Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

আলোর ছটায় সুমেরুপ্রভায়

মেরুজ্যোতি বা মেরুপ্রভার সঙ্গে সেই ছোটবেলা থেকেই পরিচয় ছিল। যাঁরা সে দৃশ্য দেখেছেন, পরের দিকে তাঁদের মুগ্ধতাই আমার মনে আস্তে আস্তে আলোর খেলা দেখার সেই ইচ্ছেটাকে চারিয়ে দিয়েছে। মেরু বলয়ের মধ্যে সুমেরুর খুব কাছাকাছি জায়গা থেকেই মেরুজ্যোতি দেখা যায়। কানাডার উত্তর-পশ্চিমের ইয়েলোনাইফ তেমনই একটি শহর। যেখান থেকে সুমেরুপ্রভা (অরোরা বোরিয়ালিস বা নর্দান লাইটস) ভাল ভাবে দেখা যায়। স্ত্রী শিপ্রাকে নিয়ে তাই রওনা দিলাম ইয়েলোনাইফ।

রঞ্জন নিয়োগী
শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:২৫
Share: Save:

মেরুজ্যোতি বা মেরুপ্রভার সঙ্গে সেই ছোটবেলা থেকেই পরিচয় ছিল। যাঁরা সে দৃশ্য দেখেছেন, পরের দিকে তাঁদের মুগ্ধতাই আমার মনে আস্তে আস্তে আলোর খেলা দেখার সেই ইচ্ছেটাকে চারিয়ে দিয়েছে। মেরু বলয়ের মধ্যে সুমেরুর খুব কাছাকাছি জায়গা থেকেই মেরুজ্যোতি দেখা যায়। কানাডার উত্তর-পশ্চিমের ইয়েলোনাইফ তেমনই একটি শহর। যেখান থেকে সুমেরুপ্রভা (অরোরা বোরিয়ালিস বা নর্দান লাইটস) ভাল ভাবে দেখা যায়। স্ত্রী শিপ্রাকে নিয়ে তাই রওনা দিলাম ইয়েলোনাইফ।

কলকাতা থেকে ইয়েলোনাইফ যাওয়াটা বেশ ঝকমারির। ইন্টারনেট গবেষণায় জেনেছিলাম, কানাডার ক্যালগেরি বা এডমন্টন শহরে পৌঁছতে পারলে সেখান থেকে ইয়েলোনাইফ যাওয়াটা সহজতর। কিন্তু, শুরুতেই বিপত্তি। দিল্লি থেকে ফ্র্যাঙ্কফুর্টের বিমান ধরতে গিয়ে জানলাম, লুফৎহানসার কর্মীরা কর্মবিরতি পালন করছেন। তাই বিশ্বজুড়ে তাদের উড়ান অচল। শেষে অন্য বিমানে শিকাগো হয়ে ক্যালগেরি, সেখান থেকে ফের বিমান পাল্টে আমরা ইয়েলোনাইফ পৌঁছলাম। কিন্তু, শীতের পোশাক সমেত আমাদের দু’টো স্যুটকেসের একটিও তখনও পৌছয়নি। সে এক অভাবনীয় অবস্থা!

ইয়েলোনাইফ পৌঁছলাম যখন, রাত তখন প্রায় ১০টা। অত রাতেও আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন মার্গারেট। ৬৫ বছরের এই মহিলা মেরুজ্যোতি দর্শন করাবেন আমাদের। এক্সপ্লোরার্স গাইড দেখে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ। স্যুটকেস আসেনি শুনে, দুঃশ্চিন্তা করতে বারণ করলেন। তার পর নিজের গাড়িতে করেই আমাদের হোটেলে পৌঁছে দিলেন। বিদায় নেওয়ার আগে জানিয়ে গেলেন, আগামী কাল রাতেই আমরা জ্যোতি দর্শনে বেরোব।

সকালে ঘুম তো ভাঙল। কিন্তু ঠান্ডার দাপটে টিকে থাকা মুশকিল। মাইনাস ২৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা। ও দিকে স্যুটকেসের কোনও পাত্তা নেই। সারা দিন ঘুমিয়ে-বসে হোটেলের ঘরেই কেটে গেল। আধ ঘণ্টা অন্তর ইউনাইটেড এয়ার এবং এয়ার কানাডার অফিসে ফোন করে গেলাম। কোনও লাভ হল না। এরই মধ্যে মার্গারেট তিন বার ফোন করে আমাদের খবর নিলেন। স্যুটকেস আসেনি শুনে ট্যাগ নম্বর জেনে নিয়ে বললেন, উনি নিজে বিমানবন্দরে গিয়ে খোঁজ নেবেন। রাত তখন আটটা। ফের ওই অফিস দু’টিতে ফোন করলাম। স্যুটকেসের কোনও হদিশ মিলল না। শেষে বিরক্ত হয়ে মেরুপ্রভা দর্শনের জন্য তৈরি হচ্ছি। পৌনে ৯টা নাগাদ হোটেলের লবি থেকে মার্গারেট ফোন করে জানালেন, তিন বার বিমানবন্দর গিয়ে তিনিই শেষমেশ আমাদের স্যুটকেস উদ্ধার করে নিয়ে এসেছেন। যাক বাবা, বাঁচলাম! শীতের দাপট থেকে।

চটপট প্রয়োজনীয় সব গায়ে চাপিয়ে আমরা তৈরি। সাড়ে ৯টায় যাত্রা শুরু। মেরুপ্রভা দেখতে কয়েকটি শর্তের প্রয়োজন। প্রথমত, মেরু বলয়ের মধ্যে সুমেরুর খুব কাছাকাছি জায়গা থেকে মেরুজ্যোতি দেখতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রচণ্ড শীতের রাত হতে হবে। তৃতীয়ত, অন্ধকার যত বাড়বে আলোর বিচ্ছুরণ খালি চোখে তত বেশি দেখা যাবে। চতুর্থত, যে সময়ে দেখতে যাওয়া হবে, সেই সময়ে বা তার কাছাকাছি সময়ে সৌর ঝড় হওয়া বাঞ্ছনীয়। যত মেরু অঞ্চলের কাছকাছি পৌঁছনো যাবে, ততই এই ঝড়ের প্রভাব বেশি। এবং সর্বোপরি, আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার হতে হবে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ বা বরফ পড়লেই সব মাটি। সুমেরুর মতো পৃথিবীর দক্ষিণার্ধের কুমেরু অঞ্চল থেকেও মেরুপ্রভা দেখা যায়। সবচেয়ে ভাল দেখা যায় অবশ্য আন্টার্কটিকা ভূখণ্ড থেকে। তা ছাড়া অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আমেরিকার কিছু জায়গা থেকে এই মেরুজ্যোতি দেখা যায়। সুমেরু অঞ্চলে দেখতে পাওয়া মেরুজ্যোতিকে অরোরা বোরিয়ালিস বা নর্দান লাইটস বলে। আর কুমেরু অঞ্চল থেকে দেখতে পাওয়া এই মায়াবী আলোকে অরোরা অস্ট্রালিস বা সার্দান লাইটস বলে।

ইয়েলোনাইফ শহরের কিছুটা বাইরে ক্যাসিডি পয়েন্ট পার হয়ে একটি লগ কেবিনে পৌঁছলাম। লগ কেবিনটি মার্গারেটের বন্ধু ও ব্যবসার অংশীদার মারে ম্যাকমোহনের নিজের হাতে তৈরি। সৌর বিদ্যুতে আলোর ব্যবস্থা এবং প্রপেন গ্যাসে ঘরটি গরম রাখা হয়। অত্যন্ত আরামদায়ক পরিবেশ। এর সঙ্গে জুড়ে গেল মার্গারেট ও মারের আন্তরিক ও সহৃদয় ব্যবহার। এতটা দূর থেকে এসেছি, আমাদের যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, দু’জনেরই সে দিকে সর্বদা নজর। নিজেদের ভাঁড়ার থেকে শীত নিরোধক জুতো, মোজা, দস্তানা, টুপি এবং পার্কা ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই।

যাত্রা পথে চার থেকে আট ফুট গভীর বরফ জমা গ্রেট স্লেভ লেকের উপর দিয়ে মার্গারেট গাড়ি চালাল অতি সাবধানে। রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। লগ কেবিনের সামনে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে লেক। গরম কালে নৌকাবিহার, মাছ শিকার-সহ বিভিন্ন বিনোদনে লেকটি গমগম করে নাকি। মার্চের শেষে হিমাঙ্কের নীচে সেই লেক সম্পূর্ণ বরফাচ্ছাদিত। ধারে কাছে আমরা ছাড়া আর কোনও প্রাণী নেই। সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ। হঠাৎ যা দেখলাম তাতে, কয়েকটি পঙক্তি মনে এল, আহা কী দেখিলাম নয়ন জুড়ে/ হৃদয় ভরে/ রঙের খেলা আকাশ জুড়ে! হাড় হিম করা ঠান্ডায়, কয়েক স্তর শীতপোশাক চাপিয়ে, মার্গারেটের দেওয়া ব্যাটারিচালিত গ্লাভস পরে তখন শুধুই রঙের খেলায় মুগ্ধ হওয়ার পালা! আহা কী দেখছি! নির্মেঘ ঝকঝকে আকাশে লক্ষ-কোটি তারার ঔজ্জ্বল্য। তারই মাঝে কখনও ক্ষীণ, কখনও উজ্জ্বল, কখনও আরও উজ্জ্বল বর্ণচ্ছটা। কখনও সবুজ, তো কখনও খয়েরি, কখনও বা লাল রঙে নানা আকারের মেরুপ্রভার খেলা চলছে। সব সময় নয়। হয়তো আধ ঘণ্টা বর্ণচ্ছটা দেখলাম, তার পর ফের মিনিট ১৫-২০ চুপচাপ। তখন শুধুই আকাশ জুড়ে তারার ঝলমলানি। এই সময়ে লগ কেবিনের ভেতরে গিয়ে স্টোভে হাত-পা সেঁকে নিয়ে মার্গারেটের সৌজন্যে কফি-কেক-গরম চকোলেট-আপেল সাইডার খেয়ে আসছি।

আমরা ছাড়াও আরও দু’জন মেরুপ্রভা দর্শনার্থী ছিলেন। কাজেই আমরা দলে মোট ৬ জন। কেউ না কেউ পালা করে বাইরে গিয়ে দেখে আসছি, আকাশে নতুন করে বর্ণচ্ছটা হচ্ছে কিনা! পাঁচ ঘণ্টার দর্শনকাল। আমি মোটামুটি তিন-চার ঘণ্টা বাইরেই কাটিয়ে দিলাম। গায়ে এত গরম পোশাক যে, নাক-চোখ ছাড়া অন্য কোথাও ঠান্ডা লাগার উপায় নেই। মুশকিল একটাই, গোঁফে মাঝে মাঝে বরফ লেগে যাচ্ছে। প্রায় এক মিলিমিটার ব্যাসের ছোট ছোট বরফের বল গোঁফ থেকে ছাড়ানো বেশ বেদনাদায়ক। রঙিন আলোর ছটা দেখে হোটেলে ফিরলাম। মন তখন ভরে রয়েছে।

একই সময়ে তার পরের দু’দিনও আমরা গিয়েছিলাম মার্গারেটের সঙ্গে। সঙ্গীরাও এক। ছ’জনের টিম। সেই লগ কেবিন। সেই মার্গারেটের গাড়ি। সেই কফি-চকোলেট-আপেল। সেই রং-আলোর খেলা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা হিমাঙ্কের ৩৫ ডিগ্রি নীচের ঠান্ডা সহ্য করে ছবি তুলে গিয়েছি, প্রতি দিন। তবে আফশোষও ছিল। অতিপার্থিব আলোগুলি আপন ঢঙে যখন হাওয়ায় ওড়া পর্দার মতো উড়ছে, এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে ছুটে যাচ্ছে, কখনও একই জায়গায় পাকের পর পাক দিচ্ছে, তখন তাদের এই বর্ণময় গতি-উচ্ছ্বলতাকে আমি ক্যামেরাবন্দি করতে পারিনি।

তিন দিনের মধ্যে উজ্জ্বলতার নিরিখে মেরুপ্রভা সবচেয়ে সুন্দর দেখা গিয়েছে দ্বিতীয় দিন। কিন্তু বর্ণচ্ছটার স্পন্দন, শিহরণ ও দোলনের নিরিখে শেষের দিনটি ছিল অনবদ্য। ওই রাতে, পৌনে দু’টোয় আকাশ ছিল শুনশান। মন না চাইলেও হোটেলে ফেরার তাড়া তত ক্ষণে টোকা মারছে মগজে। হাত-পা সেঁকে, কফি-হট চকোলেট খেয়ে, ক্যামেরা গুছিয়ে, ট্রাইপড গুটিয়ে বাইরে বেরিয়েছি সবে। হঠাৎই চোখে পড়ল, গোটা আকাশ জুড়ে বিশাল এক ডিম্বাকার ত্রিমাত্রিক উপবৃত্তে চমকপ্রদ রঙের খেলা। কখনও বাঁ দিকের আলোগুলো ধাওয়া করছে ডান দিকেরগুলোকে। কিছু ক্ষণ পরেই পুরো বিষয়টা উল্টে গিয়ে ডান দিকের আলোগুলো ছুটছে বাঁ দিকের আলোর পানে। ঠিক যেন পিয়ানোয় সুর তুলে রিড চেপে ডান থেকে বাঁয়ে আবার বাঁ থেকে ডান দিকে যাচ্ছে তারা। মিনিট কুড়ি ধরে চলল এই বর্ণময় গতির খেলা। কিছু ক্ষণ পর আকাশ ফের আলোহীন। শুধু উজ্জ্বল তারাদের উপস্থিতি। এ যেন ঘরে ফেরার আগে বিদায় সম্ভাষণ!

ছবি: লেখক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

aurora borealis ranjan niyogi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE