রৈখিক: শিল্পী বিজন চৌধুরীর চিত্রকর্ম।
হাওড়ার আনন্দী আর্ট গ্যালারিতে আয়োজিত হয়েছিল শিল্পী বিজন চৌধুরীর লাইন ড্রয়িংয়ের প্রদর্শনী। আয়তনে ছোট হলেও এই নতুন স্পেসটিতে রাখী জানা সুন্দরভাবে প্রদর্শনীটির আয়োজন করেছিলেন, যা দেখার অভিজ্ঞতা সত্যিই মুগ্ধকর।
বিজন চৌধুরীর জন্ম বাংলাদেশের ফরিদপুরে, ১৯৩১ সালে। বড় হতে হতে দেখেছেন বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ ইত্যাদি। ঝুঁকেছেন বামপন্থী রাজনীতির দিকে। আর্ট কলেজের বার্ষিক প্রদর্শনীতে প্রধান অতিথিরূপে আমন্ত্রিত রাজ্যপালের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করায় কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন কিছু ছাত্র। তাঁদের মধ্যে বিজন চৌধুরী ছিলেন একজন। এর পরে তিনি ফিরে যান ঢাকায়। সেখানে শিল্পী জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে পরিচয় এবং ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়া। তারপর জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমেদ প্রমুখের কাছে শিক্ষালাভ করেন। জয়নুল আবেদিনের অনুপ্রেরণায় নিজের শিল্পভাবনা প্রকাশের ভাষা খুঁজে পান বিজন। বামপন্থী প্রতিবাদী শিল্পী হিসেবেই তাঁর খ্যাতি। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েছিলেন। তার পরে পালিয়ে আসতে হয়েছিল কলকাতায়। প্রতিষ্ঠা করেন সোসাইটি অফ কন্টেম্পোরারি আর্টস।
জল ও তেলরঙে শিল্পীর অসংখ্য কাজ থাকলেও এই প্রদর্শনীটি ছিল বিজন চৌধুরীর শুধুই কিছু লাইন ড্রয়িং নিয়ে। তবে এ সব ড্রয়িংয়েও তাঁর দক্ষতার পরিচয় অবশ্যই মেলে। প্রথম দিকের ড্রয়িংয়ে রাজনৈতিক চেতনার ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। পরের দিকের বেশ কিছু ড্রয়িংয়ে আবার দেশজ পটচিত্রের ছাপ স্পষ্ট। যেন নিজের একটি ভাষা স্থাপনের প্রয়াস।
বিজনের ছবিতে একাধিক ঘোড়া দেখা যায়। সেগুলি যেন যুদ্ধের বীর ঘোড়া। সেখানে আবার দেশীয় কাঠের ঘোড়ার রূপও খানিকটা মিলিয়ে দিয়েছেন শিল্পী। যুদ্ধে আহত বীর মাটিতে ধরাশায়ী, পাশে নারীরূপী আশা বা ভবিষ্যৎ। ঘোড়াগুলিতে বেশ একটা গতি নিয়ে এসেছেন বিজন, যে কারণে সেগুলি খুবই মনোগ্রাহী লাগে।
প্রদর্শনীর ২৯টি ড্রয়িংয়ের বেশির ভাগেই তারিখ বা শিল্পীর স্বাক্ষর নেই। যার ফলে ধারাবাহিক ভাবে কোনটা আগে বা কোনটা পরে, তা বোঝার বিশেষ উপায় নেই। দু’-তিনটি ড্রয়িংয়ে অবশ্য স্বাক্ষর এবং তারিখ চোখে পড়ল। সম্ভবত এ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকের কাজ। মনে হয় শিল্পী এই কাজগুলি ঠিক সকলের কাছে তুলে ধরার জন্য তৈরি করেননি। এগুলি যেন কিছুটা খসড়ার মতো। হয়তো তাঁর স্কেচ খাতা থেকে উঠে এসেছে। এ থেকে পরে হয়তো তেলরং বা জলরঙের ছবি জন্ম নিয়েছে।
এইসব ড্রয়িংগুলিতে নারীর নানা রূপ দেখা যায়। কোথাও উৎপীড়নকারী, বিরহিণী, কোথাও বারবনিতা, কোথাও বা সঙ্গীতশিল্পী। কোথাও পূজারিনি আবার কোথাও বা পুরুষের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি আশ্লেষরতা। শিল্পী অনেক ড্রয়িংয়েই পরিষ্কার করে কোনও কথা বলতে চাননি। অবয়বে বা স্ট্রাকচারে অনেকটাই বিমূর্তকরণ বা অ্যাবস্ট্রাকশন রয়েছে, যা দর্শককে বেশ কিছুটা ভাবায়। কিছু কিছু পৌরাণিক চরিত্রেরও আভাস পাওয়া যায়, কিন্তু স্পষ্ট ভাবে বলা নয়। সঙ্গীতপ্রিয় ছিলেন আন্দাজ করা যায়, কারণ কিছু ড্রয়িংয়ে বীণা এবং সেতারের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়।
একটি ড্রয়িংয়ে দেখা যায় যে ঘোড়াটি ছুটে চলে যাচ্ছে, যেন তার সওয়ারিকে সে পিঠ থেকে ফেলে দিয়েছে। বীরপুরুষটি ভূপতিত। এটি এত কম লাইনে, এত সুন্দর এবং শক্তিশালী যে খুব মন টানে।
আরও একটি ড্রয়িংয়ে আমরা দেখি, নারীর পদতলে বসে পুরুষ বীণা বাদনরত, যেন নারীকে কিছুটা দেবীর আসন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আর একটিতে পি সি সরকারকে দেখানো হয়েছে, যেখানে উনি নারীকে কেটে দু’ভাগ করে ম্যাজিক দেখান। আবার কোথাও মানুষের সর্বাঙ্গে খেলে যাচ্ছে নদীর স্রোত আর নানা আকারের মাছ। নৌকা, মাছ, বিড়াল এবং প্রায় সর্বত্রই ঘোড়া এঁকেছেন শিল্পী। আরও একটি ছবিতে পুরুষ অভিমানী নারীকে শান্ত করার চেষ্টা করছে এবং পিছনে ঘোড়ার পিঠে পুরুষ। এখানে ঘোড়া ব্যবহার করে মনে হয় উনি পুরুষোচিত তেজ বা বীরত্ব বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।
প্রায় সমস্ত ছবিগুলোই অবয়বধর্মী কিন্তু তার সঙ্গে বিমূর্ততার মায়াজাল তাকে একটু যেন দুর্বোধ্য করে দেয়। বিজন চৌধুরীর ড্রয়িং আজকাল আর দেখা যায় না বিশেষ কোথাও, তাই আনন্দী আর্ট গ্যালারির এই উদ্যোগ সাধুবাদযোগ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy