বিজয়কুমার মলহোত্র
পশ্চিমবঙ্গের রাজভবনে পরবর্তী বাসিন্দা হতে চলেছেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা দিল্লির বিজেপি নেতা বিজয়কুমার মলহোত্র।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন করে আজ রাজ্যপাল পদে মলহোত্রের নাম জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। মমতা অবশ্য আপত্তি জানিয়ে বলেন, এ ভাবে নাম চূড়ান্ত করে তাঁকে জানানোটা মোটেই যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের লক্ষণ নয়। রাজনাথ তখন তাঁকে বলেন, কেন্দ্র মলহোত্রের নাম চূড়ান্ত করেনি। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করার জন্যই তিনি ফোন করেছেন। মলহোত্রের ব্যাপারে মমতার আপত্তি থাকলে উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন স্পিকার কেশরীনাথ ত্রিপাঠীকেও রাজ্যপাল করে পাঠানো যেতে পারে।
মমতা তখন বলেন, সেটাও তো আর একটা নাম ঠিক করে তাঁর কাছে পেশ করা হল। রাজ্যপাল পদে কাকে নিয়োগ করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করা হল না। এটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নয়। তিনি যে সংবিধান মেনে চলতে চান, সে কথাও রাজনাথকে জানিয়েছেন মমতা। বলেছেন, কেন্দ্র যাঁকে রাজ্যপাল হিসেবে পাঠাবে, তাঁকেই মেনে নেবেন তিনি। এ ব্যাপারে তিনি নিজের মতও জানাচ্ছেন না, আবার কেন্দ্রের দেওয়া নামের বিরোধিতাও করছেন না। রাজনাথ-মমতা এই বাক্যালাপের পরে মলহোত্রের কলকাতা গমন এক প্রকার নিশ্চিত বলেই মনে করা হচ্ছে।
এম কে নারায়ণন ইস্তফা দেওয়ার পর থেকেই কল্যাণ সিংহকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল করা হতে পারে বলে জল্পনা শুরু হয়েছিল বিভিন্ন মহলে। বলা হচ্ছিল, কল্যাণকে রাজ্যপাল করতে চান সঙ্ঘ পরিবারের একাংশ। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময় উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকা কল্যাণের বিরুদ্ধে সরব হয় রাজ্যের ডান-বাম সব পক্ষই। বিধানসভায় এ ব্যাপারে প্রস্তাব আনতে চান বামেরা। কল্যাণকে রাজ্যপাল করা হলে আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্তও নেয় বামফ্রন্ট। কল্যাণের ব্যাপারে তীব্র আপত্তি ছিল শাসক দল তৃণমূলেরও।
রাজনাথ অবশ্য আজ মমতাকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, কল্যাণকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল করার কোনও অভিপ্রায় কেন্দ্রের নেই। আসলে উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে রাজনাথের সঙ্গে কল্যাণের বিবাদ সুবিদিত। রাজনাথ এখন চাইছেন, কল্যাণকে লখনউয়ের রাজনীতি থেকে সরিয়ে রাজ্যপাল পদে ঠেলে দিতে। কিন্তু ৮২ বছরের দলিত নেতাটি অবসর জীবনে যেতে নারাজ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে সে কথা জানিয়েও দিয়েছেন তিনি। আর ঘনিষ্ঠ মহলে কল্যাণ বলেছেন, রাজ্যপাল হলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে রাজনাথ তাঁর ‘বস’ হবেন। রাজনাথের ‘অধীনে’ কাজ করতে তিনি নারাজ।
কল্যাণ বেঁকে বসার পরে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল পদে নতুন নাম নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে। উঠে আসে মলহোত্র এবং ত্রিপাঠীর নাম। দক্ষিণ দিল্লির প্রাক্তন সাংসদ বিজয় মলহোত্র এক সময় সংসদে উপ-বিরোধী দলনেতা ছিলেন। কিন্তু ২০০৯-এর ভোটে অজয় মাকেনের কাছে হেরে যান। এ বার তিনি আর প্রার্থী হননি। ৮২ বছরের মলহোত্রের মতো ৮০ বছর বয়সী কেশরীনাথ ত্রিপাঠীরও পুনর্বাসনে ব্যস্ত রাজনাথ। মায়াবতীর রাজত্বে স্পিকার হওয়া এই ব্রাহ্মণ নেতা সঙ্ঘ পরিবারের ঘনিষ্ঠ।
এই দু’জনের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের জন্য মলহোত্রই যে রাজনাথের প্রথম পছন্দ, সেটা নিজস্ব সূত্রে আগেই জানতে পেরেছিলেন মমতা। আজ সকাল থেকেই রাজ্যপাল নিয়োগ নিয়ে মমতার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলেন রাজনাথ। অন্যান্য শনিবার নবান্নে গেলেও আজ তাঁর প্রিন্সিপ্যাল সচিব গৌতম সান্যাল ব্যক্তিগত কাজে ছুটি নেওয়ায় কালীঘাটে নিজের বাড়িতে বসেই ফাইল দেখছিলেন মমতা। ফলে রাজনাথ নবান্নে ফোন করে তাঁকে পাননি। সেই খবর পেয়ে মমতা নিজেই বার ছয়েক চেষ্টা করেন রাজনাথকে ফোনে ধরতে। কিন্তু তখন আবার রাজনাথ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। শেষ পর্যন্ত মমতাকে মোবাইলে ফোন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
রাজ্যপাল পদে মলহোত্রের নাম বলামাত্র মমতা রাজনাথকে বলেন, তিনি নিজস্ব সূত্রে আগেই সে কথা জেনে গিয়েছেন। তার মানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে তবেই ফোন করেছেন রাজনাথ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন মমতাকে বলেন, সেটা ঠিক নয়। তিনি আলোচনা করার জন্যই ফোন করেছেন। এই সময়ই বিকল্প হিসেবে ত্রিপাঠীর নাম বলেন তিনি। কেন্দ্রের ভূমিকায় খুশি না হলেও বাজপেয়ী মন্ত্রিসভায় তাঁর সতীর্থ মলহোত্রের নাম নিয়ে মমতা আপত্তি করেননি বলেই খবর।
রাজ্যপাল নিয়োগ নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাতের ইতিহাস দীর্ঘ। লালকৃষ্ণ আডবাণী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় বিনোদ পাণ্ডেকে বিহারের রাজ্যপাল করে পাঠানো হয়েছিল। তখন শুধু তাঁর নামটিই তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী রাবড়ীদেবীকে জানিয়েছিল কেন্দ্র। রাবড়ীদেবী তীব্র ভাষায় আপত্তি করেন। আডবাণীর বক্তব্য, সংবিধানে রাজ্যপাল নিয়োগের প্রশ্নে রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনার কথা বলা হলেও সম্মতি গ্রহণের শর্ত নেই।
টি ভি রাজেশ্বরের মতো প্রাক্তন গোয়েন্দা কর্তা বা এ আর কিদোয়াইয়ের মতো রাজনীতিককে রাজ্যপাল করে পাঠানো নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে সংঘাত হয়েছিল জ্যোতি বসুর। কিন্তু তাঁর আপত্তি গ্রাহ্য করা হয়নি। ইউপিএ সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও মমতার দাবি মেনে গোপালকৃষ্ণ গাঁধীকে আরও এক দফা রাজ্যপাল করেননি মনমোহন সিংহ। তার বদলে পাঠিয়েছিলেন এম কে নারায়ণনকে।
এই প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে মমতার সম্পর্ক ছিল অম্লমধুর। মুখ্যসচিব-সহ পদস্থ আমলাদের ঘনঘন রাজভবনে ডেকে পাঠানোটা ভাল চোখে দেখেননি তিনি। তাঁর এক মন্ত্রী তো প্রকাশ্যেই ‘হলুদ কার্ড’ দেখিয়েছিলেন নারায়ণনকে।
কিন্তু যে ভাবে চাপ দিয়ে নারায়ণনকে সরালো মোদী সরকার, সেটাও মমতার অপছন্দ। কিন্তু এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করেননি তিনি। এর পর মুখ্যমন্ত্রীকে আগাম না জানিয়েই বিহারের রাজ্যপাল ডি ওয়াই পাটিলকে এ রাজ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয় কেন্দ্র। তা নিয়ে ক্ষুব্ধ হলেও সংবিধান মেনে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন মমতা। সে জন্য পাল্টে নিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির সঙ্গে বৈঠকের সময়।
এ বার বিজয়কুমার মলহোত্রের নিয়োগ পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি থাকলেও সংবিধান মেনেই চলবেন মুখ্যমন্ত্রী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy