দরকার এখন ভারতে একটা নজরদার চোখ। যা ব্রহ্মাণ্ডকে দেখার ক্ষমতা এক লাফে পাঁচ গুণ বাড়িয়ে দেবে। ভারতে মহাকর্ষ-তরঙ্গ শনাক্ত করার যন্ত্র বসালে তবেই সম্ভব হবে সেটা। আর কাজটা সহজ হবে, নরেন্দ্র মোদীর সরকার এগিয়ে এলে।
গত কাল মার্কিন মুলুক থেকে মহাকর্ষ তরঙ্গ ধরার বার্তা আসার অনেক আগে থেকেই দেশের বিজ্ঞানীরা কনসর্টিয়াম (ইন্ডিয়ান ইনিসিয়েটিভ ইন গ্র্যভিটেশনাল-ওয়েভ অবজার্ভেশনস) গড়ে এমন যন্ত্র বসানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০১১-তে মনমোহন সিংহের জমানাতেই তাঁরা সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠান। ২০১২ সালে যোজনা কমিশনও তাতে সবুজ সঙ্কেত দেয়। কিন্তু এর পরে ভোট, সরকার বদল— এ সবের মধ্যে সরকারি স্তরে বিষয়টি আটকে যায় লাল ফিতের ফাঁসে। কিন্তু মার্কিন মুলুক থেকে কাল ওই তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণের কথা ঘোষণা হতেই বিশ্ব জুড়ে যে রকম হৈচৈ পড়ে গিয়েছে, তাতে সরকারের উপরেও এখন কিছুটা চাপ তৈরি হবে। বিশেষ করে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের অবদান নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী যে রকম গর্ব ও উৎসাহ প্রকাশ করে টুইট করেছেন, তা বিজ্ঞানী মহলেও আশার সঞ্চার করেছে। সরকারি সূত্রেও বলা হচ্ছে, মহাকর্ষ তরঙ্গ নিয়ে ভারতে নজরদার কেন্দ্র গড়ার বিষয়টি অদূর ভবিষ্যতেই সরকারি অনুমোদন ও সহায়তা পেতে পারে। ফলে এ দেশের বিজ্ঞানীদের নজর এখন মোদীর দিকেই।
কিন্তু প্রশ্ন হল, এত দেশ থাকতে ভারতেই এমন একটি কেন্দ্র গড়ার জন্য কেন এত উৎসাহ?
প্রশ্নটা উৎসাহের নয়, এটা জরুরি, জানাচ্ছেন ইন্টার ইউনির্ভাসিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আই-ইউকা)-এর বিজ্ঞানী সঞ্জিত মিত্র। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘দু’টি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের মধ্যে দূরত্ব যত বেশি হবে, মহাকাশের সুদূর প্রান্ত আসা ক্ষীণ মহাকর্ষ তরঙ্গের উৎসগুলিকেও আরও নিখুঁত ভাবে চিহ্নিত করা যাবে। পৃথিবীর এক পিঠে আমেরিকা। উল্টো পিঠে সবচেয়ে দূরের দেশটিই আমাদের। তাই আমেরিকার লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ অবজার্ভেটরি (লাইগো) এবং লাইগো-ইন্ডিয়ার যৌথ গবেষণার জন্য ভারতে নজরদারি কেন্দ্র গড়া হলে ব্রহ্মাণ্ডকে অনেক ভাল করে দেখা যাবে। ’
কতটা ভাল করে? ‘‘হিসেব কষে দেখানো যায়, ৫ গুণ ভাল করে,’’ বলছেন সঞ্জিত। ‘আই-ইউকা’-র বিজ্ঞানী সুকান্ত বসুও আজ এক আলোচনাচক্রে বলেন, ‘‘গত কাল লাইগো-র বিজ্ঞানীরা ১,৩০০ কোটি বছর আগে দু’টি ব্ল্যাক হোলের মিশে যাওয়ার খবর দিয়েছেন। কিন্তু সে দু’টি আকাশের ঠিক কোথায় ছিল তা স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। ভারতে মহাকর্ষ-তরঙ্গ যন্ত্র থাকলে ওই অস্পষ্টতা ১০০ গুণ কমে যেত।
এটা ঘটনা, কোনও মহাকাশ কেন্দ্র বা কৃত্রিম উপগ্রহকে মহাকর্ষ তরঙ্গ ধরার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করার কথাও ভাবা হচ্ছে। তাতে পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রগুলির মধ্যে দূরত্ব আরও বেশি হবে। কিন্তু এখনও সে ভাবনা বাস্তব চেহারা পায়নি। ফলে পৃথিবীতে দূরের কেনও দেশের কথাই ভাবছেন লাইগোর কর্ণধাররা। সঞ্জিত জানান, অস্ট্রেলিয়াও আমেরিকা থেকে যথেষ্ট দূরে। আমেরিকার লাইগো প্রকল্পের কর্ণধাররা সে দেশেই যন্ত্র বসাতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু প্রথমে আগ্রহ প্রকাশ করেও অস্ট্রেলিয়া পরে পিছিয়ে যায়। তখন ভারতের ব্যাপারে আগ্রহী হন আমেরিকার বিজ্ঞানীরা। ‘‘এ বার আমাদের সুযোগ নেওয়ার পালা। ভারত সরকার লাইগো-ইন্ডিয়া প্রকল্প নিলে বিশ্ববিজ্ঞানের পক্ষেও তা হবে এক বড় লাভ। লাইগো-ইন্ডিয়ার জন্য ওকালতি করা মানে তাই শুধু জাতীয়তাবাদী হওয়া নয়। ভারতের ভৌগোলিক অবস্থানই এমন যে এ দেশে যন্ত্র বসালে বিশ্ববিজ্ঞানের লাভ,’’ বলছেন সঞ্জিত।
ফ্রান্স এবং ইতালির যৌথ উদ্যোগে মহাকর্ষ-তরঙ্গ শনাক্ত করার যন্ত্রের নাম ‘ভার্গো’। তা বসেছে ইতালির সিসিলি শহরের কাছে। আপাতত তার কাজ বন্ধ। যন্ত্রের উন্নতি ঘটিয়ে ফের কাজ শুরু হবে। সে প্রসঙ্গ তুলে সঞ্জিত বলেন, ‘‘একটা কাল্পনিক পরিস্থিতি ভাবুন। ধরুন, লাইগো এবং ভার্গো চালু। কিন্তু ভারতে যন্ত্র বসেনি। তা হলে মহাকর্ষ-তরঙ্গ যতটা বোঝা যাবে, তার চেয়ে অনেক বেশি বোঝা যাবে যদি ভার্গো বসে থাকে এবং লাইগো ও লাইগো-ইন্ডিয়া এক সঙ্গে কাজ করে। ভৌগোলিক অবস্থানের আশীর্বাদ এটা। সেটাকে কাজে লাগাতে পারলে বিশ্বের লাভ।’’
লাইগো-ইন্ডিয়ার পরিকল্পনার শুরুটা হয়েছিল ২০০৭ সালে। আজ এক আলোচনাসভায় ‘আই-ইউকা’র বিজ্ঞানী তরুণ সৌরদীপ বলেন, ‘‘অস্ট্রেলিয়া হাত গুটিয়ে নেওয়ার পরে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা লাইগোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। লাইগো ভারতীয় গবেষকদের প্রস্তাবে উৎসাহ দেখালে ২০০৯-এ এ নিয়ে একটি পরিকল্পনা তৈরির জন্য কমিটি গড়া হয়। এটা বেশ বড় প্রকল্প, বিনিয়োগ চাই অনেক। তাই যোজনা কমিশনের ‘মেগাসায়েন্স কমিটি’-র কাছে প্রস্তাব পেশ করা হয়েছিল।’’ বিষয়টি কেন্দ্রের পরমাণু শক্তি বিষয়ক দফতর এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতরের অধীন। দু’টিই বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী দফতরের হাতে।
তরুণ জানান, এ দেশে কোথায় মহাকর্ষ তরঙ্গ কেন্দ্র হতে পারে, তার সাইট সিলেকশন কমিটি ইতিমধ্যেই ২০টি জায়গার তালিকা থেকে দু’টিকে বেছে রেখেছে প্রাথমিক ভাবে। মহারাষ্ট্রের নান্দেরের কাছে ‘আউন্ধা’ ও রাজস্থানে উদয়পুরের অদূরে কল্যাণপুর। লাইগো-ইন্ডিয়া চালু হলে তার বিজ্ঞানীরা থাকবেন কোথায়? তরুণ জানাচ্ছেন, ‘‘এর জন্য আবাসন প্রকল্পের নকশাও তৈরি রয়েছে।’’
তবে সরকারি অনুমোদন পেলেও যন্ত্র তৈরি করে বসাতে ৮ বছর লেগে যাবে। প্রকল্প অনুমোদনে দেরি হলে তা কি ভারতকে পিছনে ঠেলে দেবে?
এর উত্তর দিলেন ভাবা পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে হোমি ভাবা চেয়ার প্রফেসর শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি এক সময় দেশের পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। লাইগো-ইন্ডিয়া প্রকল্পকে সবুজ সঙ্কেত দেওয়া যোজনা কমিশনের সেই মেগাসায়েন্স কমিটির মাথাতেও ছিলেন শ্রীকুমারবাবু। তিনি অবশ্য মনে করেন না যে, সরকারি অনুমোদনে দেরির ফলে ভারত খুব একটা পিছিয়ে পড়বে। কেন? এ ব্যাপারে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী তেমন কোনও দেশ নেই।
তরুণ ও তাঁর সতীর্থরা সকলেই বলছেন, অস্ট্রেলিয়া পিছিয়ে গিয়েছে বলেই বিজ্ঞানীরা ভারতের ব্যাপারে উৎসাহ দেখাচ্ছেন, এমন নয়। ভৌগোলিক অবস্থান ছাড়াও এই ‘বিগ সায়েন্স প্রজেক্ট’টির ক্ষেত্রে ভারত অন্য দিক দিয়েও অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার হাতে এত গবেষকই নেই। ওখানে বিদেশের বিজ্ঞানীদের ভিড়। ভারতে নিজেদের গবেষক প্রচুর। এই মুহূর্তে ভারতে মহাকর্ষ-তরঙ্গ গবেষকের সংখ্যা কত? তরুণ জানান, ‘‘এখনই একশোর বেশি।’’ তরুণ যে ভুল বলছেন না, তার প্রমাণ মেলে ‘আই-ইউকা’-র মহাকর্ষ-তরঙ্গ গবেষণায় যুক্ত তরুণ মুখের ভিড় দেখে। অনির্বাণ আইন কিংবা জাভেদ রানার মতো প্রচুর গবেষক এখন লাইগো ইন্ডিয়ার প্রকল্পে সরকারি অনুমোদন ও সহায়তার আশায় দিন গুণছেন।
শ্রীকুমারবাবু এ-ও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘আমেরিকায় গত কালের ঘোষণার পর হয়তো মহাকর্ষ তরঙ্গ গবেষণা এ বার প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়াবে।’’ প্রতিযোগিতা যে বাড়বে তা মনে করেন ‘আই-ইউকা’-র বিজ্ঞানী সঞ্জীব ধুরন্ধরও। তিনি হলেন সেই গবেষক যাঁর উদ্ভাবিত পন্থায় মহাকর্ষ-তরঙ্গ শনাক্ত করেছেন লাইগোর বিজ্ঞানীরা। আজ এক বক্তৃতায় সঞ্জীব বলেন, ‘‘প্রতিযোগিতা বাড়বেই। সেটা মাথায় রাখা দরকার। ইন্ডিগো বানচাল হলে তরুণ ভারতীয় বিজ্ঞানীরা হতাশ হবেন।’’ মোদী অবশ্য কালই টুইট করেছেন, ‘‘আশা করি, মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করার ব্যাপারে আরও বড় অবদান রাখার দিকে আমরা এগিয়ে যাব।’’ এটাই আশা বাড়িয়েছে দেশীয় গবেষকদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy