আমাদের মগজের ‘রামদনু’র খেলা!
আমাদের ব্রেন মানে মগজও রং বদলায়! রাগে, দুঃখে, বিস্ময়ে, অভিমানে। লাল থেকে কমলা, হলুদ থেকে সবুজ বা বেগুনি রঙে বদলে বদলে যায় আমাদের মগজের কোনও কোনও এলাকার রং! কোনওটা হয়ে যায় ‘রেড ফোর্ট’ তো কোনওটা হয়ে ওঠে ‘গ্রিন ল্যান্ড’!
রামধনুর যেমন রয়েছে সাত-সাতটি রং আর সাতটি রং মিলেমিশে গিয়ে যেমন জন্ম হয় দৃশ্যমান আলোর, সা রে গা মা পা’র সপ্তসুর যে ভাবে গড়ে তোলে গানের ‘শরীর’, তেমনই সাতটি রঙে জেগে ওঠে আমাদের মগজে থাকা সাত-সাতটি অনুভূতি। ইমোশন্স। রাগে মগজের এক অংশে যদি ছোপ লাগে লাল রঙের, তা হলে দুঃখে মগজের অন্য একটি অংশ রঙিন হয়ে ওঠে কমলা রঙে। বিস্ময়ে আরও একটি অংশ হয়ে ওঠে সবুজ। আমাদের মগজও রং বদলে বদলে চলে। রং বদলের ‘পাশা’ খেলে, জীবনভর।
আমাদের মগজের ঘাপটি মেরে থাকা সেই সাতটি অনুভূতির এলাকাগুলোর রঙিন মানচিত্র বানানো সম্ভব হল এই প্রথম। যা এর আগে কোনও দিন সম্ভব হয়নি, সেই ‘অসাধ্যসাধন’টি করেছেন ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি ও নিউরো-সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক কেভিন লাবারের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক গবেষকদল। গবেষণাপত্রটির শিরোনাম- ‘ডিকোডিং স্পন্টানিয়াস ইমোশনাল স্টেটস ইন দ্য হিউম্যান ব্রেন’। সেটি ছাপা হয়েছে বিখ্যাত বিজ্ঞান-জার্নাল ‘প্লস বায়োলজি’র ১৪ সেপ্টেম্বর সংখ্যায়।
মগজের ‘সন্তুষ্টি’র রং (কালচে লাল)
হালের এই গবেষণাটির অভিনবত্ব কোথায়?
সহযোগী গবেষক আমেরিকার ন্যাশভিলে ভ্যানডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর রফিউদ্দিন আহমেদ ই-মেলে আনন্দবাজারকে বলেছেন, ‘‘আমরা যখন একা একা অবসর সময় কাটাই, একটু নিরালা, নির্জনে, তখন হঠাৎ করেই কোলাজের মতো আমাদের মনে পড়তে শুরু করে দেয় নানা রকমের সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্নার ‘হিরে-পান্না’র মূহুর্ত। মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরনোর পর কী আনন্দে নিজের হাতে পায়েস রেঁধে খাইয়েছিলেন ঠাকুমা। কলেজ যাওয়ার পথে টিকিট নিয়ে কন্ডাক্টরের সঙ্গে বচসার কথা। আর শ্রাবণের এক সন্ধ্যায় কলেজের সেই ‘ফার্স্ট লাভ’-এর সঙ্গে সম্পর্কটা ভেঙে যাওয়ার সন্ধ্যাটা। ওই সব অনুভূতির স্মৃতিগুলি মগজের কোন কোন এলাকায় জমা থাকে, এমআরআই স্ক্যান করে এখন সে সব আমরা দেখতে পারব সহজেই। এটা অনেকটা মাইন্ড রিডিং-এর মতো। এমআরআই মেশিনে তোলা ছবি দেখেই আমরা বলে দিতে পারব, অমুকে কতটা রেগেছেন বা তমুকে কতটা ভয় পেয়েছেন। কারণ, এমআরআই স্ক্যানের ছবিই এ বার আমাদের দেখিয়ে দিতে পেরেছে, মগজের ঠিক কোথায় কোথায় ভয়ের জন্ম হয়। আমি, আপনি রেগে গেলে মগজের কোন কোন এলাকা বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে, তা কোন রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নেয়, এই প্রথম আমাদের গবেষণায় তা দেখানো সম্ভব হয়েছে। আমরা খুব স্পষ্ট ভাবে দেখাতে পেরেছি, আমাদের কোন কোন অনুভূতির সময় মগজের কোন কোন এলাকাগুলি ‘সচেতন’ (কনশাস) হয়ে ওঠে আর কোন কোন অঞ্চলগুলি হয়ে থাকে ‘অসচেতন’ (আন-কনশাস)।’’
মগজের ‘আনন্দানুভূতি’র রং (হলুদ বা হালকা হলুদ)
মগজের ‘বিস্ময়ে’র রং (সবুজ)। চমকে যাওয়ার রং
মগজের ‘ভয়ে’র রং (হালকা সবুজ)। এলাকাও বদলে গিয়েছে
মগজের ‘রাগে’র রং (হালকা সবুজ)। এলাকাও বদলে গিয়েছে
আমাদের সেই সাতটি অনুভূতি কী কী?
আমেরিকার নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরো-সায়েন্সের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর বুলা ঝা ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, সাধারণত সাতটি মৌলিক অনুভূতি ঘাপটি মেরে থাকে আমাদের মগজের অন্তরে-অন্দরে। সেগুলির মধ্যে রয়েছে: সন্তুষ্টি (কনটেন্টমেন্ট), আনন্দানুভূতি (অ্যামিউজমেন্ট), বিস্ময় (সারপ্রাইজ), ভয় (ফিয়ার), রাগ (অ্যাঙ্গার), দুঃখবোধ (স্যাডনেস) ও নিরপেক্ষতা (নিউট্রালিটি)। সাতটি রং মিলেমিশে গিয়ে যেমন দৃশ্যমান আলোর জন্ম দেয়, রামধনুর মধ্যে থাকে যেমন সাত-সাতটি রং (ভিবজিওর) আর, সা রে গা মা পা...এই সপ্তসুর মিলেমিশে গিয়ে যেমন গড়ে তোলে গানের ‘শরীর’, ঠিক তেমন ভাবেই মগজে ঘাপটি মেরে থাকা সাত-সাতটি অনুভূতি মিলেমিশে গিয়ে আমাদের যাবতীয় অনুভূতির অবয়ব গড়ে তোলে। আর সবাইকে দিয়ে যেমন সব কাজ সমান ভাবে করানো যায় না, তেমনই মগজের সবক’টি অংশকে সাতটি অনুভূতিতেই ব্যবহার করা যায় না। আর সেটা মগজই সবচেয়ে ভাল ভাবে জানে, বোঝে। তাই আমাদের সাতটি অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমাদের মগজে আলাদা আলাদা এলাকা রয়েছে। সেই এলাকাগুলি রয়েছে আবার একটি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। মানে, ভূগোলে যেমন আফ্রিকা মহাদেশ বলতে একটি নিরবচ্ছিন্ন এলাকা বুঝি, মগজে অনুভূতির মানচিত্রে ঠিক সে রকম নিরবচ্ছিন্ন কোনও এলাকা থাকে না। তা বরং থাকে কিছুটা ছড়িয়ে, ছিটিয়ে। সেই এলাকাগুলোর কাজের স্বতস্ফূর্ততা বোঝার জন্য বাইরে থেকে কোনও রাসায়নিক বা স্টিম্যুলি ব্যবহার না করেই এলাকাগুলির কাজের ধরন-ধারণ বোঝার চেষ্টা করেছেন গবেষকরা। এটাই এই গবেষণার অভিনবত্ব।’’
‘দুঃখবোধে’র রং (বেগুনি)। এলাকাও বদলে গিয়েছে
কিন্তু এখানেই থেমে যেতে চান না গবেষকরা। চাইছেন কী গবেষকরা?
মগজের ‘নিরপেক্ষতা’র রং (গোলাপি)। এলাকাও বদলে গিয়েছে
সহযোগী গবেষক জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হর্ষ রঙ্গনাথন ই-মেলে আনন্দবাজারকে বলেছেন, ‘‘এক দিন যাতে আমাদের অনুভূতিগুলিকে বাইরে থেকে আমরা নিয়ন্ত্রণ বা ‘রেগুলেট’ করতে পারি, তার উপায় খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। ফলে চট করে যাঁর মাথা গরম হয়ে যায় বা যিনি সামান্য কিছুতেই ভয় পেয়ে রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেন, বাইরে থেকে ওযুধবিষুধ দিয়ে হয়তো এক দিন তাঁদের রাগ বা ভয়ের পরিমাণ কমানো সম্ভব হবে। তবে তার জন্য আমাদের আরও অনেকটা পথ যেতে হবে। মগজের কোন কোন এলাকায় কোন কোন অনুভূতি কত ক্ষণ পর্যন্ত সক্রিয় থাকে, তা কখন সক্রিয় হয়ে ওঠে, এক অনুভূতি থেকে কী ভাবে আমরা বদলে যাই অন্য অনুভূতিতে, কাঁদতে কাঁদতে যে ভাবে আমরা হেসে উঠি, হাসতে হাসতে হঠাৎ রেগে উঠি, মগজের সেই ‘রং বদলের খেলা’টা আমাদের আরও সূক্ষ্ণ ভাবে বুঝতে হবে।’’
ছবি সৌজন্যে : ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়।
আরও পড়ুন- বড় চমক মহাকাশে, ভোরে ঘন কুয়াশায় যেন জ্বলছে ল্যাম্পপোস্ট!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy