Advertisement
০৩ মে ২০২৪

স্কুটারে গিয়েছে মোষ! ওটাই ক্লু ‘বিশ্বাসদা’র

তদন্ত শেষ হয়েছে বহুদিন আগে। এর মধ্যে চাকরিজীবন শেষ করে রাজনীতিতে এসেছেন তিনি, মন্ত্রীও হয়েছেন। কিন্তু শনিবার পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির দেওঘর ট্রেজারি মামলায় লালু প্রসাদের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার খবর টিভির পর্দায় দেখতে দেখতে প্রাক্তন সিবিআই কর্তা উপেন বিশ্বাস বারবার ফিরে যাচ্ছিলেন পুরনো স্মৃতিতে।

উপেন বিশ্বাস

উপেন বিশ্বাস

সোমনাথ চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৩:৫৮
Share: Save:

ফোনের ও-পারে পরিষ্কার বাংলা শুনে কিছুটা অবাকই হয়েছিলেন তিনি। ‘‘বিশ্বাসদা, নমস্কার নেবেন। আমি লালু প্রসাদ। আপনি আমার অফিসে আসুন, এখানেই কথা বলব।’’ সেই ‘কথা’ অবশ্য অফিসে হয়নি। মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন, কলকাতা, দিল্লি— এক-একটা জায়গার নাম তুলে ঘোরাতে ঘোরাতে শেষমেশ দানাপুরের কাছে ওয়ালমোর বনবাংলোয় সিবিআইয়ের তদন্তকারীদের মুখোমুখি বসেছিলেন তৎকালীন বিহারের দাপুটে মুখ্যমন্ত্রী।

তদন্ত শেষ হয়েছে বহুদিন আগে। এর মধ্যে চাকরিজীবন শেষ করে রাজনীতিতে এসেছেন তিনি, মন্ত্রীও হয়েছেন। কিন্তু শনিবার পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির দেওঘর ট্রেজারি মামলায় লালু প্রসাদের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার খবর টিভির পর্দায় দেখতে দেখতে প্রাক্তন সিবিআই কর্তা উপেন বিশ্বাস বারবার ফিরে যাচ্ছিলেন পুরনো স্মৃতিতে। বলছিলেন, ‘‘তদন্তের গোড়ায় এক দিন মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদকে জেরা করার সময় ও জায়গা জানার জন্য তাঁর প্রধান সচিবকে ফোন করেছিলাম। সচিব ১৫ মিনিট সময় চেয়েছিলেন। কিন্তু পাঁচ মিনিট পরেই দেখি লালুজির ওই ফোন— ‘বিশ্বাসদা’...।’’

১৯৯৩ সালে অবিভক্ত বিহারের বিভিন্ন জেলায় গবাদি পশু ও পশুখাদ্য বণ্টনের প্রকল্প নিয়েছিল লালুর সরকার। অভিযোগ ওঠে, কোনও গবাদি পশু ও পশুখাদ্য কেনেনি সরকার। অথচ, কোষাগার থেকে প্রায় ১০০০ কোটি টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। মূলত এই অভিযোগে ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে একটি জনস্বার্থ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তদন্ত শুরু করে সিবিআই।

আরও পড়ুন: দোষী সাব্যস্ত হলেও লালু-সঙ্গ ছাড়বে না কংগ্রেস

এ দিন রাতে সল্টলেকে নিজের বাড়িতে বসে উপেনবাবু শোনালেন, কী ভাবে সরকারি নথি ঘেঁটে কেলেঙ্কারির হদিস পাওয়া গিয়েছিল। তদন্তের শুরুতে সরকারি ‘চালান’ পরীক্ষা করা হচ্ছিল। তখনই নজরে আসে, কোথাও পুলিশের গাড়িতে গিয়েছে টন টন পশুখাদ্য! কোথাও একটি স্কুটারে চাপিয়ে পাঠানো হয়েছে দু’টি মোষকে! চালানে লেখা গাড়ির নম্বর অন্তত তা-ই বলছে।

• ১৯৮৫: বিহারের ট্রেজারি ও বিভিন্ন দফতরে অনিয়ম চিহ্নিত করেন তৎকালীন সিএজি টি এন চতুর্বেদী। দশ বছর পরে সেই সূত্রেই সামনে আসে পশুখাদ্য কেলেঙ্কারি

• জানুয়ারি, ১৯৯৬: পশুপালন দফতরের লেনদেন খতিয়ে দেখতে জেলাশাসকদের নির্দেশ অবিভক্ত বিহারের অর্থসচিবের। পশ্চিম সিংভূমে নথি আটক

• মার্চ, ১৯৯৬: সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিল পটনা হাইকোর্ট। তা বহাল সুপ্রিম কোর্টেও

• ২৭ মার্চ, ১৯৯৬: প্রথম এফআইআর সিবিআইয়ের। মোট মামলা ৬৪টি

• ২৩ জুন, ১৯৯৭: তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ-সহ ৫৫ জনের নামে সিবিআই চার্জশিট

• ২৫ জুলাই, ১৯৯৭: লালুকে গ্রেফতার করতে আধা সেনা দিয়ে বাড়ি ঘিরলেন সিবিআইয়ের যুগ্ম অধিকর্তা উপেন বিশ্বাস। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গ্রেফতারি এড়ালেও মুখ্যমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিলেন লালু। গদিতে রাবড়ী

• ৩০ জুলাই, ১৯৯৭: সিবিআই আদালতে আত্মসমর্পণ করে জেলে লালু। ১৩৫ দিন পরে জামিন

• ৫ অক্টোবর, ২০০১: ঝাড়খণ্ড আলাদা রাজ্য হওয়ায় সব মামলা রাঁচীতে স্থানান্তর করল সুপ্রিম কোর্ট

• জুন, ২০০৭: চাইবাসা ট্রেজারির একটি মামলায় সিবিআই আদালতে লালুর দুই ভাইপো-সহ ৫৮ জনের সাজা

• মার্চ, ২০১২: বাঁকা ও ভাগলপুর জেলা ট্রেজারি থেকে অবৈধ ভাবে ৪৭ লক্ষ টাকা তোলার অপরাধে লালু ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জগন্নাথ মিশ্রের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন

• ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩: চাইবাসা ট্রেজারির একটি মামলায় লালু, জগন্নাথ-সহ ৪৫ জনকে দোষী সাব্যস্ত করল সিবিআই আদালত। পাঁচ বছর কারাদণ্ড লালুর। খোয়ালেন সাংসদ পদ

• ডিসেম্বর ২০১৪: সুপ্রিম কোর্টে জামিন লালুর

• ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৭: দেওঘর ট্রেজারি থেকে ৮৫ কোটি টাকা তছরুপের মামলায় জগন্নাথ বেকসুর খালাস। দোষী সাব্যস্ত লালু। সাজা ঘোষণা ৩ জানুয়ারি

এটাই ছিল তদন্তের প্রথম ‘ক্লু’!

অবসরপ্রাপ্ত সিবিআই কর্তার স্মৃতি বলছে, এই প্রকল্পের প্রধান ঠিকাদারকে ভুয়ো নথি তৈরির দায়িত্ব দিয়েছিলেন সরকারি কর্তারা। ঠিকাদার তাঁর এক কর্মীকে পাঠান বিভিন্ন গাড়ির নম্বর জোগাড় করতে। তদন্তে জানা যায়, ঠিকাদারের ওই কর্মী জি টি রোডে গিয়ে সামনে যে গা়ড়ি পেয়েছিলেন, তারই নম্বর টুকে এনে চালান তৈরি করেছিলেন। সম্ভবত সে ভাবেই মোষ নিয়ে যাওয়ার চালানে চোখ বুজে বসিয়ে দেওয়া হয় স্কুটারের নম্বর! এই সমস্ত চালান দেখিয়ে সরকারি কোষাগার থেকে হাজার কোটি টাকা গায়েব করা হয়েছিল। এবং অভিযোগ, সবই হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদের নির্দেশে।

জেরা-পর্বের কথা বলতে গিয়ে এ দিন মাঝেমাঝে হেসেও ওঠেন তদন্তকারী দলের প্রধান উপেনবাবু। তাঁর দাবি, জেরার সময়ে সিবিআই মারধর করবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন লালু। সিবিআইয়ের তৎকালীন ডিআইজি (সারদা কেলেঙ্কারির সময়ে সিবিআইয়ের ডিরেক্টর) রঞ্জিত সিন্হার কাছে সে কথা বলেও ফেলেছিলেন। দানাপুরের বাংলোয় হাজিরা দিতে সঙ্গে এনেছিলেন মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের ডিজি-র মতো হোমরা-চোমরা কর্তাদের। জেরা-পর্বে মাঝেমধ্যে সিঁটিয়েও যাচ্ছিলেন!

তদন্ত যত এগোচ্ছিল, ততই খুলছিল কেলেঙ্কারির পর্দা। উপেনবাবু জানান, এই তদন্ত নিয়ে এগোলে সমস্যা হতে পারে বলে ঠারেঠোরে তাঁকে হুমকি দিয়েছিল সিবিআইয়েরই একাংশ! হঠাৎ অবসর নিতেও বলা হয় তাঁকে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত উপেনবাবুকে কাজে বহাল রাখার নির্দেশ দেয়। সেই মতো এক বছর ‘এক্সটেনশন’ পান তিনি। তখন তাঁর পাশে দাঁড়ান সিবিআইয়ের তৎকালীন প্রধান যোগিন্দর সিংহ। তার পর আর পিছনে ফিরে তাকাননি দুঁদে গোয়েন্দাকর্তা। নিজের কাজের মেয়াদ শেষের আগেই, ২০০২ সালে চার্জশিট পেশ করেন আদালতে।

বাকিটা ইতিহাস...।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE