দৃশ্যটা কোনও দিন ভুলব না!
চার হাজার শ্রোতা উঠে দাঁড়িয়েছেন। মঞ্চ থেকে যত দূর চোখ যায় দেখছি, সবার চোখে জল!
স্টেজের মধ্যিখানে মাথা নিচু করে বসে গজল-সম্রাট জগজিৎ সিংহ।
প্রেক্ষাগৃহে পাতা-খসার শব্দটুকুও তখন বেমানান!
বছর সাত-আট আগের কথা।
নজরুল মঞ্চে জগজিৎ সিংহ-গুলাম আলির কনসার্ট।
সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। হঠাৎ জগজিৎভাই ফোন করে বললেন, ‘‘আমি তিন দিন আগে চলে যাব। কলকাতায় একটু ঘুরব। খাব-দাব। তুমি হোটেল বুক করে রাখো।’’
আমরা শুনে স্বভাবতই উত্তেজিত।
আসার দিন চেক-ইন করার পরও ফোন করলেন, ‘‘আমি এয়ারপোর্টে। তুমি দমদমে গাড়ি পাঠিয়ো। নিজে আসতে যেয়ো না।’’
আধ ঘণ্টা গড়িয়েছে সবে।
আবার ফোন।
আবার জগজিৎভাই।
ধরা ধরা গম্ভীর গলা। ধীরে ধীরে বললেন, ‘‘মা মারা গেলেন। এখনই খবর পেলাম। আমায় দিল্লি চলে যেতে হচ্ছে এখনই।’’
আমি নির্বাক।
ও পাশ থেকে আবারও কথা ভেসে এল, ‘‘চিন্তা কোরো না, কনসার্টের দিন সোজা এয়ারপোর্ট থেকে চলে যাব। তুমি চেনা লোক পাঠিয়ো। কাউকে বেশি কিছু বলতে যেয়ো না। গুলামকে শুধু বোলো, একটুআধটু দেরি হলে, ও যেন ম্যানেজ করে নেয়।’’
কনসার্টের দিনই ওঁর মাকে দাহ করা হয়েছিল। সকালে মায়ের সৎকার করে সোজা দিল্লির এয়ারপোর্ট। সেখান থেকে ফ্লাইটে দমদম। ভিআইপি রুমে গিয়ে ‘চেঞ্জ’ করে আমার পাঠানো গাড়ি নিয়ে নজরুল মঞ্চ। এক কাপ চা খেলেন। তারপরই স্টেজে বসে পড়লেন গান গাইতে।
আমি কেমন স্তম্ভিত হয়ে পড়ছিলাম ওঁকে দেখতে দেখতে। মাইকটা হাতে নিয়ে যন্ত্রের মতো শুধু বললাম, ‘‘আজ যিনি আপনাদের সামনে এখন গাইতে বসলেন, তাঁর মাকে আজই তিনি দিল্লিতে দাহ করে সোজা শ্মশান থেকে এখানে চলে এসেছেন।...’’
মুহূর্তকালের জন্য থমমারা স্তব্ধতা গোটা নজরুল মঞ্চে। তারপরই একে একে সবাই উঠে দাঁড়ালেন।
সবার চোখে জল।
এ দৃশ্য কোনও দিনই কি ভোলার!
সিংহ পরিবার
•
সময়টা ’৭৫ কি ’৭৬ সাল। সালামৎ আলি খান আর নাজাকাত আলি খানকে নিয়ে মুম্বই যাচ্ছি।
হঠাৎ দেখি, জগজিৎ সিংহ। এগিয়ে এলেন আমার দিকে। তখন ওঁর তেমন নাম হয়নি। খুব বিনীত ভাবে আমাকে বললেন, ‘‘আপনি যদি আমাকে একটু সালামৎ খানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন...।’’
দিলাম করিয়ে।
সেই শুরু আমাদের সম্পর্কের।
তারপর তো কত প্রোগ্রাম করলাম। কোথায় না কোথায় গেছি ওঁকে নিয়ে। জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং দিয়ে শুরু। বেঙ্গালুরুতে তিরিশ হাজার দর্শকের সামনে ওঁর কনসার্ট তো আমার জীবনে সেরা গ্যাদারিং।
বহুবার বিদেশেও গিয়েছি ওঁকে নিয়ে। ঢাকায় একবারের কথা মনে পড়ে। সাত দিনের মধ্যে শো হাউসফুল।
তারপরেও টিকিটের হাহাকার থামে না। শেষে মন্ত্রী-টন্ত্রিদের ধরে কোনও ক্রমে আবার একটা হল-এর ব্যবস্থা করে সাততাড়াতাড়ি সে বারই দ্বিতীয় একটা কনসার্ট করাতে হল।
কত ঘটনা। কত ঘটনা।
জগজিৎভাইয়ের জীবনটা আমার কাছে একটা বড়সড় উপন্যাসের খোলা পাতার মতো।
জীবনে সঙ্গীত যদি প্রথম প্রেম হয়, ওঁর দ্বিতীয় প্রেম ছিল ‘রেসিং’। ঘোড়দৌড়। নিয়মিত ‘রেস’ খেলতেন। নিজের আট-দশটা ঘোড়া ছিল। মুম্বইতে সেই ঘোড়াগুলো ছুটত শীতকালে। গরমকালে তারাই আবার বেঙ্গালুরুতে। আর বর্ষার সময় পুণেতে।
শুধু ভারত বলে নয়, বিদেশে গেলেও রেসিং-এর নেশাটা ওঁকে তাড়িয়ে বেড়াত।
এক বারের কথা।
মুম্বই থেকে হঠাৎ একদিন ফোনে বললেন, ‘‘লন্ডন যাব। ঘুরতে। নো প্রোগ্রাম। শুধু বেড়াব। তোমার যদি তেমন অসুবিধে না হয়, যাবে? তা’হলে চলে এসো।’’
গেলাম। গাড়ি নিয়ে সারা লন্ডন চক্কর দিতাম আমরা। তার মধ্যেও ওঁর রেসের মাঠে যাওয়া চাই-ই। প্রচুর ইংরেজ জকি ছিলেন ওঁর বন্ধু।
এ দেশেও ওঁর রেসিং-এর বন্ধুর সংখ্যা অগুনতি। তার মধ্যে যেমন নামী শিল্পপতিরা আছেন, তেমন মাঠে ওয়ার্কআউট করতে আসা ট্রেনারও আছেন।
এখানে একটা কথা বলি।
জগজিৎভাইয়ের সঙ্গে মুম্বইতে দেখা করতে গেলে সোফিয়া কলেজের কাছে ওঁর বাড়িতেই যেতাম। ‘পুষ্পমিলন অ্যাপার্টমেন্ট’। পথ দুর্ঘটনায় জগজিতের ছেলে মারা যাওয়ার পর যে রাস্তার নাম হয়েছে, ওঁর ছেলেরই নামে। ‘বিবেক সিংহ মার্গ’।
দুটো ফ্ল্যাট একসঙ্গে করে তিন তলায় থাকতেন ওঁরা। পেল্লাই আবাস।
সকালে এগারোটা-সাড়ে এগারোটা নাগাদ পৌঁছে যেতাম। ওই সময়টা উনি রেওয়াজ করতেন। সঙ্গে চিত্রাদিও বসতেন রেওয়াজে।
দেড়টা-দুটোর আগে জগজিৎভাই বাড়ি থেকে বেরতেন না। অত সকালে বাড়িতে লোকজনও তেমন আসতেন না। একমাত্র ওঁর ছাত্র ভাসওয়ানিকে দেখতাম মাঝে মধ্যে আসতে। ফলে জানতাম দেখা পাবই পাব। কথাও বলা যাবে নিশ্চিন্তে।
কোনও কারণে ওই সময়ে যেতে না পারলে, আমি জানতাম, ওঁর সঙ্গে দেখা করার, কথা বলার আরেকটা নিশ্চিত জায়গা হল রেসের মাঠ। ‘পুষ্পমিলন’ থেকে দেড়-দু’ কিলোমিটার দূরে।
প্রত্যেক দিন সকাল সাড়ে আট-ন’টা নাগাদ ওই রেসের মাঠেই মর্নিংওয়াক করতে যেতেন জগজিৎভাই। কোনও দরকারি কথা থাকলে হাঁটতে হাঁটতেই সেরে নিতাম। তারপর রেস্তোরাঁয় বসে এক কাপ চা খেয়ে উনি বাড়ি। আমি হোটেল।
রেসের মাঠটা জগজিৎভাইয়ের কতটা ‘অবসেশন’ ছিল, সেটা বোঝাতে আরেকটা ঘটনা বলি।
‘জিনা ইসিকা নাম হ্যায়’ বলে একটা প্রোগ্রাম হত একটি চ্যানেলে। কনডাক্ট করতেন ফারুক শেখ।
ওখানে নানা ধরনের সেলিব্রিটি আসতেন। ওঁদের কাছ থেকে আগেভাগে নিকটতম বন্ধুদের কুড়ি জনের একটা লিস্ট চাওয়া হত। সেই লিস্ট থেকে ওরা বারো জনকে বাছাই করে সেই প্রোগ্রামে সেলিব্রিটির সঙ্গে ‘মিট’ করাত। কোন বারো জন আসবে, তা আগেভাগে সেলিব্রিটিকে জানানো হত না।
জগজিৎভাইয়ের অনুষ্ঠানটায় ওই বারোজনের তালিকায় আমাকেও ডাকা হয়েছিল। যখন ঢুকছি, জগজিৎভাই উল্লসিত তো হলেনই, আর তার পরেই হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলেন, ‘‘বাদলভাই, আজ রেসকা ক্যয়া রেজাল্ট হ্যায়?’’
ভাবুন একবার!
জগজিৎভাইয়ের তিন নম্বর প্রেমটা হল ‘খানা’। সব রকম খাবার খেতেন। অতি সাধারণ খাবারও অমন তৃপ্তি করে খেতে আমি খুব কম লোককে দেখেছি।
দিল্লিতে দুটো রেস্তোরাঁ খুলেছিলেন জগজিৎভাই। প্রথমটা গুরগাঁওতে। দ্বিতীয়টা গ্রেটার কৈলাসে। দুটোই মানের দিক থেকে বেশ হাইফাই। চাইনিজ রেস্তোরাঁ। চিন থেকে শেফ আনিয়েছিলেন। কলকাতাতেও একবার রেস্তোরাঁ করবেন বলে উঠে পড়ে লেগেছিলেন, সে আর হয়ে ওঠেনি।
তবে রেস্তোরাঁর চেয়ে বাড়ির খাবারই বেশি পছন্দ করতেন। কলকাতায় এলে উঠতেন ফাইভ স্টার, কি থ্রি স্টারে। কিন্তু খেতেন আমার বাড়ির খাবার। দু’বেলাই। ফেরার দিন তো প্রতিবার সকালেই চলে আসতেন, দুপুরে খেয়েদেয়ে একটু রেস্ট নিয়ে সন্ধের ফ্লাইট ধরে মুম্বই।
জগজিৎভাইয়ের শখ-আহ্লাদের আরেকটা ব্যাপার ছিল ওর পাঞ্জাবি। শর্ট হাতা। কিন্তু লম্বা ঝুলের। এক সময় তো মুম্বইতে এটা একটা ‘স্টাইল স্টেটমেন্ট’ হয়ে গেল। লোকে বলত ‘জগজিৎ কুর্তা’।
চিত্রা সিংহর সঙ্গে রেসের মাঠে
•
বাইরে থেকে ওঁকে দেখে গম্ভীর গম্ভীর, কম কথার মানুষ মনে হত, জগজিৎভাই কিন্তু যাঁদের ভালবাসতেন, প্রাণখোলা আড্ডা দিতেন তাঁদের সঙ্গে।
তবে এটাও ঘটনা, মুম্বই ইন্ডাস্ট্রিতে ওঁকে তেমন মেলামেশা করতে দেখতাম না। খুব ভাল সম্পর্ক ছিল সুভাষ ঘাইয়ের সঙ্গে। শত্রুঘ্ন সিংহ, জালাল আগার সঙ্গেও।
একবার মধুরানির একটা গজলের অ্যালবাম বেরিয়েছিল। জগজিৎভাই রেকর্ডিংটা কোঅর্ডিনেট করেন। দিলীপকুমার তাতে পাঠ করেছিলেন। দিলীপকুমারের সঙ্গেও সুসম্পর্ক ছিল। জাভেদ আখতার, গুলজারসাবের সঙ্গে তো ছিলই। তার বাইরে কারও সঙ্গে বিরাট কিছু ঘনিষ্ঠতা ওঁর ছিল বলে আমার জানা নেই।
গুলাম আলির সঙ্গে জগজিৎভাইয়ের সম্পর্কটা ছিল অনেকটা খুনসুটির। একসঙ্গে কম তো কনসার্ট করেননি। প্রতিবার গ্রিনরুমে দেখতাম, জগজিৎভাই টানা পিছনে লেগে চলেছেন গুলাম আলির। দু’জনেরই পাঞ্জাবি জোকস-এর স্টক প্রচুর। সে সব নিয়েও হাসাহাসি চলত।
একবার টরেন্টোয় গেছি। গুলাম আলি আর অনুপ জালোটাকে নিয়ে অনুষ্ঠান করাতে। গিয়ে শুনলাম, জগজিৎভাই নাকি ওখানে আছেন। যোগাযোগ করলাম। রাত্রিবেলা চলে এলেন দেখা করতে। অনেক রাতে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া সেরে তবে ফিরলেন।
প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করতেন মেহেদি হাসানকে। গজল-জীবনের শুরুতে বলতে গেলে ‘ফলো’ই করে গিয়েছেন ওঁকে। ’৭৮ সালে প্রথম বারের মতো যখন মেহেদি হাসান ভারতে এলেন, তখন তো গজলের সে ভাবে চলই ছিল না। উনি আসার পর ধীরে ধীরে গজল লোকে শুনতে শুরু করে। জগজিৎভাই এ কথাটা প্রায়ই বলতেন। আর এ জন্য মেহেদির প্রতি একটা অন্য ধরনের দুর্বলতা ওঁর কাজ করত।
কোনও শহরে কনসার্টে মেহেদি গাইবেন, আর জগজিৎভাই সেখানে আছেন, এমন যদি হত, কিছুতেই কনসার্ট ‘মিস’ করতেন না।
মানুষ জগজিৎভাইয়ের সবচেয়ে বড় যে গুণটা আমার চোখে পড়ত, তা হল ওঁর কমিটমেন্ট। একবার কথা দিলে কিছুতেই তার অন্যথা করতেন না। চিকাগোর একটা অফারের কথা মনে পড়ছে। ওখানকার কিছু বাঙালি দুর্গাপুজোর সময় জগজিৎভাইকে গান গাওয়ানোর জন্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। বিশাল টাকার অফার। মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া অ্যামাউন্ট। এ দিকে তখন এক এজেন্টের সঙ্গে জগজিৎভাইয়ের কথা ছিল যে, একমাত্র ওরাই দু’বছরে একবার আমেরিকা-কানাডায় অনুষ্ঠান করাবে ওঁর। অন্য কেউ নয়। আর এই দু’বছরের মাঝে জগজিৎভাই কোনও অনুষ্ঠানে যাবেনও না।
তবু আমি ফোন করলাম ওঁকে।
সব শুনে বললেন, ‘‘শুনো, পহ্লে, ইসকো পিছে তুমরা ফ্যায়দা ক্যায়া?’’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘‘ফ্যায়দা আবার কী! আমার টেন পার্সেন্ট আসবে প্রমোশনের জন্য, ব্যস্।’’
এ বার বললেন, ‘‘ঠিক আছে, তোমার লোকসান হোক, এটা তো আমি চাইব না, টেন পার্সেন্ট অ্যামাউন্টটা কত হয় বলো। আমি তোমায় দিয়ে দেবে। আমি ওদের কথা দিয়েছি। তার খেলাফ করতে পারব না।’’
টাকাপয়সা নয়, আসল সম্পদটা হল মানুষে-মানুষে সম্পর্ক, তা যে কী ভাবে উনি বিশ্বাস করতেন, মানতেন, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
আমার অসুস্থ মা’কে হাসপাতাল থেকে বাড়ি আনলাম। কলকাতায় পা দিয়ে সোজা চলে গেলেন মায়ের কাছে। আমায় সে দিনই একটা জরুরি কাজে সুরাত চলে যেতে হয়েছে। ফোনে আমায় ধরে বললেন, ‘‘শোনো, তোমার তো অনেক খরচ হয়ে গেছে। কিছু টাকা দিয়ে যাই?’’
বললাম, ‘‘না, না। আমি আপাতত সব মিটিয়ে দিয়েছি। পরে লাগলে বলব।’’
লন্ডনে গেছি। সবে পা রেখেছি। পকেট থেকে তিন-চারশো পাউন্ড বার করে বললেন, ‘‘আপাতত এমার্জেন্সির জন্য এটা রাখো। তোমার লাগতে পারে।’’
এ সব কথায় আমি অস্বস্তিতে পড়ে যেতাম। কিন্তু এতটাই ‘কেয়ারিং’ ছিলেন জগজিৎভাই!
‘কেয়ারিং’ বলে ‘কেয়ারিং’! এত বছর ধরে অনুষ্ঠান করে বেড়াচ্ছি, জগজিৎভাইয়ের মতো মিউজিশিয়ানদের ‘কেয়ার’ করতে আমি কাউকে দেখিনি। কনসার্ট শেষ হল তো, উনি আগে সক্কলকে রওনা করিয়ে দিতেন, তারপর নিজে গাড়িতে ফিরতেন। সে যত রাতই হোক। এক দু’বারও এর অন্য রকম হতে দেখিনি।
টাকাপয়সা নিয়ে ওঁর রকমসকম বলছিলাম। তেমনই দুটো ঘটনা বলি। দেখুন, মানুষটা কতটা অন্যরকম ছিলেন।
নজরুল মঞ্চেরই একটা কনসার্ট। সে বারও ঠাসা দর্শক। ভেতরে তিল ধারণের জায়গা নেই। বাইরেও লোকের ভিড় এত যে, মাইক লাগাতে হল সেখানেও। লোকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান শুনল। প্রচণ্ড সাকসেশফুল প্রোগ্রাম। অনুষ্ঠান শেষে ওঁকে প্রত্যেকবারের মতো প্যাকেটে করে টাকাপয়সা দিয়ে দিলাম হাতে। কোনও দিনই প্যাকেট খুলে দেখতেন না। আমি বরং একটা হিসেব লিখে দিয়ে দিতাম প্যাকেটের ভেতরে।
হঠাৎ রাত প্রায় সাড়ে বারোটা-একটা নাগাদ জগজিৎভাইয়ের ফোন। আমি রীতিমতো ভয়ে ভয়ে ফোন ধরেছি। কোনও বিপদ হল না তো?
জগজিৎভাই বললেন, ‘‘তোমার ঘুম আসছে না তো?’’
‘‘কেন জগজিৎভাই? এত ভাল একটা প্রোগ্রাম হল, আজ তো নিশ্চিন্তে বেশি করে ঘুমনোর কথা।’’
‘‘আরে তুমি তো ভুল করে অনেক বেশি টাকা দিয়ে দিয়েছ। এর পর ঘুম তো চলে যাওয়ার কথা।’’
হেসে ফেললাম।
অনেক বুঝিয়ে বললাম, ‘‘এ বার যা টিকিট সেল হয়েছে, তাতে ওটাই পাওনা আপনার।’’
আরেক বার ঠিক উল্টো ব্যাপার।
কনসার্টের ব্যালান্স শিট নিয়ে বসেছি প্রায় দিন সাতেক বাদে। পঞ্চাশ হাজার টাকার হিসেব কিছুতেই মিলছে না। অনেক ভেবেচিন্তেও কূলকিনারা না পেয়ে, শেষে মনে হল, একমাত্র জগজিৎভাইকে বেশি দেওয়া হয়ে যেতে পারে।
ফোন করলাম। বললাম, ‘‘আপনি কি টাকাটা জমা করে দিয়েছেন?’’
‘‘না, কেন বলো?’’
বললাম, ‘‘তা হলে ভেতরের কাগজের সঙ্গে টাকার অ্যামাউন্টটা একবার চেক করে বলবেন, হাজার পঞ্চাশেক বেশি আছে কিনা?’’
আধ ঘণ্টা বাদে ফোন করতে বললেন। তাই করলাম। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘‘ঠিকই বলেছ। বেশি দিয়েছ পঞ্চাশ। তোমায় এটা পাঠিয়ে দেব।’’
এই হলেন জগজিৎভাই।
আপাদমস্তক আভিজাত্যেমোড়া ভাবগম্ভীর চেহারা, অথচ তার মধ্যে বাস করত অদ্ভুত এক ঘরেলু, তাজা, খাঁটি মন।
আসলে জীবনের অভিজ্ঞতাও তো গড়ে দেয় মানুষকে, জগজিৎভাইয়ের বেলায় হয়তো সেটাই হয়েছিল।
প্রতিটা ইঞ্চি যাকে খুঁটে খুঁটে পায়ের তলায় জমি তৈরি করে বড় হতে হয়, তার ধাঁচটা একটু অন্যরকম হওয়ার সম্ভাবনা তো থাকেই।
বাবা পিডব্লুডি-র ইঞ্জিনিয়ার। সচ্ছল পরিবার। বাবার ইচ্ছে, ছেলে আইএএস হবে, এ দিকে হঠাৎ কী খেয়ালে এমএ পড়তে পড়তে ছেড়ে দিয়ে ছেলে পঞ্জাবের শ্রীগঙ্গানগরের সুখী জীবন থেকে পালাল। সোজা মুম্বই।
কী করবে? গান।
পকেটে সাড়ে চারশো টাকা। পঁয়ত্রিশ টাকা ভাড়ায় একটা ঘরে অনেকে ‘শেয়ার’ করে থাকতেন।
সে মধ্য ষাট দশকের গল্প। মুম্বইয়ে তখন গানের তারার ছড়াছড়ি। ফলে কম ঠোক্কর খেতে হয়নি। কী না করেছেন তখন!
দিনের পর দিন ‘জিঙ্গল’ গেয়ে কাটিয়েছেন। শুধু গানের জগতে নিজেকে ‘ফিট ইন’ করবেন বলে পাঞ্জাবি-দাড়িটা ছেঁটে ফেলেছেন। তাতে আরেক প্রস্থ কষ্ট দিয়ে ফেলেছেন বাবাকে। কিন্তু নিজের ইচ্ছেটাকে জাপটে ধরে দিনের পর দিন পড়ে থেকেছেন আরবসাগরের পারে।
এমনকী ষাটের দশকের শেষাশেষি যখন চিত্রাদিকে বিয়ে করছেন, তখনও কোথায় আজকের এই ‘জগজিৎ সিংহ’?
চিত্রাদির সঙ্গে যোগাযোগটাও জগজিৎভাইয়ের অদ্ভুত। চিত্রাদি কলকাতার মেয়ে। বিয়ের আগে ছিলেন চিত্রা সোম। ওঁর মা সঙ্গীতজ্ঞ। চিত্রাদি ছেলেবেলায় নাকি স্বপ্ন দেখতেন ‘লতা মঙ্গেশকর’ হবেন। উল্টে অল্প বয়েসে বিয়ে হয়ে যায় জনৈক দত্ত পরিবারের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে।
ওঁকে নাকি একটা নাচের অনুষ্ঠানে দেখে পছন্দ করেন ভদ্রলোক। অল্প বয়েসেই মেয়ে এসে যায় কোলে—মণিকা। গান তখন শিকেয়। স্বামী মুম্বইয়ে বড় চাকরি নিয়ে আসা অবধি তাই-ই ছিল। মুম্বই গিয়ে আবার গানের চর্চা শুরু। শুনেছি, স্বামী নাকি বাড়িতে একটা স্টিরিওফোনিক স্টুডিয়ো করেন।
ওই সময়ই কোনও এক অনুষ্ঠানে গিয়ে জগজিৎ সিংহর সঙ্গে আলাপ চিত্রাদির। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ। তারও বেশ কিছু বাদে জগজিৎভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক। গুরুদ্বারে মাত্র তিরিশ টাকা খরচা করে বিয়ে ওঁদের।
ওঁদের সংসারজীবন শুরু হয়ে যায় মেয়ে মণিকাকে সঙ্গে করেই। এরপর তো ছেলে হল— বিবেক। সময়টাও যেন ধীরে ধীরে পাল্টাতে লাগল।
জগজিৎভাই-চিত্রাদি একসঙ্গে গাইতে লাগলেন। ওঁদের অ্যালবাম ‘দ্য আনফরগেটেবলস্’ বেরল। সুপারহিট।
তার পর তো শুধুই এগিয়ে চলা।
মণিকা-বিবেকও বড় হচ্ছিল। বিবেক আবার ক্রিকেটার। মুম্বইয়ে উঠতিদের মধ্যে চোখে পড়ার মতো তার প্রতিভা। আরেক প্রতিভাবান ক্রিকেটার সাইরাজ বাহুতুলের বন্ধু।
অন্য দিকে জগজিৎভাইয়ের সঙ্গে বিবেকের সম্পর্কটা ঠিক বাবা-ছেলের মতো নয়, বরং অনেকটাই বন্ধুত্বের।
বিবেক বাবার কনসার্টে যায়। রেকর্ডিং-এ থাকে। মন দিয়ে গান শোনে। বন্ধুরা কনসার্টে এলে, তাদের পছন্দের গানগুলো গাইতে বাবাকে আব্দার করে।
মসৃণ, ঝলমলে, টগবগে জীবন তখন ওঁদের। হঠাৎ একটা রাত যেন ছন্নছাড়া করে দিল সিংহ পরিবারটিকে।
২৮ জুলাই, ১৯৯০।
রাতবিরেতে মেরিন ড্রাইভের কাছে, কপূর মহলের সামনে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় চলে গেল আঠেরো বছরের বিবেক। বন্ধু সাইরাজ প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এল জীবনে। বিবেকের ফেরা হল না।
ভোর রাতের ঘটনা। সকালে উঠে এমনিই ফোন করেছিলাম জগজিৎভাইকে। অন্য একজন ধরলেন। তিনি আবার আমার পরিচিত। তখন শুনলাম সব।
জগজিৎভাইয়ের সামনে কী করে যে দাঁড়াব গিয়ে, এটা ভাবতে ভাবতে দু’সপ্তাহ কেটে গেল।
শেষমেশ যে দিন যেতে পারলাম, দেখলাম, অমন সুদর্শন চেহারাটায় কে যেন ভুসো কালি ঢেলে দিয়েছে!
আমি কী বলব, কিছুই বুঝতে পারছি না। জগজিৎভাই আমার পিঠে হাত রাখলেন। বললেন, ‘‘যো হোনা থা, হো গিয়া...! ম্যায় কেয়া কর্ শকতা!’’
এর পরও জগজিৎভাই গানে ফিরলেন। খুব যত্ন করে ‘সামওয়ান সামহোয়্যার’ অ্যালবামটা বানালেন ছেলেকে উৎসর্গ করে।
চিত্রদি ফিরলেন না। আমি অনেক বুঝিয়েছি। কাজ হয়নি। বাড়িতে রেওয়াজটাই যা করতেন। কনসার্টে আর না।
জাভেদ আখতার-জগজিৎ সিংহ জুটির অ্যালবাম প্রকাশে
•
জগজিৎভাইয়ের একটা ব্যাপার ছিল। কেবলই নতুন কিছু করার একটা তাগিদ।
এক বার যেমন। ‘ক্রাই ফর ক্রাই’ অ্যালবামটা তৈরির কাজ করছেন। হঠাৎ মুম্বই থেকে ফোনে বললেন, ‘‘শোনো আমার একটা অল্পবয়েসি মেয়ে চাই। যার গলার আওয়াজ অনেকটা লতা মঙ্গেশকরের শিশুবেলাকে মনে করাবে। পারবে দিতে?’’
চোদ্দো-পনেরো বছরের একজনের কথা বললাম। মেয়েটি তখন আমার কাছে কিছু গাইডেন্সের জন্য আসত। শুনে বললেন, ‘‘আমি পরশু কলকাতা আসছি। ওকে একবার হোটেলে পাঠিয়ে দাও। দুটো গান শুনব।’’
দুটো নয়, মেয়েটির গান এত পছন্দ হয়েছিল যে, পর পর পাঁচ-ছ’টা গান শুনেছিলেন জগজিৎভাই।
তারপর রেকর্ডিং। অ্যালবাম। রেকর্ড সেল। মেয়েটি এত রয়্যালটি পেয়েছিল যে, বাগুইহাটিতে টু-রুম ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছিল।
•
ওঁর সঙ্গে শেষ দেখা দিল্লিতে।
২১ নভেম্বর সায়েন্স সিটি-তে একটা কনসার্ট করব ঠিক করেছিলাম।
তার মধ্যেই আমি একটু অসুস্থ হলাম। দিল্লিতে মেয়ের কাছে বিশ্রামে ছিলাম। একটু সুস্থ হতে জগজিৎভাই এক দিন ফোনে বললেন, ‘‘আমি আজই দিল্লিতে আসছি। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা হোটেলে চলে যাব। তুমি ওখানে চলে এসো। কলকাতার কনসার্টটা নিয়ে একটু কথা বলব।’’
গেলাম। আমার জন্ডিস হয়েছিল বলে স্পেশাল ডিশ অর্ডার দিলেন। অনেক আড্ডা হল। সে রাতেই ওঁর অনুষ্ঠান। ন’টার সময়। বিকেল চারটে নাগাদ বললাম, ‘‘এ বার যাই। আপনি রেস্ট নিন। ’’
ফেরার সময় জড়িয়ে ধরলেন।
কী জানি কেন!
একটু যেন বেশিই আবেগতাড়িত দেখেছিলাম সে দিন। পিঠটা আলতো চাপড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘কলক্কাত্তামে জোর ধমাকা হোনা চাহিয়ে। ম্যায় আরাহা হুঁ।’’
ওই একবারই কথা রাখেননি জগজিৎভাই।
মুম্বইয়ে কনসার্ট ছিল গুলাম আলির সঙ্গে। আমি হঠাৎ খবর পেলাম জগজিৎভাই অসুস্থ। গুলাম আলিকে ফোন করলাম। উনিও বললেন, ‘‘ওর জায়গায় হরিহরণ গাইছে। জগজিৎকো বিমার হোগ্যায়া।’’
প্রায় দু’সপ্তায় কোমায় থেকে ১০ অক্টোবর, ২০১১-য় সব শেষ!
পাঁচটা বছর চলে গেল। এখনও যেন মাঝে মাঝেই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় ভুগি। ভোরবেলা ফোন এলে ঘুমচোখে এক-আধদিন ভেবে বসি, নির্ঘাৎ জগজিৎভাই!
অথচ পৃথিবীতে এমন ঘটনা যে আর ঘটার নয়!
কিন্তু, যদি ঘটত...!
সাক্ষাৎকারভিত্তিক লেখা:
দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়
সংশোধন: ১৪ মে ‘পত্রিকা’য় সত্যজিৎ রায়ের ছবিটি হীরক সেনের
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy