয় জিডিপি-র সঙ্গে তুলনা করে। চলতি বছরে যেমন ঘাটতির পরিমাণ ৫.৩৪ লক্ষ কোটি টাকা। যা জিডিপি-র ৩.৫ শতাংশ। এই অর্থ সরকারকে বাজার থেকে ধার করতে হয়। জিডিপি বৃদ্ধির হার যদি কমে যায়, তা হলে রাজকোষ ঘাটতির অনুপাতও বাড়বে।
অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, এমনিতেই সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অতিরিক্ত পুঁজির বন্দোবস্ত এবং সামাজিক প্রকল্পে খরচ করার পরে হাতে টাকা থাকে না। এর পরে অর্থনীতিতে চাঙ্গা করতে গ্রামের পরিকাঠামো বা আবাসনে আরও টাকা ঢালতে হলে, ঘাটতি মেনে নিয়ে আরও ধার করা ছাড়া উপায় নেই। ঘাটতির হার ৩ থেকে ৩.৫ শতাংশে বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়াটাই তাই একমাত্র উপায়। অর্থনীতিবিদদের সিংহভাগের মত, অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এখন ঘাটতির কথা ভুলে গিয়ে পরিকাঠামোয় খরচ করতে হবে। অর্থনীতিবিদ পিনাকী চক্রবর্তী বলেন, ‘‘নোট বাতিলের জেরে ধাক্কা খাওয়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার দাওয়াই হল ব্যয়বরাদ্দ বাড়ানোর স্টিমুলাস।’’ ব্যাঙ্ক অব আমেরিকা মেরিল লিঞ্চ-ও বলছে, বিশ্ব জুড়ে মন্দার ছায়া বড় হচ্ছে। তার মোকাবিলায় ভারতের ঘাটতির রাশ আলগা করা দরকার।
সমস্যা হল, ইচ্ছে করলেই যে কেন্দ্র বা রাজ্যের সরকার রাজকোষ ঘাটতি বাড়াতে পারে এমন নয়। কারণ ধাপে ধাপে ঘাটতি কমিয়ে আনার ব্যাপারে কেন্দ্র ও সব রাজ্য সরকারই আইনত দায়বদ্ধ। এ জন্য রাজকোষ দায়বদ্ধতা ও বাজেট ব্যবস্থাপনা (এফআরবিএম) আইন রয়েছে। এই আইনের জন্যই জেটলির সামনে আগামী অর্থ বছরে ঘাটতি ৩ শতাংশে কমিয়ে আনার শর্ত ছিল। সেই সমস্যা মোকাবিলার ব্যবস্থাও অবশ্য করে রাখা হচ্ছে। গত বাজেটের সময়ই জেটলি বলেছিলেন, ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট অঙ্কে বাঁধা থাকবে, না কি শুধু তার নিম্ন ও ঊর্ধ্বসীমা বলা থাকবে, তা ভাবা দরকার। এ জন্য প্রাক্তন রাজস্ব সচিব এন কে সিংহের নেতৃত্বে একটি কমিটি তৈরি হয়। চলতি সপ্তাহেই ওই কমিটি রিপোর্ট পেশ করবে। তাদের সুপারিশেও ঘাটতি বাড়ানোর ব্যবস্থা থাকবে বলেই সরকারি সূত্রের খবর।
জেটলির পক্ষে স্বস্তির কথা হল, রাজ্যের অর্থমন্ত্রীরাও তাঁর পাশে। বাজেটের প্রস্তুতিপর্বে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন জেটলি। সেখানে সব অর্থমন্ত্রীই দাবি তুলেছেন, নোট বাতিলের ফলে দেশে মন্দার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই রাজ্যগুলিকেও প্রয়োজনে বেশি ঋণ করে উন্নয়নে বাড়তি খরচ করার সুযোগ দেওয়া হোক। সোজা কথায়, রাজ্যগুলিরও ঘাটতি বাড়ানোর ছাড়পত্র চাই। কেন্দ্র এফআরবিএম আইন সংশোধন করে নিজের ঘাটতির রাশ আলগা করলে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীরাও তাঁদের বাজেটে ঘাটতির ক্ষেত্রে আরও স্বাধীনতা পারবেন। এ ব্যাপারে তাই সব দলকেই পাশে পাওয়া যাবে বলে জেটলির আশা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy