কোনও ইঙ্গিত ছিল না। সন্ধ্যায় খবরটা আসতেই বোঝা গেল, ভিন্ দেশের মাটিতে চার ঘণ্টা বৈঠক করে বছরের শেষ মাসে বড় চমক উপহার দিল ভারত ও পাকিস্তান।
রবিবার ব্যাঙ্ককে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল বৈঠক করেন পাক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নাসির জানজুয়ার সঙ্গে। ছিলেন বিদেশসচিব এস জয়শঙ্কর ও পাক বিদেশসচিব আইজাজ আহমেদ চৌধুরি। সোমবার বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ মঙ্গলবারই দু’দিনের সফরে ইসলামাবাদ রওনা হচ্ছেন। পাক বিদেশমন্ত্রী শরতাজ আজিজের সঙ্গে তিনি বৈঠক করবেন বলে মন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছে।
এ দিনের ম্যারাথন বৈঠকের পরে যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, নিরাপত্তা, সীমান্তপার সন্ত্রাসের সঙ্গে কথা হয়েছে সন্ত্রাস এবং কাশ্মীর নিয়েও। নয়াদিল্লি বরাবরই আলোচনার টেবিলে বসে সন্ত্রাস নিয়ে পাকিস্তানকে চাপে ফেলতে চেয়েছে। পাকিস্তানেরও পাল্টা লক্ষ্য থেকেছে কাশ্মীর প্রসঙ্গ টেনে আনা। স্বাভাবিক ভাবেই এ দিন কাশ্মীর প্রসঙ্গ ওঠায় কিছুটা হলেও প্রশ্নের মুখে বিদেশ মন্ত্রক। যদিও নয়াদিল্লির তরফে বলা হয়েছে, বৈঠকটি মূলত ছিল দু’দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টার। তাই নিয়ন্ত্রণরেখার অস্থিরতার সূত্রেই উঠেছে কাশ্মীর। গত ছ’মাসে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের মদতে উধমপুর, গুরদাসপুরের মতো জায়গায় একাধিক জঙ্গি হামলা হয়েছে। পাশাপাশি ভারতে আইএসআই-এর মদতে জঙ্গি জাল ছড়ানোর বিষয়টিও বারেবারেই সামনে আসছে। এ দিনের বৈঠকে পাকিস্তানের জঙ্গি-যোগ সংক্রান্ত বেশ কিছু প্রমাণ নাসির জানজুয়ার হাতে তুলে দিয়েছে ভারত। এ নিয়ে ইসলামাবাদকে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জিও জানিয়েছে দিল্লি।
দু’দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়ের এই আচমকা বৈঠকের পরে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, কেন এত গোপনীয়তা রাখা হল বিষয়টি নিয়ে? এর উত্তরও মিলেছে বিদেশ মন্ত্রকের একটি সূত্রেই। সেই সূত্রটির বক্তব্য, দু’পক্ষের কেউই চাননি বৈঠকটি নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা হোক। তাতে পাকিস্তানের ভারত-বিরোধী অংশটি আবার সক্রিয় হয়ে ভেস্তে দিতে পারত বৈঠকটি। এমনকী আলোচনার পরিবেশই ফের নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা ছিল। একই ভাবে সংবাদমাধ্যমও যাতে বিষয়টি নিয়ে বেশি হইহই করে উত্তেজনা ও প্রত্যাশার পারদ না চড়ায়, সে দিকেও নজর রাখা হয়েছিল। তাই চূড়ান্ত গোপনীয়তায় একটি তৃতীয় তথা নিরপেক্ষ দেশে বৈঠকটি করা হয়েছে। বিদেশ মন্ত্রকের একটি সূত্রের দাবি, এর পরে সুষমা ইসলামাবাদ গেলেও তাঁর উপরে বাড়তি কোনও চাপ পড়বে না। সেখানে সৌজন্যের মোড়কেই পাক বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারবেন সুষমা।
রবিবার ব্যাঙ্ককে দু’দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। নাসির জানজুয়া (বাঁ দিকে) ও অজিত ডোভাল। ছবি: পিটিআই
অথচ মাত্র ক’দিন আগেও মনে হচ্ছিল, নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিদেশ নীতিতে বড় কাঁটা হয়ে উঠতে যাচ্ছে পাকিস্তান। একের পর এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কও তলানিতে ঠেকছে। অক্টোবরেই প্রাক্তন পাক নিরাপত্তা উপদেষ্টা সরতাজ আজিজের ভারত সফর ইসলামাবাদ বাতিল করার পরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও তলানিতে চলে যায়।
কিন্তু সেই ছবিটাই দ্রুত বদলাতে থাকে গত ক’দিনে। দিন ছয়েক আগে সেখানে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বৈঠকের মধ্যেই মুখোমুখি হন নরেন্দ্র মোদী ও নওয়াজ শরিফ। সেখানেই স্থির হয়ে যায়, অদূর ভবিষ্যতের ভারত-পাক দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ভবিষ্যৎ। জুলাইয়ের উফা বৈঠকের সমীকরণ অনুযায়ী প্রথমে দু’দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বৈঠকটি হবে বলেই ঠিক হয়। রবিবার বহুকাঙ্খিত সেই বৈঠকই হল ব্যাঙ্ককে।
কূটনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, এই দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু নিয়ে প্রবল চাপ দিচ্ছিল আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলি। বিশেষ করে সিরিয়ার অস্থিরতা ও উপমহাদেশে আইএসের বাড়বাড়ন্তের পরে দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ যুযুধান থাকুক, এটা আদপেই কাম্য নয় ওয়াশিংটনের কাছে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে প্যারিসে জলবায়ু বৈঠক শুরুর আগে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন নওয়াজ। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের খবর, সেখানে নওয়াজ জানান, ভারতের সঙ্গে শর্ত ছাড়াই কথায় রাজি পাকিস্তান। সেই সূত্র ধরেই শেষ পর্যন্ত ব্যাঙ্কক বৈঠক। ঠিক হয়েছে, খুব শীঘ্রই ফের বৈঠকে বসবেন দু’দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টারা।
বরফ তো গলল। কিন্তু থাকবে ক’দিন, এখন সেটাই প্রশ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy