Advertisement
০৯ মে ২০২৪

সেনা ঘাঁটিতে জইশ-হানা, ফোনে আড়ি পেতে জোর রক্ষা পঞ্জাবে

চোস্ত পঞ্জাবিতে বলা কথাটা শুনেই প্রথম খটকাটা লেগেছিল ফোনে আড়ি পাতা গোয়েন্দাদের। এ পাশ থেকে ছেলে বলছে, ‘ম্যায় কুরবানি দেনে যা রহা হুঁ’। উল্টো দিক থেকে ঠান্ডা গলায় মা বললেন, ‘পহলে খা লো, ফির যো করনে গিয়া ওহ করো’।

বিমানঘাঁটিতে ঢুকে পড়েছে পাক জঙ্গি দল। তাদের সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে জওয়ানরা। শনিবার পাঠানকোটে এএফপি-র তোলা ছবি।

বিমানঘাঁটিতে ঢুকে পড়েছে পাক জঙ্গি দল। তাদের সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে জওয়ানরা। শনিবার পাঠানকোটে এএফপি-র তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:৩৯
Share: Save:

চোস্ত পঞ্জাবিতে বলা কথাটা শুনেই প্রথম খটকাটা লেগেছিল ফোনে আড়ি পাতা গোয়েন্দাদের। এ পাশ থেকে ছেলে বলছে, ‘ম্যায় কুরবানি দেনে যা রহা হুঁ’। উল্টো দিক থেকে ঠান্ডা গলায় মা বললেন, ‘পহলে খা লো, ফির যো করনে গিয়া ওহ করো’।

গোটা বাক্যালাপ মাত্র ৪০ সেকেন্ডের। কিন্তু তা শুনেই শোরগোল পড়ে যায় পঞ্জাব প্রশাসনের অন্দরমহলে। খবর যায় দিল্লিতে। সতর্ক করা হয় সব পক্ষকে। আর তার জেরেই আজ পাঠানকোটে বড়সড় জঙ্গি হামলা এড়ানো গেল বলে দাবি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের। তবে এ দিন ভোর রাত থেকে মোট ১৬ ঘণ্টা যে লড়াই চলল পাঠানকোটের বায়ুসেনা ঘাঁটিতে, তাই বা কম কী! দিনের শেষে চার জঙ্গিকে নিকেশ করা গিয়েছে বলে জানিয়েছে বায়ুসেনা সূত্র। প্রাণ গিয়েছে তিন জওয়ানেরও। তবে আগাম খবর পেয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ায় জঙ্গিদের বায়ুসেনা ঘাঁটির লঙ্গরেই (খাওয়ার জায়গা) আটকে ফেলা গিয়েছিল বলে সেনা সূত্রের দাবি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও বলছে, তৎপরতার জেরেই আজ বড় মাপের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছে পাঠানকোট।


সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন...

তৎপরতা শুরু হয়েছিল বৃহস্পতিবার শেষ রাত থেকে। পঞ্জাব সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর সুপার সালবিন্দর সিংহকে তাঁর মহীন্দ্রা এমইউভি গাড়ি-সহ ছিনতাই করে সেনার পোশাক পরা বেশ কয়েক জন দুষ্কৃতী। পরে সালবিন্দর ও তাঁর বন্ধু রাজেশ বর্মাকে গাড়ি থেকে ফেলে দিয়ে পালায় তারা। গাড়ির তৃতীয় আরোহী, সালবিন্দরের রাঁধুনি মদনলালের কোনও খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি। পুলিশ সুপারের অপহরণের খবর জানাজানি হওয়ার পরেই তাঁর দু’টি মোবাইল ফোনে আড়ি পাতে শুরু করেন গোয়েন্দারা। শুক্রবার বেশি রাতে একটি মোবাইল থেকে পাকিস্তানের নম্বরে ফোন করা শুরু হয়। প্রথম ফোনটিই এক জঙ্গি তার মাকে করে বলে গোয়েন্দা সূত্রের দাবি। তার কিছু ক্ষণের মধ্যেই সালবিন্দরের মোবাইলে ফোন করেন তাঁর দেহরক্ষী কুলবিন্দর। সেই ফোনও ধরে এক জঙ্গি। সে ‘সালাম আলাইকুম’ বলার পরে কুলবিন্দর জানতে চান, এসপি সাহেব কোথায়? তার পরেই ফোন কেটে দেওয়া হয়।


সংঘর্ষের পরে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া পাক জঙ্গিদের গুলি। এএফপি-র তোলা ছবি।

গত বছর গুরদাসপুরের দীনানগর থানায় সেনার পোশাক পরেই হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। তাই সালবিন্দরের গাড়ি অপহরণে সেনার পোশাক পরা দুষ্কৃতীরা জড়িত থাকায় প্রথম থেকেই জঙ্গি হামলার আশঙ্কা করেছিলেন গোয়েন্দারা। মোবাইলে আড়ি পেতে ওই কথাবার্তা শোনার পরে যুদ্ধকালীন তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। সরাসরি ঘটনার উপরে নজর রাখতে শুরু করেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। জঙ্গিদের সম্ভাব্য লক্ষ্যগুলি বেছে নিরাপত্তা বাড়ানোর কাজ শুরু করে বাহিনী।

পাঠানকোট ছাড়াও নিরাপত্তা বাড়ানো হয় সংলগ্ন চণ্ডীগড়, হালওয়ারা ও অম্বালার বায়ুসেনা ঘাঁটিতে। সতর্ক করে দেওয়া হয় হিমাচল প্রদেশ এমনকী দিল্লিকেও। তবে পাঠানকোট বায়ুসেনা ঘাঁটির বিপদই সবচেয়ে বেশি বলে মনে করেছিলেন ডোভাল। ফলে, রাতেই সেখানে পৌঁছে যায় এনএসজি এবং সেনার বিশাল বাহিনী।

ইতিমধ্যে সালবিন্দরের ফোনে আড়ি পেতে আরও কয়েকটি কথোপকথন শোনেন গোয়েন্দারা। শুক্রবার রাত সাড়ে বারোটা থেকে আড়াইটের মধ্যে পাকিস্তানে থাকা হ্যান্ডলারকে ফোনে এক জঙ্গি জানায়, ‘‘আমরা পৌঁছে গিয়েছি। এ বার কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়ব।’’ খুশি হয়ে হ্যান্ডলার বলে, ‘‘কী হচ্ছে আমাদের জানাতে থাকো।’’ জঙ্গিরা যে তাদের গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছে, তা বুঝতে পারেন গোয়েন্দারা। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও তারা ঠিক কোথায় যাচ্ছে, তা বুঝতে পারছিলেন না তাঁরা।

ভোর সাড়ে তিনটের সময়ে পাঠানকোট বায়ুসেনা ঘাঁটির ‘থার্মাল ইমেজিং’ ব্যবস্থায় জঙ্গিদের গতিবিধি ধরা পড়ে। পিছনের দিকের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ঘাঁটিতে ঢোকার চেষ্টা করছিল তারা। কাঁটাতার দেওয়া পাঁচিল টপকাতে গিয়ে খতম হয় প্রথম জঙ্গি। বাকিরা দেওয়াল টপকে আশ্রয় নেয় পাশেই খাওয়ার জায়গায়। অর্থাৎ লঙ্গরে। সেখানেই শুরু হয় গুলির লড়াই। মূল লড়াইটা চলে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। জঙ্গিদের গুলিতে নিহত হন বায়ুসেনার এক গরুড় কম্যান্ডো-সহ তিন জওয়ান।

এর পর শুরু হয় চিরুনি তল্লাশি। বেলা বারোটা নাগাদ ফের গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। সেনাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আরও জঙ্গি লুকিয়ে রয়েছে। শুরু হয় দ্বিতীয় দফা লড়াই। সেটা চলে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত। রাজনাথ টুইট করে জানান, অভিযান শেষ। পাঁচ জঙ্গিকে খতম করা হয়েছে। কিন্তু বায়ুসেনা সূত্রে তো খানিক আগেই দাবি করা হয়েছে সব মিলিয়ে হত জঙ্গির সংখ্যা চার! সংশয় ছড়ানোয় রাজনাথ কিছু ক্ষণ পরে নিজের ওই টুইট প্রত্যাহার করে নেন।

প্রাথমিক ভাবে গোয়েন্দারা মনে করছেন, এই হামলার পিছনে রয়েছে মাসুদ আজহারের জঙ্গি গোষ্ঠী জইশ-ই-মহম্মদের সদস্যেরা। ১৯৯৯ সালে নেপাল থেকে অপহরণ করে কন্দহরে নিয়ে যাওয়া ভারতীয় বিমান আইসি-৮১৪-র যাত্রীদের বিনিময়ে মাসুদ আজহারকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার। দু’বছর পরে আজহারের পরিকল্পনায় হামলা চালানো হয় ভারতীয় সংসদে। এ বার তার গোষ্ঠীর জঙ্গিরা কৌশলগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ পাঠানকোট ঘাঁটিতে থাকা মিগ-২১ বাইসন বিমান ও এমআই-২৫ কপ্টার নষ্ট করতে চেয়েছিল বলে বায়ুসেনা সূত্রের দাবি। তবে কোনও জঙ্গি গোষ্ঠী হামলার দায় নেয়নি।

তবে দিনের শেষে প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে বেশ কিছু। প্রথমত, পুলিশ সুপারকে কেন অপহরণ করল জঙ্গিরা? তাঁকে ছেড়েই বা দেওয়া হল কেন? তাঁর গাড়িও তো শেষ পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়নি। সালবিন্দরকে অপহরণ করার পরে গোটা শুক্রবার তল্লাশি চালিয়েও কেন জঙ্গিদের খোঁজ মিলল না? কেনই বা সালবিন্দরের ফোন থেকে পাকিস্তানে ফোন করতে গেল জঙ্গিরা? শেষ পর্যন্ত কত জন জঙ্গি মারা গিয়েছে, সেই সংশয় কাটেনি রাত অবধি।

গোয়েন্দাদের দাবি, সম্প্রতি পাকিস্তানের হয়ে চরবৃত্তির দায়ে এক বায়ুসেনাকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে জেরা করেই জানা গিয়েছিল যে, উত্তর ভারতের সামরিক ঘাঁটিতে হামলার পরিকল্পনা হচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্রে আরও খবর, গত সপ্তাহে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের মধ্যস্থতায় পাক অধিকৃত কাশ্মীরে বৈঠকে বসে লস্কর ই তইবা, বব্বর খালসা, জইশ ই মহম্মদ ও হিজবুল মুজাহিদিনের মতো জঙ্গি গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতারা। সেখানে বছরের শুরুতেই ভারতে হামলার ছক কষা হয়। তবে গোয়েন্দারা পাকিস্তানকে কাঠগড়ায় তুললেও নয়াদিল্লির পক্ষ থেকে সরকারি ভাবে তেমন কোনও অভিযোগ করা হয়নি। ইসলামাবাদও ঘটনার নিন্দা করে বলেছে, ‘‘সম্প্রতি দু’দেশের মধ্যে যে সম্প্রীতির আবহাওয়া তৈরি হয়েছে, তা ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর পাকিস্তান।’’

নিহত পদকজয়ী

সংবাদ সংস্থা • নয়াদিল্লি

পাঠানকোটে জঙ্গিদের সঙ্গে লড়াইয়ে নিহত হলেন ১৯৯৫ সালের কমনওয়েলথ শ্যুটিং প্রতিযোগিতায় সোনা ও রূপোর পদকজয়ী প্রাক্তন সুবেদার মেজর ফতে সিংহ। একান্ন বছরের ফতে বায়ুসেনার সুরক্ষা বাহিনী ডিফেন্স সিকিউরিটি কোরে কর্মরত ছিলেন। ২০০৯ সালে তিনি অবসর নন। তার পরে ডিফেন্স সিকিউরিটি কোরে যোগ দেন বলে সূত্রের খবর। বছর দু’য়েক আগেই তিনি পাঠানকোটে পোস্টিং পান। জাতীয় রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ‘‘বিগ বোর শ্যুটিংয়ে বিশেষ দক্ষ ছিলেন ফতে সিংহ।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

MostReadStories
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE