সাহসী সংস্কার।
আগামী মাস থেকেই শেয়ার বাজারে খাটবে এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ডের (ইপিএফও) টাকা। শুরুতে এক শতাংশ। এবং চলতি আর্থিক বছরের মধ্যেই পিএফের তহবিলে জমা পড়া টাকার ৫ শতাংশ ঢালা হবে শেয়ার বাজারে।
একে এই মুহূর্তে সুষমা স্বরাজ, বসুন্ধরা রাজে, স্মৃতি ইরানিকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্ক সামলাতে জেরবার নরেন্দ্র মোদীর সরকার। তার উপর পিএফের টাকা শেয়ার বাজারে খাটানোর সিদ্ধান্ত বরাবরই স্পর্শকাতর। বিশেষত এর বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন। তাই সেই সমস্ত ওজর-আপত্তি ঠেলে বৃহস্পতিবার কেন্দ্র যে ভাবে এই সংস্কারের পথে হেঁটেছে, তাকে ‘সাহসী’র তকমা দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে যে ভাবে এই লগ্নি আগামী মাস থেকেই শুরু করে দেওয়ার
কথা বলা হয়েছে, তা কিছুটা চমকে দিয়েছে অনেককে।
মার্চ-এপ্রিলে সিদ্ধান্ত হয়ে গেলেও, এ নিয়ে এত দিন গড়িমসি চলছিল প্রশাসনের অন্দরে। কিন্তু এ দিন কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী বন্দারু দত্তাত্রেয় শেয়ার বাজারে লগ্নির দিনক্ষণ ঘোষণা করে দেন।
চাকুরিজীবীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা সংস্থা ইপিএফও-র তহবিলের বহর এখন ৬ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। শুধু চলতি অর্থবর্ষেই সেখানে জমা পড়বে প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা। সুতরাং তার ৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৫ হাজার কোটি টাকা আসবে শেয়ার বাজারে। অর্থ মন্ত্রক ১৫ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ারে ঢালার কথা বললেও, এখনই অতখানি ঝুঁকি নিচ্ছে না ইপিএফও।
উল্লেখ্য, এপ্রিলেই কেন্দ্রীয় শ্রম সচিব শঙ্কর অগ্রবাল জানিয়েছিলেন, প্রতি বছর পিএফের তহবিলে যে টাকা জমা পড়ে (ইনক্রিমেন্টাল ডিপোজিট), তার ৫ শতাংশ এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ডে (ইটিএফ) বিনিয়োগ করা হবে। ইটিএফ হল সেই সব মিউচুয়াল ফান্ড, যাদের ইউনিট স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন হয়। তবে পিএফের অছি পরিষদকে এড়িয়ে কেন্দ্র এমন একতরফা ভাবে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করায় তখনই তার কড়া সমালোচনা করেছিল কর্মী সংগঠনগুলি। এ দিনও সরকারের সমালোচনা করেছে তারা।
এখন প্রশ্ন হল, আখেরে এতে লাভ হবে না ক্ষতি? কারণ, শেয়ার বাজার চাঙ্গা থাকলে যেমন চড়া রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তেমনই বাজারে ধস নামলে আশঙ্কা থাকে টাকা জলে যাওয়ারও।
শিল্পমহলের যুক্তি, এতে শেষমেশ লাভই হবে কর্মচারীদের। কারণ, এখন পিএফ থেকে ৮.৭৫% হারে সুদ মেলে। এর থেকে খুব বেশি সুদ পাওয়া শক্ত। ফলে মূল্যবৃদ্ধিকে টপকে সঞ্চয়ের সত্যিকারের পরিমাণ বাড়াতে হলে, তার একটা অংশ শেয়ার বাজারে খাটানো ছাড়া গতি নেই। যে কারণে শেয়ার কেনা কিংবা নিদেন পক্ষে শেয়ার নির্ভর মিউচুয়াল ফান্ডে লগ্নি ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে মধ্যবিত্তদের মধ্যে। কিন্তু সমস্যা হল, অনেক সময়ই সাধারণ বেতন পাওয়া চাকুরিজীবীদের হাতে আলাদা করে শেয়ারে বা ফান্ডে খাটানোর মতো যথেষ্ট টাকা থাকে না। তাই বাধ্যতামূলক ভাবে পিএফের টাকার একটি অংশ যদি সেখানে যায়, তাতে আখেরে লাভই হবে বলে শিল্পমহলের অভিমত। বণিকসভা ফিকি-র মহাসচিব দিদার সিংহ এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘দীর্ঘমেয়াদে, বিভিন্ন ধরনের শেযারে যদি লগ্নি করা হয়, তা হলে চাকুরিজীবীরা উপকৃতই হবেন।’’ তা ছাড়া, এখন প্রায় সারা বিশ্বেই পিএফ ও পেনশন তহবিলের একটি অংশ শেয়ার বাজারে খাটে। ভারতেও জাতীয় পেনশন প্রকল্প বা এনপিএসে জমা পড়া টাকার একাংশ যায় শেয়ার বাজারে।
কিন্তু শ্রমিক সংগঠনগুলির অভিযোগ, সাধারণ মানুষের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করা টাকা নিয়ে ছেলেখেলা করতে চাইছে সরকার। শেয়ার বাজারকে চাঙ্গা করার স্বার্থে। সঙ্ঘ পরিবারের শ্রমিক সংগঠন বিএমএস-ও এর বিরোধী।
বিএমএসের সাধারণ সম্পাদক ব্রিজেশ উপাধ্যায় বলেন, ‘‘মানুষের সঞ্চয়ের টাকা যে জলে যাবে না, সরকার সেই দায়িত্ব নিক। না হলে শেয়ার বাজারে টাকা খাটানোর ঝুঁকি নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই।’’ এআইটিইউসি-র সাধারণ সম্পাদক গুরুদাস দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘শেয়ার বাজার মূলত ফাটকাবাজি নির্ভর। ফলে অবসরের শেষ সম্বলও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।’’ সিটু-র তপন সেনের দাবি, ‘‘বহু দেশেই পিএফের টাকা ডুবেছে।’’ এ ছাড়া শ্রমিক নেতাদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের পিএফের টাকা শেয়ার বাজারে খাটলেও, কর্মচারীরা কতটা ঝুঁকি নিতে চান, তাঁরা তা ঠিক করার সুযোগ পান। এখানে তা-ও নেই।
এর বিপরীতে দিদার সিংহের যুক্তি, পিএফ সঞ্চয়ের এতটাই কম অংশ শেয়ার বাজারে ঢালা হবে যে, মন্দার আঁচ চাকুরিজীবিদের গায়ে লাগবে না।
অর্থ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, পিএফের টাকা শেয়ার বাজারে ঢালা আসলে আর্থিক সংস্কারেরই অঙ্গ। ৫ হাজার কোটি টাকা লগ্নি হলে বাজার চাঙ্গা হবে। সে ক্ষেত্রে চড়া দামে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার শেয়ার বেচে বিলগ্নিকরণ খাতে বেশি টাকা ভাঁড়ারে আনা সম্ভব হবে। উল্লেখ্য, এ বছর বিলগ্নিকরণ থেকে ৬৯,৫০০ কোটি টাকা তোলার লক্ষ্য স্থির করেছেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। ইপিএফও-র টাকা বাজারে এলে তা দিয়েও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার শেয়ার কেনা যাবে। ঠিক যে ভাবে ইউপিএ-জমানায় শেয়ার বাজারে মন্দা চলাকালীন বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার শেয়ার কিনেছিল জীবন বিমা নিগম (এলআইসি)।
তবে সরকারের ‘সাহসী’ সিদ্ধান্তের পরেও শিল্পমহলের হতাশা দু’টি কারণে। এক, তাদের মতে, এই পদক্ষেপ মার্চ-এপ্রিলেই চালু করা উচিত ছিল। আর দুই, আপাতত মাত্র ৫ শতাংশ টাকা বাজারে ঢালার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাদের যুক্তি, কারও বেতন থেকে মাসে ১০ হাজার টাকা পিএফে জমা পডলে, মাত্র ৫০০ টাকা যাবে শেয়ার বাজারে। ফলে তা থেকে খুব বেশি বাড়তি আয় হবে না।
দত্তাত্রেয় অবশ্য জানিয়েছেন, ‘‘শুরুতেই চাকুরিজীবীদের খুব বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চায় না সরকার। তা ছাড়া, এ নিয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলিরও আশঙ্কা রয়েছে।’’ তাই ভাল ফল মিললে, ধাপে ধাপে পিএফ তহবিলের ১৫ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ার বাজারে লগ্নি করা হবে বলে ইঙ্গিত দেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy